Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: আরতি, রাজ্য সরকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা

Fourth Pillar: আরতি, রাজ্য সরকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা

Follow Us :

আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের সংবিধান তৈরি হল, এক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। কিন্তু আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় কোথাও সেই ধর্মনিরপেক্ষ কথাটা লেখা ছিল না। বহু পরে ১৯৭৬-এ ৪২তম  সংবিধান সংশোধনী এনে আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ আর সমাজতান্ত্রিক এই দুটো কথা জোড়া হয়। আরএসএস–বিজেপির তরফে বলা হয় যে, আমাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষও ছিল না, সমাজতান্ত্রিকও নয়, ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে এই দুটো শব্দকে আমাদের সংবিধানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, যা ভারতবর্ষের সমাজ বা অর্থনীতির সঙ্গে মেলে না, খাপ খায় না। কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান ওই ৪২তম সংশোধনের আগে কেমন ছিল? আমাদের দেশের সংবিধান প্রণেতারা ওই শব্দদুটো, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটাকে সেই ৪৯ সালেই সংবিধানের ভূমিকাতে, প্রিয়াম্বলে রাখলেন না কেন? আসুন আগে সেটা দেখে নেওয়া যাক। আমাদের দেশের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যই হল সমানতার ধারণা, মার্কসীয় সমাজতন্ত্র নয়, মার্কসের সাম্যবাদের ধারণা নয়, তারও বহু আগে পৃথিবীতে সাম্যের ধারণা এসেছে। সেই ধারণা থেকেই আমাদের সংবিধান রচনা করা হয়েছে। সংবিধানপ্রণেতাদের মাথায় ছিল ঋক বেদ—
সংগচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে ॥
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি ॥
সমানী ব আকূতি সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমস্তু বো মনো যথা বঃ সুসহাসতি ॥  
কী বলছে ঋকবেদ? হে মানব, তোমরা একসঙ্গে চলো, একসঙ্গে মিলিয়া আলোচনা করো, তোমাদের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হউক। পূর্বকালীন জ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছেন তোমরাও সেইরূপ কর। তোমাদের সকলের মত এক হউক, মিলন ভূমি এক হউক, মন এক হউক, সকলের চিত্ত সম্মিলিত হউক, তোমাদের সকলকে আমি একই মন্ত্রে অভিষিক্ত করিয়াছি এবং তোমাদের সকলের খাদ্য ও পানীয় একই প্রকারের দিয়াছি। তোমাদের সকলের লক্ষ্য এক হউক, তোমাদের হৃদয় এক হউক, তোমাদের মন এক হউক। তোমরা সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ হও। এবং এইভাবেই তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক।  
কেউ বলবেন, বলতেই পারেন, বেদে তো চতুর্বণের কথাও আছে। আছে তো, কিন্তু তার ভিত্তিতে আমাদের সংবিধান তৈরি হয়নি। হিন্দু ধর্মের বেদে, ইসলামে, বৌদ্ধ ধর্মে যে সমানতার কথা বলা আছে, সেখান থেকেই সমানতার ধারণা এসেছে আমাদের সংবিধানে। অবশ্যই নেহরুর মতো আধুনিক সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। যার ফলে সংবিধানের প্রত্যেক ছত্রে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, বাসস্থান, আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে সমানতার কথা বলা হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও অধ্যায়ের একটা লাইনেও এই সমানতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে একটা কথাও বলা নেই। অবশ্যই সেই ধর্ম নিরপেক্ষতা পশ্চিমি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা অনুযায়ী তৈরি হয়নি। পশ্চিমি ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম হল ধর্ম থেকে বিযুক্তি, মানে ধর্মকে বাদ রেখে এক রাষ্ট্রের অবতারণা, আর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ধারণা থেকে তৈরি। কারও মনে হতেই পারে পশ্চিমি ধাঁচের সেকুলারিজমই সঠিক, কারও মনে হতেই পারে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রই আসল সমাজতন্ত্র, বাকি সব ইউটোপিয়া। মনে হতেই পারে, তাঁরা সঠিকও হতেই পারেন। কিন্তু আলোচনা হচ্ছে আমাদের সংবিধান নিয়ে, সে সংবিধানের সমানতার ধারণা, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা এমনই ছিল, এমনই আছে, ৪২তম সংবিধান সংশোধনের ফলে তিলমাত্রও বদলায়নি। ৪২তম সংবিধান সংশোধনীতে এই দুটো শব্দ জোড়া ছিল এক কসমেটিক চেঞ্জ। খেয়াল করে দেখুন, জরুরি অবস্থার পরে যখন এই ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর বাকি সব কিছু পরিবর্তন করা হল, তখনও এই দুটো শব্দকে বাদ দেওয়া হয়নি। সে সময় সরকারি দলেই ছিলেন, মন্ত্রীও ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি। আগামিকাল, ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবস, ১৯৪৯-এ সংবিধান সভায় যে সংবিধান স্বীকৃতি পেয়েছিল, সেই সংবিধান ১০৪ বার সংশোধন হওয়ার পরেও তা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমানতার ভিত্তি একচুলও হারায়নি। কিন্তু যেমনটা বলেছি, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা আদতে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে। সেই জন্যই আপনি একজন নাগরিক হিসেবে ইদের ছুটি পান, দুর্গাপুজোর ছুটি পান, বড়দিনের ছুটি পান, গুরুপূর্ণিমার ছুটি বা বুদ্ধজয়ন্তীর ছুটি পান। পুজো উপলক্ষে উৎসব নয়, পুজোর ছুটিই পান, এবং উপভোগ করেন। দেশের প্রত্যেক কারখানা, রেল, ডাক, তার, সরকার, বেসরকারি দফতরে পুজা বোনাস, পুজো অ্যাডভান্স পান, সেই বোনাস বা অ্যাডভান্সের জন্য লড়াইয়ে সামিল হয় এমনকী লাল ঝান্ডা নিয়ে লড়তে থাকা সংগঠনও। মে দিবসে পাড়ায় পাড়ায় নয়, নভেম্বর দিবসে পাড়ায় পাড়ায় নয়, দুর্গাপুজোয়, কালীপুজোয় পাড়ায় পাড়ায় মার্কসীয় বইয়ের স্টল বানিয়ে বসেন কমিউনিস্টরাও, এতে অন্যায়ের তো কিছু নেই। আমাদের দেশে ধর্মবিযুক্ত চিন্তাকে সাকার করা প্রায় অসম্ভব। প্রত্যেক থানায় কালীমূর্তি ছিল এবং আছে, সেনা ছাউনিতে সকালে মঙ্গল আরতি হয়, পূজারী রাখা হয় মাইনে দিয়ে, এসব আজ নয় বহুকাল ধরেই চলে আসছে। ত্রিপুরা বাদই দিলাম, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলায়, কেরলে শাসন ক্ষমতায় ছিলেন বা আছেন কমিউনিস্টরা, ধর্ম উবে যাওয়ার কথা বাদই দিলাম, ধর্মাচরণ বেড়েছে, বাবার মাথায় জল ঢালার সংখ্যা বেড়েছে, লোকনাথ থেকে বিভিন্ন বাবাজি, মাতাজির পুজো কমেনি, বেড়েছে। মসজিদও হয়েছে, আজমের শরিফ বা ফুরফুরা শরিফে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা কমেনি, মাদ্রাসার সংখ্যা কমেনি, জলসা বেড়েছে, আগে যত টিকি, দাড়ি, ফেজ, শনি মন্দির ছিল, তার সংখ্যা কমেনি, বেড়েছে। হাইকোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও শবরীমালা মহিলাদের প্রবেশের ব্যবস্থা করেনি কেরল সরকার। এবং এটা আর কিছু প্রমাণ করুক বা না করুক, এটা বলে দেয়, ধর্ম আর ধর্মীয় উৎসবকে বাদ দিয়ে আমাদের সমাজ, দেশ চলে না। আর ঠিক এই জায়গাটাকেই কাজে লাগাতে চায় আরএসএস–বিজেপি। তারা বেছে নিয়েছে গরিষ্ঠাংশের ধর্ম, আরও ঠিক করে বললে তারা এক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বোঝাতে পেরেছে, আপনা এক ব্রাকেটের মধ্যে হিন্দু। অনার্য দেবতাদের পুজো করে আসা, বেদ সভ্যতায় অচ্ছুৎ আদিবাসী বা নিম্নবর্ণকেও বুঝিয়েছে আপনি হিন্দু, মাংসাশী থেকে নিরামিষভোজী, শাক্ত