Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | বিজেপির উল্টা গিনতি চালু? তাই নাকি?    

Fourth Pillar | বিজেপির উল্টা গিনতি চালু? তাই নাকি?    

Follow Us :

কর্নাটকের ভোটগণনার আগের দিনে, ১২ তারিখে চতুর্থ স্তম্ভে যা বলেছিলাম তা একবার শুনে নিই আমরা। ‘কর্নাটকে সরকার গেলে পড়ে থাকবে গুজরাত আর মধ্যপ্রদেশ, সেখানেও কংগ্রেস ভেঙে সরকার বানিয়েছিল বিজেপি। প্রবল অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি হাওয়া এখনই বইছে। বিজেপির রাজ্যস্তরের নেতা কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন। কাজেই মিডিয়ার প্রচারে মোদি-শাহ, আরএসএস–বিজেপিকে যে বিশাল মনে হচ্ছে আসলে তাঁদের চেহারা তত বড় তো নয়ই বরং ভালনারেবল, তারা হেরে যেতেও পারে। আর এইখানেই এসে কর্নাটকের নির্বাচন এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জানি অনেকেই বলবেন যে রাজ্যের নির্বাচন আর লোকসভার নির্বাচন এক নয়, দুটোর ফলাফল এক হতেই পারে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়, খানিকটা বিজেপির নির্দেশে, তাদের চাহিদাতেই মিডিয়া মোদিজির এক না হারা চেহারা তৈরি করেছে। মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। মানে ধরুন গুজরাতের ভোট হল, লড়াই কার মোদি বনাম রাহুলের। উত্তর পূর্বাঞ্চলের নির্বাচন, মিডিয়া জানাল লড়াই মোদি বনাম রাহুল, মোদি বনাম বিরোধীদের। কে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী? ক’জন জানে, সবাই জানে জয় এসেছে মোদিজির হাত ধরে। এবার তাহলে কী হবে? যদি বিজেপি হারে, তাহলে সেটা মোদিজির হার হবে। এবং এটা না যদি হয়, আগামিকাল যদি বিজেপি জিতে যায়, তাহলে। মিডিয়া বলবে ২০২৪ ডান ডিল, লড়াই শেষ। ২৪-এর আগেই সরকার আবার মোদিজির ঘোষণা করবেন অর্ণব। মানে ২০২৪-এর নির্বাচন এক ক্লোজড চ্যাপটার হয়ে যাবে। কিন্তু যদি বিজেপি হারে? তাহলে সেই সম্ভাবনা থেকে যাবে কেবল নয়, মোদিজিও হারতে পারে এই খবর তেলঙ্গানা, রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্যপ্রদেশে ছড়িয়ে যাবে। এবং এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়, এরপরে তেলঙ্গানা, রাজস্থান, ছত্তিশগড় বা মধ্যপ্রদেশের মধ্যে ৩টে রাজ্যও যদি বিজেপি হারে, তাহলে ২০২৪-এর লড়াইয়ে জোর টক্কর হবে, কাঁটে কা টক্কর। আর যদি আগামী ৪টে নির্বাচনেই বিজেপি হেরে যায়? তাহলে উল্টা গিনতি শুরু। কর্নাটক সেই উল্টা গিনতির পয়লা মাইলস্টোন হয়ে থেকে যাবে।” 

