গতবছর বিজেপি এক প্রচার নিয়ে মাঠে নেমেছিল, মোদিজি এখানে কার্টুন ক্যারেক্টার, খানিক সুপারম্যান গোছের। সামনে প্রত্যেক বাধা টপকে তিনি এগিয়ে চলেছেন ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমির দিকে, রাস্তায় বাধা দেওয়ার জন্য কোথাও রাহুল, কোথাও সোনিয়া, কোথাও বিবিসি ওনাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে, উনি এগিয়ে যাচ্ছেন বীরদর্পে। কার্টুন ভিডিওর শেষে মোদিজি চলছেন ৫ ট্রিলিয়ন ইকোনমির দিকে, গান বাজছে, মুসাফির হু ইয়ারো, না ঘর হ্যায়, না ঠিকানা, মুঝে চলতে জানা হ্যায়, ব্যস চলতে জানা। ‘পরিচয়’ ছবিতে জিতেন্দ্র ঘোড়ার গাড়িতে করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন, এখানে নরেন্দ্র মোদিও চলছেন। কারও কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না, উনি অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক, যখন উনি চাইবেন তখন উনি কথা বলবেন, উনি না চাইলে কথা বলবেন না। অন্য কারও মন কি বাত শোনার ধৈর্য ওনার নেই, শোনার প্রশ্নও নেই, কেবল উনি বলে যাবেন, ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন। ওনাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সংসদে, সংসদের বাইরে, উনি সংসদের ভিতরে বা বাইরে কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়ার তাগিদ বোধ করছেন না। উনি এক সুপারম্যান যিনি চলেছেন নিজের তৈরি লক্ষ্যের দিকে। তাঁকে যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে, সংসদের বাইরে বা ভিতরে যে প্রশ্ন তাঁর দিকে এসেছে, সেগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক।
১) আদানির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? আচ্ছা কেন এই প্রশ্ন উঠছে? উঠছে কারণ দেশের সবথেকে বড় ধনী মানুষটি মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যে ৫৫-৬০ শতাংশ সম্পদ খুইয়েছিলেন, আবার ফিরে পেয়েছেন, আবার খোয়া যেতেই পারে। এবং এই সম্পদ তো কেবল ওনার একার নয়, উনি নিজের বাপকেলে সম্পত্তি বেচে টাকা ঢেলেছিলেন, এখন ওনার নির্বুদ্ধিতার জন্য সেই ব্যবসায় লস হচ্ছে, এটা যদি হত, তাহলে আমরা বড়জোর আহা উহু করতাম। কিন্তু তা তো নয়, উনি দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়েছেন, এক আধ টাকা নয়, লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র বছর বারো চোদ্দর মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ এবং তার পিছনে কারণটা কী? দেখা যাচ্ছে দেশের চৌকিদার কাম চায়ওয়ালা কাম ফকির কাম মুসাফির নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আচ্ছা ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ? ২০১৪ নির্বাচনের আগে এই আদানির ব্যক্তিগত বিমানে চেপেই তিনি প্রচারে বেরিয়েছেন, এবং সাতসকালে নির্বাচনী বিভিন্ন প্রচারে বেরিয়ে রাতে ফিরে গেছেন আমেদাবাদে। ফলাফল ঘোষণা হয়েছে, উনি ওই আদানির বিমানে চেপেই দিল্লি এসেছেন, সেখান থেকে সটান সংসদে। এরপর রিটার্ন গিফট। মোদিজি গেছেন অস্ট্রেলিয়ায়, আদানি অস্ট্রেলিয়া কোল মাইনস-এর বরাত পেয়েছেন, মোদিজি গেছেন শ্রীলঙ্কা, বন্দরের বরাত পেয়েছেন আদানি, মোদিজি