থেকে শৈব বা বৈষ্ণবকে বুঝিয়েছে আপনারা হিদু, হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া কবীর, নানক, মতুয়াপন্থীদেরও বোঝাতে চায় যে তারাও হিন্দু। এবং সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সোনার পাথরবাটি হিন্দুদের ওপর ভিত্তি করেই এক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। একটা সময় ছিল যখন এসব প্রশ্ন ছিল না, আজ যারা ৪০-৪৫-৫০ এর কোঠায়, তারা ছোটবেলায় এই সনাতন হিন্দু, মুসলমান, সংখ্যালঘু ইত্যাদি খেয়াল করেনি, পাত্তাও দেয়নি। ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে এসেও ইসমাইল চাচার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, কারণ সে সময়ে মানুষ জেনেছিল কাজিয়া করে, দাঙ্গা করে কিছু বদ লোক, হিন্দু নয়, মুসলমান নয়। দাঙ্গা হত, কাজিয়া হত, কিন্তু মিটেও যেত। এখন যা মনের গভীরে গিয়ে বাসা বেঁধেছে, এক প্রোমোটার সটান বলে দিচ্ছেন, আমি মুসলমানদের বাড়ি বিক্রি করি না, এক বাড়িওলা বলে দিচ্ছেন মুসলমান হলে বাড়ি ভাড়া দেব না। এক অলৌকিক মন্ত্রবলে মানুষ আবার ভেদাভেদ ভুলে যাবে? রাষ্ট্র ধর্মবিযুক্ত হবে? হবে না তো? তাহলে এই মধ্যের সময়ে আপনি কী করবেন? যে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, গর্বের সঙ্গে বলো আমি হিন্দু, সেই বিবেকানন্দই ধর্মীয় গোঁড়ামি আর বজ্জাতির বিরুদ্ধে যে কথা বলেছিলেন, সেই কথাগুলো বলবেন না? ধর্মীয় অনুসঙ্গতেই বেড়ে ওঠা কবীরের কথা বলবেন না? নানক, চৈতন্যের কথা বলবেন না? কেন এতগুলো কথা বলা? প্রেক্ষিত হল, রাজ্য সরকার বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন, বেনারসের মতো আমাদের গঙ্গার ঘাটেও সান্ধ্য আরতি হোক, দুর্ঘটনা এড়িয়ে তা কোন জায়গায় করা সম্ভব তা খুঁজে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন মহানাগরিক ববি হাকিমকে। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কোলাহল, ধর্মনিরপেক্ষতায় আঘাত, এনারাই ফুরফুরা শরিফের মাথাদের সঙ্গে দেখা করেন নির্বাচনের আগে, জলসায় বকওয়াস করা এক বাতেলাবাজকে গলায় জড়িয়ে মুসলমান ভোটের সওদা করেন। কিন্তু সংখ্যাগুরুর ধর্মাচরণে এনাদের অনীহা, যে অনীহাকে কাজে লাগিয়েছে আরএসএস–বিজেপি। আচ্ছা বলুন তো কোন বাঙালি বেনারসে গিয়ে গঙ্গার ঘাটে সান্ধ্য আরতি না দেখে ফিরে আসেন? আমাদের এখানে সেরকমটা হলে ক্ষতি কোথায়? যারা কলকাতা বেড়াতে আসবেন, তাঁদের ইচ্ছে হলে ভিক্টোরিয়ায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখবেন, না হলে গঙ্গাঘাটে সন্ধ্যা আরতি। এতে ক্ষতি কতটা আমি জানি না, তবে লাভ তো আছেই, ক’দিন পরে টাচ মি নট খোকাবাবু বা দিলীপ ঘোষ এই সন্ধ্যারতি আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরও কিছু ভোট নিয়ে যেতেন তাঁদের ঘরে, সেই ভোট গেল না। আসলে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা, যা আমাদের মনীষীরা বহুযুগ ধরেই বলে এসেছেন, তা কিন্তু বিজেপি আরএসএস-এর লক্ষ্য নয়, বরং সেই ধারণা তাদের আদর্শ বিরোধী, তারা হিন্দু ধর্মের, কেবল হিন্দু ধর্মের কথাই বলেন, তার বিরোধিতায় সর্বধর্মসমন্বয়ের কথাই এই সময়ের দাবি। যদি কোনওদিন ধর্ম বিযুক্ত এক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, তা হবে এক আইডিয়াল স্টেট, কাম্য রাষ্ট্র, কিন্তু তার আগে মধ্যযুগীয় হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে সর্বধর্ম সমন্বয়ের পথেই চলতে হবে। রেড রোডে বিসর্জনের কার্নিভাল, গঙ্গাঘাটে সান্ধ্য আরতি, রেড রোডে নামাজ বা গুরুদ্বারে পংক্তি ভোজনে শামিল হতে হবেই রাষ্ট্রকে, না হলে তা ব্যবহার করবে আরএসএস–বিজেপি। আপনাদের মতামত জানান।  

RELATED ARTICLES

Most Popular