গণনার আগের দিন বলেছিলাম, আবার বলছি। হ্যাঁ, সেই উল্টা গিনতি চালু। কিছু রাজনৈতিক পণ্ডিত, অবশ্যই বিজেপির ভক্তগণ এবং এ রাজ্যে আরএসএস–বিজেপির ছুপা রুস্তম ও কুনকি হাতিরা চিৎকার করবেন একটা রাজ্যের নির্বাচনে হারা মানেই কি উল্টা গিনতি? বিজেপির হারা শুরু? ২০১৭তে গুজরাতে জোর লড়াই দিয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৮তে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় কংগ্রেস জিতেছিল, ২০১৫তে দিল্লিতে আপ ধুয়ে দিয়েছিল মোদি অ্যান্ড কোম্পানিকে। তারপরে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে সাতে সাত, গুজরাত, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশে ঝাড়ু লাগিয়েছে বিজেপি। প্রায় সব আসন ছিল বিজেপির। তাহলে? যাঁরা বলছেন একথা হয় তাঁদের মনেই নেই, না হলে তাঁরা ওই কুনকি হাতি বা ছুপা রুস্তম, যাঁরা সত্যিটা লুকিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৯-এর আগে যাবতীয় সমীক্ষা বলেছিল বিজেপি ২২০–২৪০ পার করতে পারবে না। কেন? কারণ সরকারে আসা ইস্তক প্রধানমন্ত্রী কেবল মিথ্যে বলেছেন, অর্থনীতি ডুবছে, বেকারত্ব বাড়ছে, মূল্যবৃদ্ধির রকেট গতি, সব মিলিয়ে এক বিরাট অ্যান্টি ইনকমব্যান্সির সামনে মোদি সরকার। কিন্তু হঠাৎই পুলওয়ামা ঘটল, ৪০ জন শহিদের চিতা জ্বলছে, আর সামনে ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে বলছেন মোদিজি। এরপর বালাকোট, এর আগেও বহু সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছে, কিন্তু এবারের স্ট্রাইক প্রকাশ্যে আনলেন মোদিজি, আবার কংগ্রেসের ভুল, রাহুল গান্ধী প্রমাণ চাইলেন। ওরকম এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদ আর উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ারে ভাসতে থাকা মানুষের সামনে যুক্তির কথা বললেন, মোদিজি আঙুল তুলে বললেন আমরা ঘরে গিয়ে মেরে আসছি, আর কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা প্রশ্ন করছেন? সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে, সেনাবাহিনীর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। ব্যস, এরপর ধুয়ে গিয়েছিল যাবতীয় অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের কথা মানুষ সরিয়ে রাখলেন পাশে, দেশপ্রেম আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদের এক গরম ককটেলে বুঁদ দেশের মানুষজন এবং সেই ককটেল সার্ভ করছিল কেবল বিজেপি, তাও তো নয়। দেশের প্রত্যেকটা বড় টিভি চ্যানেলে জ্বলছে চিতা, সামনে মোদিজি। রাজ্যে রাজ্যে মোদিজির প্রচার, কোথাও ৮, কোথাও ১০ কোথাও ১৮ শতাংশ ভোট বাড়ল। স্লোগান মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। 

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ (Fourth Pillar) | কর্নাটক- বিজেপি জিতছে? কংগ্রেস হারছে?     

ওই পুলওয়ামা না ঘটলে যাঁকে আমেদাবাদে ফিরে যেতে হত, তাঁর নামে স্লোগান উঠল, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। এ রাজ্যে সেই পুলওয়ামার ফসল ১৮ জন বিজেপির সাংসদ। যে পুলওয়ামার কঙ্কাল আজ সবার সামনে, সতপাল মালিক সেই সত্যিগুলো আবার হাজির করেছেন। কাদের ব্যর্থতার জন্য সেদিন ৪০ জন জওয়ান প্রাণ হারিয়েছিলেন? তাকে ব্যর্থতা বলব নাকি অপদার্থতা? কেন জওয়ানদের প্লেনে করে শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়া হল না? কেন তাঁদের অরক্ষিত জায়গা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল? কেন আরডিএক্স বোঝাই এক গাড়িকে ধরাই গেল না বিস্ফোরণের আগে? কেন সতপাল মালিককে বলা হল চুপ থাকতে? অসংখ্য কেন, কিন্তু মোদিজি সময় বুঝে মৌনিবাবা। কাজেই ওই মোদিজির নির্বাচন হলে, লোকসভার নির্বাচন হলেই বিজেপির ভোট বেড়ে যাবে, এটা একটা মিথ, এটাও তেমনই একটা মিথ যে এক রাজ্যের নির্বাচন অন্য রাজ্যে কোনও প্রভাব ফেলবে না। কেন ফেলবে না? রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস কর্মীরা বাড়তি অক্সিজেন পেলেন না? রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি বিরোধীরা খবর পেলেন না যে মোদিজিকেও হারানো যায়? রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি দলের মধ্যেই বিদ্রোহীরা উৎসাহ পেলেন না? এই যে গলা ফাটিয়ে জয় শ্রীরাম বা জয় বজরংবলীর জয় বলে সাম্প্রদায়িক তাসটা ফেলার পরেও বিজেপির এই হাল, তা কি অন্য রাজ্যে কোনও প্রভাব ফেলবে না? কর্নাটক জুড়ে যে সাহিত্যিক, লেখক, গায়ক, অভিনেতা, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী বা সমাজকর্মীদের জোট হয়েছিল, যাঁরা সারা রাজ্য জুড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন সেই সিভিল সোসাইটি মুভমেন্টের কোনও প্রভাব সারা দেশে পড়বে না? তাই কি হয় নাকি? আর তা যদি হয় তাহলে এই ফলাফলের পরে বিজেপির সংখ্যাগুরুবাদের উল্টা গিনতি চালু। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নরেন্দ্র মোদি কি ক্লান্ত? 

