কলকাতা: পিতৃপক্ষ অবসানের আগেই দেবীপক্ষের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে এই বাংলায়। যেসব মণ্ডপে আগের বছরেও মহালয়ার দিন বাঁশে পেরেক গাঁথা হয়েছে, সেখানেও এবার ঝকমারি আলোর মশাল জ্বলে উঠেছে। সেদিন থেকেই ‘পদাতিক’ বঙ্গসন্তানরা দুর্গা দর্শনে ‘পথে এবার নামো সাথী…’ মন্ত্রে চরকিপাক খেতে শুরু করেছেন। মহালয়া থেকে কোভিড সংক্রমণের হারে বাড়তে থাকা ‘ঠাকুর দেখা’র জ্বরে আক্রান্ত গোটা শহর পঞ্চমীর সন্ধ্যারাতে মহোৎসবের সব ব্যারিকেড ভেঙে দিল। গনগনে আঁচে ফুটে ওঠা দুধের মতো উথলে পড়ল মহানগরীর ভিড়।
শুধু মহানগর নয়, এবার জেলা জেলাতেও উচ্ছ্বাসে মানুষ আটখানা হয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। রঙিন প্রজাপতি যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে মণ্ডপে। শব্দদানবের তাণ্ডবে মিশে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীর রসালাপ। ভিড়ের ঠেলায় স্পর্শ-রোমাঞ্চের তরঙ্গ জেগে ওঠার আগেই কেঁপে যাচ্ছে নিজস্বীর ছবি। প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগেই জনসমুদ্রে লেগেছে বাঁধভাঙা জোয়ারের ঢেউ।
স্কুল ছুটি পড়ে গেলেও রাজ্য সরকারি অফিসের মতো সব সওদাগরি অফিসের ঝাঁপ এখনও বন্ধ হয়নি। আগামিকাল, শুক্রবার হয়ে বন্ধ হবে। তাই অফিসযাত্রীরা দিনভর নাকাল হচ্ছেন যান-তাড়নায়। পুলিশের শাসনে কোন পথে কোন রুটের বাস যাবে, কারও জানা নেই। ফুটপাত ছাড়িয়ে বাঁশের করিডরে রাস্তার অনেকাংশই অবরুদ্ধ। হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনে যেতে-আসতে গঙ্গাসাগর যাত্রার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন নিত্যযাত্রীরা।
সকলের আগে, ফাঁকায় ফাঁকায় ঠাকুর দেখার এই গণসম্মোহনে আটকে রয়েছেন শহরবাসী। ত্রাহি মধুসূদন দশা ভিআইপি রোডের যাত্রীদের। রাজ্যের মন্ত্রীর পুজোয় গত দিন সাতেক ধরে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে এই রাস্তার যাত্রীদের। পিলপিল করে মানুষ ঢুকছে সরু গলির মধ্যে কল্পিত ডিজনি ল্যান্ড দেখতে। তার সঙ্গে ভিড়ের দৌড়ে পিষে যাওয়ার জোগাড় কচিকাঁচা-প্রবীণদের। শ্রীভূমির পুজোর যানজটের প্রভাব থেকে মুক্ত নয় যশোর রোডেও। একদিকে তেঁতুলতলা ছাড়িয়ে বেলগাছিয়া। অন্যদিকে, নাগেরবাজারে গিয়ে ঠেকেছে গাড়ির লাইন। ফলে দমদম রোডেও ন যযৌ, ন তস্থৌ অবস্থা। বাসে দাঁড়িয়ে গলদঘর্ম হয়ে দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। দুর্ভোগে পড়া অনেকেই বলছেন, পুজো একটা বাহুবলি ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রচার, উৎসবের নেশায় বুঁদ হয়ে কলকাতার রাস্তা এখন জনতার দখলে।
শহরতলির ট্রেনের থেকেও মর্মান্তিক দশা মহানগরের ধমনী মেট্রো রেলের। এত ভিড় হচ্ছে যে, দুপুর ১টা-সওয়া ১টা নাগাদ দমদম স্টেশনে দেখা গেল টিকিট কাটার লাইন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। দু-তিনটে ট্রেন ছেড়ে তবে ওঠার সুযোগ মিলেছে। একই অবস্থা টালিগঞ্জ মেট্রোরও। ১০টার সময় দেখা গেল, টিকিটের লাইন বাইরের সিঁড়িতে এসে ঠেকেছে। অনেক স্টেশনে দরজা বন্ধ হতে দেরি হওয়ায় ট্রেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ বিকেলে জানিয়েছে, ৪টে পর্যন্ত ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার যাত্রী চলাচল করেছেন এদিন।
বিকেল হতেই সব মণ্ডপের আলো জ্বলে ওঠায় রাজকুমারীর বিয়ের রোশনাইয়ে সেজে ওঠে কলকাতা। আলোর বন্যায় ভাসতে থাকে গলি থেকে রাজপথ। কিশোর কুমারের গান থেকে বিসমিল্লার সানাই, শ্রেয়া ঘোষালের গান থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গানের সুরে জনতার কলরব মিশে যাচ্ছে আনন্দোৎসবের সঙ্গতে। সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়াল, ততই বাগবাজার থেকে সুরুচি সঙ্ঘ, শ্রীভূমি থেকে চেতলা অগ্রণী কিংবা একডালিয়া থেকে টালা প্রত্যয়ে মানুষের ভিড়ের গতি চন্দ্রযানকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। মহাপুজোর মহোৎসবে পঞ্চমীর দিন তো ছিল মঞ্চ-মহড়ার নমুনা মাত্র। আসল নাটক তো শুরু হবে কাল, বোধনের দিনে। কারণ বাঙালির হাতে রইল চার…।
অন্য খবর দেখুন: