বাঙাল তো বটেই, বাঙালিরও রসিকতা বোধ নিয়ে কেউ কোনওদিন সন্দেহ প্রকাশ করেনি, করবে না। দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িতে চড়েননি একজনও গুজরাতি, যাঁরা চড়েছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই এই বাংলার। রসিকতা কোন পর্যায়ে তাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন ভাবুন, ফাঁসির দড়ি হাতে নিয়ে হাসছেন, ইংরেজ সাহেবদের দিকে তাকিয়ে। হ্যাঁ, সেই বাঙালি তাদের একজনও জাতীয় নেতা, এই বাংলার শিল্পী, কবি সাহিত্যিক, রবি ঠাকুর, নজরুল, বিবেকানন্দ বা রামমোহনের নামের সামনে দ্য লাগিয়েছে গ্রেট লাগিয়েছে? না, লাগায়নি। বাঙালি একজনেরই নামের আগে দ্য গ্রেট লাগিয়েছে, সে হল বাঁটুল দ্য গ্রেট, হ্যাঁ এটাই হল বাঙালির রসিকতা। সেই বাংলার কিছু ভক্ত দিল্লি থেকে আসা এক গুজরাতি সন্তানকে দ্য গ্রেট চাণক্য বলে সম্বোধন করা শুরু করেছেন। তাঁদের সেই চন্দ্রগুপ্ত হলেন মোদিজি আর দ্য গ্রেট চাণক্য হলেন অমিত শাহ। রাংতা মাথায় জড়িয়ে শিশু আর পাগল নিজেদের রাজা বলেই মনে করে, কারও কিচ্ছু করার নেই। সেই চাণক্য নির্বাচনের দিনেই জানিয়েছেন, ৫ রাজ্যোঁ মে বিজেপি কা সরকার বনে গা। কী করে বনে গা? মিজোরামে সম্ভবত একটাও আসন পাবে না বিজেপি, তারপরেও যদি পায় ৪০ জনের বিধানসভায় ১ কি দুজন পেলেও পেতে পারে, কিন্তু তাই দিয়ে সরকার? ১১৯ আসনের তেলঙ্গানাতে সমীক্ষা বলছে খুব বেশি হলে ১২টা, আমাদের ধারণা ৭ কি ৮টা আসন পাবে বিজেপি। ৮টা আসন নিয়ে তেলঙ্গানাতে বিজেপি সরকার? ছত্তিশগড়, এতকিছু করার পরে, মানে ইডি, সিবিআই, বেটিং অ্যাপ কেলেঙ্কারি ইত্যাদি দিয়ে আক্রমণ শানানোর পরেও বিজেপি জয়ের থেকে বহুদূর। কিন্তু দ্য গ্রেট চাণক্য বলেছেন ৫ রাজ্যোঁ মে সরকার বিজেপি কা হি বনে গা। মধ্যপ্রদেশ আরও ঘেঁটেছে, নরেন্দ্র সিং তোমরকে দিয়ে ডিফেন্স লাইন ঠিক করতে গিয়ে আরও প্যাঁচে বিজেপি, নিশ্চিত হারের সামনে। এক রাজস্থানে এখনও কাঁটে কা টক্কর, সেটাও একেবারে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত তা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু দ্য গ্রেট চাণক্য কেবল জয় নয়, সরকার বানাবেন ৫টা রাজ্যেই।
তো সেই ঐতিহাসিক চরিত্র চাণক্যের বহু কথার মধ্যে একটা কথা খুব পরিষ্কার। জয় যে কোনওভাবে পেতেই হবে, তার জন্য তিনি চার পথের কথা বলেছেন বলে অনেকে বলে, সাম, দাম, দণ্ড, ভেদ। কিন্তু চাণক্য নীতিশাস্ত্র পড়লে জানা যায় তিনি কূটনীতি প্রয়োগের পাঁচটা অস্ত্রের কথা বলেছেন, ১) সাম– সন্তুষ্টি বিধান, মানে বোঝাও, মানাও, সন্তুষ্ট করো, যাতে যাকে বোঝানো হচ্ছে সে সেই পথে চলে। আপনার এতে ভালোই হবে, আপনার ভালোর জন্যই বলছি ইত্যাদি। ২) দান– জিতলে