কলকাতা: ৭৫ বছর আগের একটি দিন। দিল্লির বিড়লা ভবনে প্রার্থনাসভা। লাঠি হাতে নিরস্ত্র এক বৃদ্ধ সেখানে এসেছেন। হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে শোনা গেল গুলির আওয়াজ। মুমূর্ষু ওই বৃদ্ধের মুখ থেকে শুধু বেরিয়ে এল একটাই শব্দ ‘হে রাম’। আততায়ী তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে মূল ফটকের দিকে। হাতে তার পিস্তল। সেই পিস্তলে আরও গুলি আছে কিনা জানা নেই। তাও প্রাণের ভয় না করে বিড়লা ভবনের এক মালি, নাম তাঁর রঘুনাথ নায়ক (Raghunath Nayak), ঝাঁপিয়ে পড়লেন দীর্ঘকায় আততায়ীর উপর। জাপটে ধরে তাকে পেড়ে ফেললেন। দুজনের মধ্যে চলতে থাকল ঝাপটাঝাপটি। কিন্তু, ছাড়েননি রঘুনাথ। পুলিশ এসে গান্ধী হত্যাকারী (Gandhi Assassination) নাথুরাম গডসেকে (Nathuram Godse) কবজায় না আনা পর্যন্ত তাঁকে বাগে রেখে দিয়েছিলেন অসম সাহসী রঘুনাথ। সেদিন গডসে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী কে? তা হয়তো জানা যেত না। বিনা কারণে গণপ্রহারে প্রাণ দিতে হতো আরও কত জনকে।
রঘুনাথ নায়ক ওড়িশার কেন্দ্রপাড়ার জাগুলাইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। কেউ কেউ বলেন, ৩৭ বছরের নায়ক বাগান পরিচর্যার জন্য খুরপি দিয়ে গডসের মাথায় আঘাত করেছিলেন। আবার কারও মতে, নাথুরামকে জাপটে মাটিতে পেড়ে ফেলেছিলেন তিনি। গান্ধী হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষীও ছিলেন তিনি। তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্য রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ রঘুনাথকে ৫০০ টাকা দিয়ে পুরস্কৃতও করেন। গান্ধীর মৃত্যুর পরেও বিড়লা ভবনে মালি হিসেবেই কাজ করতেন নায়ক। অবসর নেন ১৯৬৮ সালে এবং মৃত্যু হয় ১৯৮৩ সালে। কেউ জানতেও পারেনি, ইনিই ছিলেন গান্ধীহত্যার মূল আততায়ীকে বমাল কবজা করার একমাত্র সাহসী যুবক।
তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৩৩ বছর পর গত ২০১৬ সালে ওড়িশা সরকার রঘুনাথের স্ত্রীকে মরণোত্তর সম্মান দেয়। ৮৫ বর্ষীয়া মন্দোদরী নায়কের হাতে ৫ লক্ষ টাকার একটি চেক তুলে দিয়ে সম্মান জানানো হয় নায়ককে। তবে এখনও তাঁর গ্রামে নায়কই হলেন বাস্তবের নায়ক। তাঁর ভিটের কাছেই রঘুনাথের স্মৃতিতে রয়েছে একটি স্মারক।
আজ সেই দিন যেদিন স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী-হত্যা হয়েছিল। ধর্মান্ধতার বশে জাতির জনককে হত্যা করেছিলেন গডসে। অনেকের মতে, দেশভাগের কারণে গডসে হত্যা করেছিলেন গান্ধীকে। যদিও সেই তত্ত্ব অগ্রাহ্য করেন অনেকে। বাস্তব হল, গান্ধী হত্যার আগে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে নাথুরাম আরও একবার হত্যার চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে। গান্ধীর দিকে ছুরি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার তাঁকে অন্যরা ধরে ফেলায় সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
অথচ সেবার গডসে ছাড় পেয়েছিলেন মহাত্মার কারণেই। কারণ গান্ধীর আদর্শ ছিল তিনি কোনও অপরাধের অভিযোগ করবেন না। যার ফলে ১৯৪৪ সালে ছাড়া পেয়ে যান নাথুরাম। এখনও গান্ধীকে অনেকে দেশভাগের জন্য দায়ী করলেও সত্য হল সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হলেন কংগ্রেসের সেই নেতা, যিনি ১৯৪৬ সালে দেশভাগের পক্ষে মতপ্রকাশ করেছিলেন। গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু যে মত মেনে নিয়েছিলেন ‘৪৭ সালের মাঝামাঝি।
প্রতিবছর গান্ধীর প্রয়াণ দিবসকে শ্রদ্ধায়-মননে স্মরণ করা হলেও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন রঘুনাথের মতো গডসেকে ধরিয়ে দেওয়া সামান্য একজন মালি। মহাত্মার সঙ্গে নাথুরামের নাম জড়িয়ে থাকলেও বিড়লা ভবনের মাটির ধুলোয় মিশে গিয়েছে রঘুনাথ নায়কের নাম। সেদিনের প্রকৃত নায়ক ছিলেন যিনি।