গেছেন বাংলাদেশে, আদানি পেয়েছেন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বরাত। দেশের মধ্যে একের পর এক বন্দর, একের পর এক এয়ারপোর্টের দায়িত্ব পেয়েছেন, নামকরা জিভিকে কোম্পানির হাতে ছিল নভি মুম্বাই এয়ারপোর্টের দায়িত্ব, তাদের কাছ থেকে সেই দায়িত্ব কেন জানা নেই এসেছে আদানিদের কাছে। তো সেই আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে শুরু করল, আন্তর্জাতিক এক শর্ট সেলার হিন্ডেনবার্গ-এর রিপোর্টে বলা হল আদানি কোম্পানিতে বহু কেলেঙ্কারি আছে। কেলেঙ্কারি নাম্বার এক, তাদের শেয়ার ইনফ্লেটেড, মানে ফোলানো ফাঁপানো, এই শেয়ারের আসল দাম অনেক অনেক কম।
ঘাপলা নাম্বার দুই, কিছু জালি কোম্পানি, যাদের বাজারের পরিভাষায় শেল কোম্পানি বল হয়, তারা আদানিদের ব্যবসায় টাকা ঢেলেছে, যারা মরিসাস বা ওইরকম কিছু জায়গা থেকে তাদের এই কুকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বলার পর থেকেই আদানিদের কঙ্কাল বের হতে শুরু করেছে, তাদের শেয়ারের দাম কমেছে ৫৫–৬০ শতাংশ। এরপরে দ্য মর্নিং কনটেক্সট তাদের রিপোর্টে জানাল, আদানিদের নামেই চলছে এসিসি বা অম্বুজা সিমেন্ট কিন্তু এর আসল মালিকানা আদানি গ্রুপেরই নয়। এর মধ্যেই উঠে এল আদানি লাইফ ইনসিওর্যান্স, যা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে প্রচুর ধার নিয়েছেন, ওনার সম্পদ ডুবে যাওয়া মানে এই লাইফ ইনসিওর্যান্স বা জাতীয় ব্যাঙ্কের টাকাও একই ভাবে ডোবা। এবং প্রশ্নটা সেখানেই, দেশের মানুষের হার্ড আর্নড মানি, যা নাকি মানুষের সুরক্ষার জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক বা সরকারি ব্যাঙ্ক বা এলআইসি-তে রাখা আছে, কার জন্য সে টাকা ভোগে যাবে? কার দায়? মোদিজিকে সেটাই প্রশ্ন করেছেন বিরোধীরা, সংসদের ভিতরে এবং বাইরে। আচ্ছা এমনটাও তো বলা হয়নি যে গৌতম আদানিকে ধরে জেলে পুরে দাও। বলা হয়েছে তদন্ত হোক, দেশের প্রত্যেকটা বিরোধী দল এই তদন্ত চাইছে, মোদিজি জওহরলাল নেহরু কী কী করেননি, ইন্দিরা গান্ধী কতটা স্বৈরতান্ত্রিক ছিলেন, দেশ কীভাবে প্রগতি কে পথ পর, সব কা সাথ, সবকা বিকাশ ইত্যাদি বলেই যাচ্ছেন। এবং এই আবহেই বেরিয়ে এল আরেক কেলেঙ্কারির কথা, দ্য হিন্দুতে ছাপা হল সেই সেই রিপোর্ট যা বলছে, আমাদের দেশের শ্রমিকদের রক্ত ঘামও বেচে দেওয়া হয়েছে আদানিদের কাছে। আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মচারী ভবিষ্যৎ নিধির তহবিল থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটাকে ইপিএফ বলা হয়, এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ড ফান্ড। ২৭ কোটিরও বেশি সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারীদের প্রাপ্য টাকার এক অংশ এই ফান্ডে রাখা হয়, সরকারও সমপরিমাণ টাকা সেখানে রাখে, এবং এই ইপিএফ-এর টাকা কর্মচারীরা রিটায়ার করার পরে পেয়ে থাকেন। আগে এই টাকা সরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা হত, এতে করে এই টাকা সুদে খানিক বাড়ত কিন্তু সুরক্ষিত থাকত। এখন সেই টাকা আদানির ব্যবসায়ে খাটছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar ।| এবারে কি মহুয়া মৈত্রকে জেলে পোরা হবে?
একটা মজার ব্যাপার দেখুন, বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড আছে, যারা পাওনার টাকা ইনভেস্ট করে আপনাকে সাধারণ সুদের হারের থেকে অনেকটাই বেশি টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি করছে, অনেকে দিচ্ছেও। যারা দিচ্ছে সেই সব কোম্পানিগুলোর ফান্ড ম্যানেজমেন্ট, মানে আপনার টাকা তারা কোথায় কোথায় ইনভেস্ট করছে তার লিস্টটা দেখুন। কোনও ভালো মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানি তাদের টাকা কিন্তু আদানির কোনও কোম্পানিতে ঢালছে না। কেন? কারণ এই মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানিগুলো আদানিদের প্রকৃত চেহারাটা জানে, জানে বলেই সেখানে টাকা রেখে নিজেদের গুডউইল নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু দেশের সরকার? দেশের সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে কি এই খবর নেই? তারা কেন আদানির বিভিন্ন কোম্পানিতে টাকা ঢালছে? কার নির্দেশে ঢালছে? কিসের বিনিময়ে ঢালছে? এই প্রশ্ন তো উঠবেই, যিনি বলেছিলেন আমি আপনাদের, দেশের মানুষের সম্পদের, দেশের সম্পদের চৌকিদার, না কিসি কো খানে দুঙ্গা, না খাউঙ্গা। কিন্তু এই বাওয়ালি দেওয়ার পরে কার্যক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা তো ঠিক উলটো। কেন?
ইপিএফ-এর ১৫ শতাংশ টাকা, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড-এ বিনিয়োগ করা হয়েছে, যেখান থেকে টাকা গেছে এনএসি–নিফটি ফিফটি কোম্পানিতে। তো এই ৫০ জনের তালিকায় আগে আদানির কোম্পানি ছিল না। ২০১৫ থেকে এই তালিকায় ঢুকে পড়েছে আদানি এসইজেড অ্যান্ড পোর্ট। ২০২২ এর মার্চ অবধি ১.৫৭ লক্ষ কোটি টাকা এই এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড-এ বিনিয়োগ হয়েছে, ২২-২৩ আর্থিক বছরে আরও ৩৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবং এই ফান্ডের এক বিরাট টাকা বিনিয়োগ হয়েছে আদানি এসইজেড অ্যান্ড পোর্ট কোম্পানিতে। আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানি, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের মতে এই কোম্পানির শেয়ার ভ্যালুতে জল মেশানো। কতটা জল? ওই রিপোর্ট বলছে ৮৫ শতাংশ। ভাবা যায়? এখনই শেয়ার নেমেছে ৫৫-৬০ শতাংশ। তাহলে? সেই মানুষগুলো যাদের প্রতিদিনের শ্রম বিক্রির কামাই, তাদের ঘাম রক্তের দাম এই ঠগ জোচ্চরদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা কে করল? সিবিআই যাবে না? ইডি যাবে না? দেশের চৌকিদার জবাব দেবে না? আসুন একটা হিসেব দেওয়া যাক— মে ২০১৪, ৫৫০০ কোটি টাকার ধামরা পোর্ট এলঅ্যান্ডটি-র কাছ থেকে কিনে নিল আদানি। ওই মে ২০১৪-তে অবন্তা পাওয়ার থেকে ৪২০০ কোটি টাকার কোবরা ওয়েস্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট কিনে