তুমিই মুখ্যমন্ত্রী হবে, কথা শুনলে তোমাকে রাজার মন্ত্রী করা হবে, এই নাও পুরো জঙ্গল, তোমার নামে লিখে দিলাম, ওই শহরের খাজনা এখন থেকে তোমার, ইত্যাদি। ৩) দণ্ড – জেলে পোরো, রাজসভায় এনে অপমান করো, তদন্তের নির্দেশ দাও, ক্ষমতা কেড়ে নাও, ইত্যাদি। ৪) মায়া– এই কথাটা অনেকে ভুলে যান, জ্যোতিষী, গণক দিয়ে মায়াজাল বিস্তার করা, মায়া বা ইন্দ্রজালে বশ করা, এমন প্রচার, যা তাকে বাধ্য করবে রাজার কাছে নতজানু হতে। ৫) ভেদ– যদি এসবেও কিছু না হয়, তাহলে তাকে লড়িয়ে দাও, তার ১০টা শত্রু হোক, সে সেই শত্রুদের নিয়েই ব্যস্ত থাকুক। এক্ষেত্রে রাজা সরাসরি কিছুই করবেন না, কিন্তু বিভিন্ন মানুষ বা গোষ্ঠী সেই মানুষটির, সেই গোষ্ঠীর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। এটা হচ্ছে চাণক্য নীতির অন্যতম মূল মন্ত্র। জিততেই হবে আর জেতার জন্য সাম, দান, দণ্ড, মায়া, ভেদ-এর অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। তিনি যা বলেছিলেন তা এখনকার ভাষায় এন্ড জাস্টিফাইস দ্য মিন্স, জো জিতা ওহি সিকন্দর। সম্ভবত এই কথাগুলো মাথায় রেখেই অমিত শাহকে চাণক্য দ্য গ্রেট বলা হচ্ছে। গোদি মিডিয়া জানাচ্ছে এই মডার্ন চাণক্যের নেতৃত্বেই নাকি একের পর এক বিজয় পাচ্ছে বিজেপি, বিজেপির জয়ের ঘোড়া অপ্রতিরোধ্যভাবেই ছুটে চলেছে দেশ জুড়ে। সেই ২০১৪ থেকে, তিনি যখন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি হলেন, তখন থেকে, এখনও। আসলে এটাও বলা হচ্ছে জগৎপ্রকাশ নাড্ডা তো আসলে দুধু ভাতু, মাথায় আছেন সেই চাণক্য দ্য গ্রেট, অমিত শাহ, সেটা অবশ্য ১০০ শতাংশ সত্যি। নাড্ডাজি, যিনি নিজের রাজ্যেই বিজেপিকে জেতাতে পারেন না তিনি এখনও দলের সভাপতি কারণ তাঁর মতো পুতুল অমিত শাহের কাছে মজুদ নেই। আসুন দেখা যাক, ঐতিহাসিক চরিত্র চাণক্যের মতো এই দাবিও মিথ্যেতে চোবানো কি না, অমিত শাহ কি সতিই চাণক্য দ্য গ্রেট, নাকি এক হাওয়াভরা ফানুস।
আরও পড়ুন: ৫ রাজ্যের নির্বাচনের আশা ছেড়েছেন মোদিজি, আপাতত লক্ষ্য ২০২৪ বাঁচানো
২০১৪-র আগে বিজেপির রাজনৈতিক শক্তি কীভাবে বেড়েছিল? মানে লালকৃষ্ণ আদবানির সময়ে? দেশজুড়ে বিজেপির বন্ধু ছিল, ওই সাম, মানে সন্তুষ্টি বোধ থেকেই বিজেপির সঙ্গে ছিল শিবসেনা, অকালি দল, জনতা দল ইউনাইটেড, লোকজনশক্তি পার্টি, তেলুগু দেশম, এআইডিএমকে, কাশ্মীরে পিডিপি, ওড়িশায় বিজেডি। এছাড়াও ছোট ছোট অনেক দল। সব্বাই যে সন্তুষ্টি বোধ থেকে এসেছিল, তেমনও নয়, সম্ভবত ‘দান’ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বামেরা আলাদা, কংগ্রেস একঘরে আর অন্যদকে বিরাট ঐক্য বিজেপিকে সরকারে আসতে সাহায্য করেছিল। ২০১৪তে নির্বাচনের আগেই জাতীয় সভাপতি হলেন অমিত শাহ। একে