নয়াদিল্লি: প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি জেলবন্দি মানিক ভট্টাচার্যের প্রাথমিকে নিয়োগ কেলেঙ্কারির মাথা বলে সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দিল। ২৮ পাতার ওই দীর্ঘ রিপোর্টে এই কেলেঙ্কারির জন্য মূলত মানিককেই দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে মানিকের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। পর্ষদের অ্যাডহক কমিটির অন্য সদস্যরা তাঁর কথামতোই চলতে বাধ্য হতেন বলে সিবিআই ওই রিপোর্টে দাবি করেছে। বুধবার শীর্ষ আদালতে পেশ করা সিবিআইয়ের রিপোর্টে ছত্রে ছত্রে মানিকের অপকীর্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। পর্ষদের একাধিক কর্তার বক্তব্য উল্লেখ করে সিবিআইয়ের দাবি, মানিকের কথাতেই তাঁরা অনেক অনিয়মও মেনে নিয়েছেন।
রিপোর্টে কী কী আছে ?
বুধবার শীর্ষ আদালতে স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ সি ও গ্রু ডি নিয়োগ দুর্নীতির মামলার শুনানি ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদও এদিন হলফনামা পেশ করেছে। পাশাপাশি সিবিআইও আদালতে তাদের তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এই দুর্নীতির তদন্তে মানিক ভট্টাচার্য বরাবর অসহযোগিতা করে আসছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক দেখা গিয়েছে। শুধু তাই নয়, মানিকের বক্তব্যে প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে। এই কারণেই তাঁকে হেফাজতে রেখে আরও জেরার প্রয়োজন, যাতে এই ষড়যন্ত্রের গোটা শৃঙ্খল ধরা পড়ে। একইসঙ্গে প্রাথমিকে সমস্ত বেআইনি নিয়োগের পিছনে মানিকেরই হাত রয়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি।
২০১৪ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী টেট পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর। ১২ লক্ষ ৯০ হাজার ৬১৫ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ফলাফল প্রকাশ হয় ২০১৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। অভিযোগ ওঠে, ওই পরীক্ষার পর নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। যোগ্যদের বদলে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। সেই অভিযোগেই হাইকোর্টে মামলা হয়। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের নির্দেশে অনেক অযোগ্য প্রার্থীর চাকরি বাতিল হয়ে যায়। এইরকমই কিছু চাকরিহারা প্রার্থী হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। সেই মামলারও শুনানি চলছে।
২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সাল থেকে মানিক প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করে বসেছিলেন ২০২২ সাল পর্যন্ত। গত বছর কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মানিককে পর্ষদ সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়। গত বছরই তিনি সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন। সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা রিপোর্টে সিবিআইয়ের পর্যবেক্ষণ রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে দফায় দফায় আইন সংশোধন করে পর্ষদ সভাপতি হিসেবে মানিকের কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানো হয়। বাড়ানো হয় বয়স সীমাও। এর ফলে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়েও নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে বলে মনে করছে আইনি মহল।
মূলত যে ২৭০ জনের বেআইনিভাবে চাকরি পাওয়া নিয়ে আইনি জটিলতার সূত্রপাত, তার পিছনেও মানিকের হাত রয়েছে সিবিআই তদন্তে জানা গিয়েছে। ২০১৪ সালের ওই টেট পরীক্ষায় কিছু প্রশ্নের ভুল ছিল। সেই ভুল প্রশ্নে ১ নম্বর করে বাড়তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পর্ষদ। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্ষদের বৈঠকে এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সিবিআইয়ের রিপোর্ট বলছে, ওই বৈঠকে জানানো হয়, ২৭০ জনকে বাড়তি ১ নম্বর করে দেওয়ার ব্য়াপারে স্কুল শিক্ষা দফতরের অনুমোদন মিলেছে। সেই ২৭০ জনের জেলাভিত্তিক তালিকাও সিবিআই রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে। সেটি হল- আলিপুরদুয়ার (১), বাঁকুড়া (১১), কোচবিহার (৩১), বর্ধমান (১৭), হাওড়া (১২), হুগলি (৬৯), কলকাতা (১৪), পূর্ব মেদিনীপুর (৩০), দক্ষিণ ২৪ পরগনা (৩৯), উত্তর দিনাজপুর (৪০)।
সিবিআই রিপোর্ট বলছে, পর্ষদের তৎকালীন সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচীকে মানিক ভট্টাচার্য ওই ২৭০ জনের ফরওয়ার্ডিং চিঠিতে সই করার নির্দেশ দেন। সিবিআই রত্নাকেও দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করে। সিবিআইয়ের তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, পর্ষদের অ্যাডহক কমিটির অন্য সদস্যরা অধিকাংশ সময়ই কোনও সিদ্ধান্ত জানতে পারতেন না। বিভিন্ন বৈঠকে তাঁদের যান্ত্রিকভাবে সম্মতি দিতে হত। এমনকী বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে ওএমআর শিট নষ্ট করার সিদ্ধান্তও মানিকের একারই বলে পর্ষদ কর্তারা সিবিআইকে জানিয়েছে। সিবিআই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, টেট পরীক্ষায় তিন-চার নম্বর পাওয়া প্রার্থীদেরও উত্তীর্ণ বলে দেখানো হয়েছে মানিকেরই নির্দেশে। এ সবের জন্যই সিবিআই প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে কিংপিন বা মাথা বলে সাব্যস্ত করেছে।