নিল। ২০১৫ এপ্রিলে ল্যাঙ্কো অনফ্রাটেক এর কাছ থেকে ৬৩০০ কোটি টাকার উপুপি পাওয়ার কিনে নিল, রিলায়েন্স ইনফ্রার কাছ থেকে ১০০০ কোটি টাকার WR5S5B and C Transmission কিনে নিল। জুন ২০১৮তে টাটার কাছ থেকে ২০০০ কোটি টাকার কাট্টুপালকি পোর্ট কিনে নিল, অগাস্ট ২০১৮-তে রিলায়েন্স ইনফ্রার কাছ থেকে ১৮৮০০ কোটি টাকা দিয়ে মুম্বই ইন্ট্রিগেটেড পাওয়ার কিনে নিল, আগস্ট ২০১৯-এ ৩৫৩০ কোটি টাকা দিয়ে ছত্তিশগড় এনার্জি কিনেছে, ওই একই সময়ে এসসেল গ্রুপ থেকে ১৩০০ কোটি টাকার সোলার প্রজেক্ট কিনেছে আদানিরা। জানুয়ারি ২০২০-তে সিভিআর গ্রুপ থেকে ১৩৫০০ কোটি টাকা দিয়ে কৃষ্ণপত্তনম পোর্ট কিনেছে, বালাজি ইনফ্রাপ্রোজেক্টস থেকে ৬৫০ কোটি টাকা দিয়ে দিঘি পোর্ট কিনেছে মার্চ ২০২০তে। এইএস কর্পোরেশন থেকে ১০২০ কোটি টাকা দিয়ে ওড়িশা পাওয়ার জেনারেশন কিনেছে, জুন ২০২০তে, জুলাই ২০২০তে আলিপুরদুয়ার ট্রান্সমিশন কিনেছে ১২৮৬ কোটি টাকা দিয়ে কল্পতরু পাওয়ারের কাছ থেকে। জিভিকে গ্রুপ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে মিয়াল অ্যান্ড মিয়াল বিমানবন্দর কিনেছে অগাস্ট ২০২০-তে। মাত্র ২০১৪ থেকে মানে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৭৪ হাজার কোটি টাকার প্রোজেক্ট কিনে নিয়েছে আদানি গ্রুপ।
এটা কী চলছে? একেই কি লুটমার বলে না? এই সেদিনে প্রকাশ্যে জনসমাবেশে, সংসদের মধ্যে নয়, বাইরেই প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কাপুরুষ বললেন, বললেন কারণ এই বিষয়গুলোতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর আশ্চর্যজনক নীরবতা। রাষ্ট্র বড় উদ্যোগপতি, শিল্পপতিদের সাহায্য করবে না? তাদের ব্যবসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পাশে দাঁড়াবে না? এই ব্যবস্থায় নিশ্চয়ই দাঁড়াবে। এমনকী চীনও তাদের নির্দিষ্ট কিছু শিল্পপতির পাশে দাঁড়াচ্ছে, আমেরিকা বা ইউরোপের রাষ্ট্র ব্যবসায়ী, উদ্যোগপতিদের পাশে থাকে কারণ এই উদ্যোগপতিরা একটা ব্র্যান্ড তৈরি করে, একটা গ্লোবাল ব্র্যান্ড, যেগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়, ব্যবসা আনে, এবং খেয়াল করে দেখুন ইউরোপ, আমেরিকা বা চীনেও এই ব্যবসা পারিবারিক ব্যবসা নয়। ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রথমত টাটা থেকে আম্বানি, আদানি, এই ব্যবসায়ীরা মূলত পারিবারিক ব্যবসা চালান, দ্বিতীয়ত এদের কোনও গ্লোবাল ব্র্যান্ড নেই, টাটার তবু দেশের মধ্যে তাজ হোটেল, বা সদ্য পাওয়া এয়ার ইন্ডিয়া আছে, আম্বানির জিও আছে, কিন্তু আদানির? একটা তাসের প্রাসাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যবসায়ীর জন্য কেন এত সদয় আমাদের ফকির কাম মুসাফির? এতটাই সদয় যে শ্রমিকদের ঘাম রক্তও বেচে দিচ্ছেন তাদের হাতে? কেন? এ প্রশ্নের জবাব চাইছে দেশ।