প্রথম উল্টা গিনতি তো আমরা গণনার দিনেই দেখেছিলাম, এ বাংলায় চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করনেওয়ালাদের চ্যানেল বেলা বারোটায় মেট্রোরেলের নতুন বগি দেখাচ্ছিল, কর্নাটকের ঝাড় হজম হচ্ছিল না। অর্ণব গোস্বামী থেকে নবিকা কুমারদের দলের গলার সুর শুনলেই বোঝা যাবে উল্টা গিনতি চালু আছে। এই ফলাফলের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই যে বিরোধীদের খবর এই গোদি মিডিয়া ব্ল্যাক আউট করত, দেখাতো না, তারা দেখাবে, দেখাতে বাধ্য হবে। মিডিয়া, প্রশাসনের চেহারা বদলাতে বাধ্য। এবং ওই ছুপা বিজেপি আর কুনকি হাতির দল এক তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন, তা হল বিজেপির ভোট তো বিরাট কিছু কমেনি, গতবারে ছিল ৩৬ শতাংশ, এবারেও এক্কেবারে ওই ৩৬ শতাংশ। তার মানে কোথাও কোনও অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি ছিল না, আসলে জনতা দল সেকুলারের ভোট কংগ্রেসে গেছে, তাই কংগ্রেস জিতেছে। বিজেপির ভোট শতাংশ এক থাকার আসল কারণটা কী? আসল কারণ হল কর্নাটকের প্রত্যেক এলাকা একভাবে ভোট দেয়নি, কর্নাটকের ছ’টা ভৌগোলিক রাজনৈতিক ম্যাপের মধ্যে এমনকী কোস্টাল কর্নাটক, মহারাষ্ট্র কর্নাটক, হায়দরাবাদ কর্নাটক আর মধ্য কর্নাটকে বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় ৫ শতাংশের বেশি। মানে এই অংশে বিজেপির গড় ভোট আপাতত ৩১ শতাংশের কিছু কম। কিন্তু গ্রেটার বেঙ্গালুরু, যেখানে ২৮টা আসন আছে, সেখানে বিজেপির আসন বেড়েছে, আগের বারের ১৩ এবারে ১৫, কংগ্রেস আগের নির্বাচনে ১৫টা আসন জিতেছিল, এবার ১৩টা আসন জিতেছে। বিজেপির মোট ভোট এখানে বেড়েছে ৩.৪ শতাংশ আর ওল্ড মাইসুরুতে আরেক খেলা হয়েছে। এখানে বিজেপির ভোট বেড়েছে অনেকটাই। ভোক্কালিগাদের ভোটের এক অংশ তারা পেয়েছে, কিন্তু কংগ্রেস দলিত, ওবিসি, ভোক্কালিগাদের ভালো সমর্থন তো পেয়েছেই, এর ওপরে জনতা দল সেকুলারের কাছে থাকা মুসলমান ভোটও এবার কংগ্রেসের ঝোলাতে গেছে। ফলে জেডিএস-এর ভোট শতাংশ ৮ শতাংশের মতো কমেছে। বিজেপির অনেকটা ২ শতাংশের মতো বেড়েছে, কংগ্রেসেরও ৬ শতাংশের মতো বেড়েছে। চার অঞ্চলে বিজেপি যতটা কমেছিল, এই দুই অঞ্চল এ বেড়ে ওঠা ভোট দিয়ে তার ভরপাই হয়েছে। কাজেই রাজ্যের মানুষ সরকারের কাজে খুশি ছিল, এরকম অবান্তর কথা বলার জায়গা নেই। 

