পুজো শেষ বললেই শেষ হয় নাকি? কিন্তু আমাদের বাংলায় শারদ উৎসব শেষ, সামনে কালীপুজো আছে, উত্তর ভারতে দিওয়ালি। কিন্তু আপাতত সবই ফিকে কারণ ভারত ক্রমশ ঢুকে পড়ছে ইলেকশন আবহে। এখানেও বাজছে বিসর্জনের বাজনা, নির্বাচনে দু’ পক্ষই তো জেতে না, কাউকে না কাউকে তো হারতেই হবে। আর নির্বাচন কমিশনের নিয়ম মেনেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, বিভিন্ন সংস্থা পাঁচ রাজ্যের ওপিনিয়ন পোলের হিসেব জানিয়েছে। বিসর্জনের বাজনা শোনা যাচ্ছে বিজেপির দফতরে, রাজ্যে রাজ্যে। ওপিনিয়ন পোল মেলে? খুব বিজ্ঞানসম্মত? না, মেলে না, আর ওই ছোট্ট স্যাম্পল সাইজ নিয়ে একটা ওপিনিয়ন পোলের কর্তারা শুরুতেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে রাখেন, বলেই দেন যে এই ওপিনিয়ন পোলের হিসেবে প্লাস মাইনাস থ্রি পার্সেন্টের ফারাক ঘটে যেতেই পারে। শোনার পরে হিসেব মিলিয়ে দেখুন, অন্তত রাজস্থান বা তেলঙ্গানা নিয়ে কোনও কথা তো বলাই যাবে না। কিন্তু এইটাও সত্যি যে সবক’টা ওপিনিয়ন পোলের হিসেব মিলিয়ে দেখলে একটা ট্রেন্ড তো বোঝাই যায়। সেই মিলিত ফলাফল বলছে একমাত্র রাজস্থান ছাড়া বিজেপি প্রত্যেকটা রাজ্যেই হারছে। মিজোরামে বিজেপি নেই, এতটাই অস্তিত্বহীন যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারসভায় লোক হবে না বুঝে সেই সভা বাতিল করতে হয়েছে। ওদিকে মূলত খ্রিস্টান অধ্যুষিত মিজোরামে মণিপুরের দাঙ্গার প্রভাব তো পড়েছে, মিজো ন্যাশন্যাল ফ্রন্ট বিজেপিকে সমর্থন দেওয়ার কথা তো বলছেই না, উল্টে এই দাঙ্গার দায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের উপরেই চাপিয়েছে। হিন্দু মেইতেইদের নেতা খ্রিস্টান কুকি উপজাতির মানুষদের উপর অত্যাচার করছে, চার্চ ভেঙেছে ইত্যাদি মিজোরামের ইলেকশন প্রচারে কংগ্রেস এমনকী এমএনএফ-ও প্রচার করছে। সমস্যা বুঝেই এমএনএফ বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। এবং কংগ্রেসের প্রচারে মানুষের সাড়া আর ওপিনিয়ন পোলের ফলাফল দেখলে বোঝাই যায় যে গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি ইজ ব্যাক ইন অ্যাকশন। এক্কেবারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে? সম্ভবত না, কিন্তু নির্বাচনের পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বেই সরকার হবে এটা আপাতত পরিষ্কার। মণিপুরের জাতিদাঙ্গাকে কাজে লাগিয়ে গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল হারাতে হবে জেনেও বিজেপির বাজি ছিল ত্রিপুরা আর অসম। মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল এমনকী সিকিমেও বিজেপি এই দাঙ্গার ফলেই হারবে। কিন্তু এই একই তীব্র মেরুকরণ তাদের কাজে লাগবে ত্রিপুরা, অসম আর মণিপুরে। থাক সে কথা, এবার পরের রাজ্য তেলঙ্গানা।