কিন্তু এরপরেও একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায় যে বেঙ্গালুরুতে ভোট বাড়ল কেন? সেটা কি ওই যে মোদিজির ২৬ কিলোমিটার পদযাত্রার কারণে? না, তাও নয়। কর্নাটকের ৫টা দরিদ্রতম জেলার সমীক্ষা বলছে, এখানে কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ২.৯ শতাংশ আর বিজেপির ভোট কমেছে ৩.৫ শতাংশ। ইন্ডিয়া টুডে মাই আক্সিস পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের কমবেশি ২০ শতাংশ মানুষ যাঁরা ৩০ হাজারের বেশি রোজগার করেন তাঁদের ৪১ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, ৩৩ শতাংশ কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা রোজগার করেন সেই মানুষজনের ৪০ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, ৩৮ শতাংশ কংগ্রেসকে। মানুষজন যাঁরা ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা রোজগার করেন তাঁদের ৩৪ শতাংশ বিজেপিকে দিয়েছেন, ৪০ শতাংশ কংগ্রেসকে। আর ১০ হাজার টাকার তলায় যাদের রোজগার তাঁদের ৪৪ শতাংশ ভোট গেছে কংগ্রেসের দিকে, মাত্র ৩৩ শতাংশ ভোট গেছে বিজেপির দিকে। এরপরে মাথায় রাখুন ২০ হাজার বা তার ওপরে রোজগার যাঁরা করেন, তাঁরা কর্নাটকের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ, ৮০ শতাংশ মানুষ কিন্তু ২০ হাজার টাকার কম রোজগার করেন। ইয়েস, এটাই মুড অফ দ্য নেশন। আগেও বলেছি, আবার বলছি। এই কর্নাটকের নির্বাচনে বিজেপি তীব্রতম সাম্প্রদায়িক প্রচার নিয়ে মাঠে নেমেছিল। নরেন্দ্র মোদি নিজে জনসভায় গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন বজরংবলী কি জয় বলে, বজরং দল থেকে যোগী আদিত্যনাথ সেই বিষ ছড়িয়েছেন সর্বত্র। তারপরেও যদি এই কড়া ডোজের হিন্দুত্বের বদলে মানুষের কাছে গ্যাস সিলিন্ডার আর মূল্যবৃদ্ধিই বড় হয়, তাদের কাছে বেকারত্বই যদি ইস্যু হয়ে ওঠে, তাহলে বিজেপির আগামী প্রচার পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। বিজেপি বিরোধীরাও এই শিক্ষা পেলেন। কড়া হিন্দুত্বের বদলে হালকা হিন্দুত্ব নয়, মানুষের রোজকার জীবনের সমস্যার কথাই হয়ে উঠতে পারে নির্বাচনী ইস্যু। হ্যাঁ, কর্নাটকে বিজেপি হেরেছে, জয় শ্রীরাম বা জয় বজরংবলীর বদলে ২০২৪-এ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের মতো আসল সমস্যাই নির্বাচনের ইস্যু হয়ে উঠবে, তাই আবার বলছি বিজেপির উল্টা গিনতি চালু।

RELATED ARTICLES

Most Popular