সবকটা ওপিনিয়ন পোল বলছে বিজেপি কমবেশি ৮-১০খানা আসন পেলেও পেতে পারে। কংগ্রেস আর কেসিআর-এর ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সমিতির মধ্যে কাঁটে কা টক্কর। গত নির্বাচনে ১১৯টা আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ৮টা, বিজেপি ৪টে আর আসাদুদ্দিন ওয়েইসির দল এআইএমআইএম হায়দরাবাদ ঘেঁষা অঞ্চলে ৭টা আসন জিতেছিল। কিন্তু সেই কংগ্রেস এবার এগিয়ে, তারাই সরকার গড়তে পারে এটাই সমীক্ষা বলছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাজ্যের রাজনৈতিক লড়াই ছিল বিজেপি আর টিআরএস, আপাতত যা ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সমিতি, বিআরএস-এর মধ্যে। সেই সময় আমরা বিআরএস-এর নেতা সি চন্দ্রশেখর রাওকে দেখছিলাম বিজেপির বিরুদ্ধে মহাজোট তৈরি করার ডাক দিতে, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করতে, নীতীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু বছর খানেক হল তেলঙ্গানায় কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ক্রমশ তিন নম্বর জায়গা থেকে দু’ নম্বরে এসেছে। কর্নাটকে জয়ের পরে এখন জোর গলায় বলছে আমরা তেলঙ্গানা জিতে যাব। ওদিকে বিজেপি বন্দি সঞ্জয় কুমারকে সরিয়ে আপাতত হাত কামড়াচ্ছে, ডিসট্যান্ট থার্ড হওয়া ছাড়া তাদের গতি নেই। রাজ্য রাজনীতির বাইনারি আপাতত কংগ্রেস আর বিআরএস-এর মধ্যেই আটকে গেছে। এরমধ্যে হায়দরাবাদে হয়ে গিয়েছে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। জনসমাবেশে উপচে পড়েছিল ভিড়, সোনিয়া গান্ধীই সায় দিয়েছিলেন নতুন তেলঙ্গানা রাজ্যের জন্য। মনমোহন সিংয়ের সরকার এই নতুন রাজ্যের ঘোষণা করেছিল, সেসব কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এনিবডিজ গেম ছিল কিছুদিন আগে পর্যন্ত, মানে? কংগ্রেস আর বিআরএস-এর মধ্যেই লড়াই সীমাবদ্ধ ছিল, বিজেপি রেস থেকে ছিটকে পড়েছিল। কিন্তু এখন ক্রমশ চাকা কংগ্রেসের দিকে ঘুরছে। বিআরএস-এর প্লাস পয়েন্ট হল ঢালাও ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি স্কিম, প্রত্যেক শ্রেণির মানুষ কিছু না কিছু পেয়েছে। আর কংগ্রেসের প্লাস পয়েন্ট হল দলের মধ্যে এক নতুন জোয়ার। সব মিলিয়ে কংগ্রেস কিছুটা এগিয়ে এবং কংগ্রেস জিতলে সেটা বিরাট এক খবর হবে। তেলঙ্গানাতে বিজেপির হার নিশ্চিত, যা বিজেপির দক্ষিণের শেষ ভরসার জায়গা ছিল। দেশকে কংগ্রেসমুক্ত করতে গিয়ে আপাতত দাক্ষিণাত্য বিজেপিমুক্ত হয়েই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পরধান সেবক মোদিজী ভয় পেয়েছেন
ছত্তিশগড়, থ্যাঙ্কস টু নরেন্দ্র মোদি, যিনি যত্ন করে দলের প্রত্যেক সিনিয়র নেতাদের একে একে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছেন, সে লালকৃষ্ণ আদবানিই হন কি উমা ভারতী, কি নীতিন গড়করি, কি বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। সেই তালিকাতেই আছেন রমন সিং, কাজেই ছত্তিশগড়ে বিজেপি নির্বাচনের আগেই হেরে বসে আছে, একথা সেখানকার বিজেপি নেতারাও বলছেন। আর ভূপেশ বাঘেল এক অসাধারণ পাঁচ বছর উপহার দিয়েছেন ছত্তিশগড়ের মানুষজনকে। অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি নেই? আছে, কিন্তু বাঘেলের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারকে হারানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। রমন সিং টিকিট পেয়েছেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই, বিজেপির বিরাট বিরাট প্রচার অভিযানে তিনি ব্রাত্য। এখানে অতি বড় বিজেপিও জেতার ক্ষীণ সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছেন না। রাজস্থানের লড়াইটা আলাদা, এই লড়াইয়ের হদিশ ওপিনিয়ন পোলের পণ্ডিতদের দেওয়া সম্ভব নয়, এখানে লড়াই কি কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে? গত পাঁচ বছর ধরে বহু অনুষ্ঠানে গেহলত আর বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে একসঙ্গে দেখা গেছে। দুজনের সম্পর্ক তাঁদের নিজেদের দলের নেতাদের সম্পর্কের চেয়ে অনেক ভালো। কংগ্রেসের অশোক গেহলতের সমস্যা তো তাঁর দলের শচীন পাইলটের সঙ্গে, তিনি মাত্র দেড় বছর আগে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া হতে গিয়ে বুঝেছিলেন পিচ বড্ড কঠিন, এক পা এগিয়ে দিয়েও ফিরে এসেছেন। কংগ্রেসও হাত বাড়িয়ে দিতে ভুল করেনি, রাহুল, সোনিয়া বা খাড়গে সাহেবের হাজার দৌত্যের পরেও কিন্তু ঝগড়া মেটেনি, শচীন সমর্থকরা কিছু আসনে বেগ দেবে গেহলতের প্রার্থীদের। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহের পছন্দের গজেন্দ্র সিং শেখাওয়তের সঙ্গে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার লড়াই। বসুন্ধরা রাজের সমর্থকদের টিকিট না দেওয়া সব নিয়ে বিজেপিও বেশ গোলমালেই আছে। এবং রাজস্থানের এবারের নির্বাচনের হার জিত এই দুই দলের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের ওপর নির্ভর করবে। সকলের নজর আপাতত শচীন পাইলট আর বসুন্ধরা রাজের দিকেই আছে, কোনজন তাঁদের দলকে বেশি ডোবাতে পারবেন। অথচ এটাও সত্যি যে শচীন বিজেপিতে যেতে পারবেন না, বসুন্ধরা রাজে কংগ্রেসে যাবেন না।
রাজস্থানের এই দলের ভেতরের লড়াইয়ের হদিশ কোনও ওপিনিয়ন পোল দিতে পারবে না, নির্বাচন শেষ হলেই একমাত্র তা বোঝা যাবে। কিন্তু এটাও বলে রাখা দরকার যে রাজস্থানে একবার কংগ্রেস, একবার বিজেপির যে বাইনারি গত বেশ কিছু নির্বাচন ধরেই চলে আসছে, সেই বাইনারি মেনেই এবারে বিজেপি জিতছেই, এটা বিজেপি নেতারাও বলতে পারছেন না। মধ্যপ্রদেশে অবশ্য কোনও দোলাচল নেই, প্রত্যেকটা ওপিনিয়ন পোলেই কংগ্রেসকে বেশ কিছুটা আগেই রাখা হয়েছে। মাথায় রাখুন গোটা দেশে গুজরাত নয়, এই মধ্যপ্রদেশই ছিল জনসঙ্ঘের আসলি ডেরা। সেই স্বাধীনতার পর থেকেই এখানে আরএসএস-জনসঙ্ঘ শক্তিশালী। এই রাজ্যও কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব, পরিষ্কার করে বললে মোদি-শাহের জন্যই বিজেপি হারবে। প্রথম ভুল সিদ্ধান্ত হল মামাজি, শিবরাজ সিং চৌহানকে পাত্তা না দেওয়া। একগুচ্ছ বড় নেতা, মন্ত্রী সাংসদকে বিজেপি মাঠে নামিয়েছে, কিন্তু তারা কেউই শিবরাজ সিং চৌহানের মতো সারা রাজ্যে জনপ্রিয় নয়। দ্বিতীয় ভুল সিদ্ধান্ত আবার ওই মোশার, হ্যাঁ, মোদি-শাহের। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে দিয়ে দল ভাঙিয়ে মধ্যপ্রদেশে সরকার তৈরি করা, এখন সিন্ধিয়ার সমর্থকরা টিকিট না পেয়ে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যাচ্ছে। না হলে তাদেরকে টিকিট দেওয়ায় ক্ষুব্ধ বিজেপি নেতারা দল ছাড়ছে। তিনজন কেন্দ্রের মন্ত্রী, তাঁদের মধ্যে একজন, নরেন্দ্র সিং তোমর তো ক্যাবিনেট মন্ত্রী, তাঁকে দাঁড় করানো হল যাতে ভিন্দ, গোয়ালিয়র অঞ্চলে দল ভালো ফল করে। এদিকে গোয়ালিয়র হল জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার জায়গা, তাঁর অনুগামীরা আসনই পায়নি, প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল, মোদি মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, তাঁকে দিল্লি থেকে এনে এমএলএ করার টিকিট দেওয়া হল। যিনি জীবনে কোনও দিন এমএলএ ইলেকশন লড়েননি, সেই উমা ভারতী অনুগামী প্যাটেল তাঁর টুইটারে লিখেছেন, এতবড় দায়িত্ব দেওয়ার জন্য দলকে ধন্যবাদ, বুঝতেই পারছেন, তাঁর মেজাজের পারদ কতটা চড়েছে।
ওদিকে ফাগগুন সিং কুলস্তে, ইনিও মন্ত্রী, বছর সাতেক আগে দল থেকে এঁকে তাড়ানো হয়েছিল, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বিনিময়ে টাকা নিয়েছিলেন বলে। তাঁকে এবার এমএলএ-র টিকিট দেওয়া হয়েছে। কেবল তাঁর এলাকায় নয়, বহু আসনের প্রচারে নতুন করে প্রশ্নপত্র কেলেঙ্কারি, ব্যাপম কেলেঙ্কারি সামনে আসছে। অন্যদিকে দিল্লি থেকে আসা এই বড় নেতাদের নিয়ে আরেক সমস্যা, এঁরা প্রত্যেকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে চান। এঁরা ছাড়া আরও চারজন সাংসদকেও এমএলএ-র টিকিট দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে দলের মধ্যে ঘমাসান লড়াই চলছে। এবং দলের এক সাধারণ সম্পাদক, যাঁকে কিছুদিন আগে বলা হয়েছিল বড় দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা শুনে তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন দল যা কাজ বলবে আমি তাই করব, সেই কৈলাস বিজয়বর্গীকে এমএলএ-র টিকিট দেওয়া হয়েছে, সেটাও আবার তিন বার কংগ্রেসের জেতা আসন। মানে খুব সোজা, বাঘ মারলে মারো, না হলে মরো। এবং আরও একটা জিনিসও অমিত শাহ আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর ছেলেকে টিকিট দেওয়া হবে না। সবমিলিয়ে মধ্যপ্রদেশ জুড়ে দলের মধ্যে বিদ্রোহ, শিবরাজ সিং চৌহানের বিরুদ্ধে চরম অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি, বিজেপির নিজেদের দলীয় সমীক্ষা বলছে ২৩০ এ ১০০ পার করলে হয়। ওদিকে কমলনাথ হিন্দুত্ব আর সেকুলারিজম নিয়ে এক জবরজস্ত কিন্তু ভয়ঙ্কর ককটেল বানিয়েছেন। সারা রাজ্যে পদযাত্রা করেছেন, সিন্ধিয়া সরে যাওয়ায় আর দিগ্বিজয় সিংয়ের রাজ্য রাজনীতিতে আর কোনও শখ না থাকার ফলে দলে কোন্দল নেই। এটাই কংগ্রেসের প্লাস পয়েন্ট। বিজেপি সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা দলে কোন্দল, আর সরকারের বিরুদ্ধে ভালো রকমের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি। এখানে কংগ্রেস ১২৫-১৩০ পেতেই পারে, বিজেপি ১০০-র কাছাকাছি থাকবে। সবমিলিয়ে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন কিন্তু বিজেপির জন্য কোনও সুখবরই বয়ে নিয়ে আসছে না। ঢাকের বাজনা বাজছে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবেই বিসর্জন।