একে প্রত্যেক দল সরে গেছে, আপাতত একটা জাতীয় দল বা বড় রাজনৈতিক দল বিজেপির সঙ্গে নেই। চাণক্য বেঁচে থাকলে এই আধুনিক চাণক্যকে এর দায়ে শূলে চাপাত। এবার আপনারা বলবেন, চাণক্য তো বলেই গেছেন, যো জিতা ওহি সিকন্দর, বিজেপি জিতছে আর কী চাই, দিকে দিকে বিজেপি জিতছে। তাই নাকি? আসুন ৫৮ বছর বয়সি এই চাণক্যের জয়ের ট্র্যাক রেকর্ডটাও দেখা যাক। আচ্ছা শুরু করা যাক ওনার হোম স্টেট থেকেই।
গুজরাতে অমিত শাহ জাতীয় সভাপতি হওয়ার পরে ২০১৭তে বিধানসভার নির্বাচনে গত ২৪ বছরের সব থেকে কম আসন পেয়েছিল বিজেপি, ৯৯টা, তার আগের ২০১২ থেকে ১৬ টা আসন কম, এবারে আপ কংগ্রেসের কাটাকুটিতে খানিক বৃদ্ধি হয়েছে। গোটা দেশে? দিল্লির নির্বাচন, আর বাংলার নির্বাচন। অবকি বার দোশো পার, কার স্লোগান ছিল? অমিত শাহের। পেয়েছিলেন ৭৭। দিল্লির পরাজয়ের কথা না বলাই ভালো, ৭০টা আসনে ৮টা। রাজ্য রাজধানীতে এই হারের পরেও তাঁকে চাণক্য বলা হবে? এবার গোটা দেশের তথ্যটাও দেখা যাক। বিজেপি রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন সবকটা রাজ্যের ভোট শেষ হওয়ার পরে বিজেপির এমএলএ সংখ্যা কতজন ছিল? ১৩১৮ জন, মানে ৩২.৭ শতাংশ, মোট এমএলএ-র সংখ্যা ৪০৩৬, বিজেপির ১৩১৮। আর ঠিক এই মুহূর্তে কত? মানে চাণক্য কতটা জয় এনে দিলেন? ১৩৩৮, মানে মোটের ৩৪.৩ শতাংশ, ২০ জন বেশি, কী বিরাট বিজয় বলুন দেখি? এর জন্য একজনকে চাণক্য বলা হচ্ছে। আসলে এক ফানুস, স্রেফ হাওয়া দিয়ে ফোলানো হচ্ছে। ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাত, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, রাজস্থান, তেলঙ্গানা, উত্তরাখণ্ড আর উত্তরপ্রদেশে ভোট হয়েছে। এই সবক’টা রাজ্যের মোট এমএলএ-র সংখ্যা ২১৮৫, বিজেপির কাছে ছিল ১০৭৫, মানে ৪৯ শতাংশ। বাই ইলেকশন বা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পরে এই সব রাজ্য মিলিয়ে বিজেপির এমএলএ ক’জন? ৮০২ জন, মানে ১৭৩ জন কমেছে, কিন্তু অমিত শাহ নাকি চাণক্য। আসুন রাজ্য ধরে ধরে এই হিসেবটা দেখে নেওয়া যাক। ২০১৮ ডিসেম্বর, রাজস্থানে বিজেপির এমএলএ ১৬৩ জন, গত নির্বাচনে জিতেছিলেন ৭১ জন। ২০১৮র পরে তেলঙ্গানায় ২টো আসনে বাই ইলেকশনে জেতার পরে তেলঙ্গানাতে বিজেপির এমএলএ ২ জন, আগে ছিল ০। ২০১৮ নভেম্বরে মধ্যপ্রদেশে ভোট হয়, তার আগে মধ্যপ্রদেশের বিজেপির ১৬৫ জন বিধায়ক ছিল, নির্বাচনের পরে তা কমে হয় ১০৯। তারপর দল ভাঙিয়ে, বাই ইলেকশনে জিতে বিধায়ক সংখ্যা ১৩০ জন। এবারে কোনওভাবেই ১২০ পার করতে পারবে না। ২০১৮ নভেম্বরে ছত্তিশগড়েও নির্বাচন হয়েছিল, নির্বাচনের আগে ছত্তিশগড়ে বিজেপির বিধায়ক ছিল ৪৯ জন, এখন ১৪ জন, এবারে খানিকটা বাড়বে কিন্তু জয় দূর অস্ত।
২০১৯-এ এপ্রিলে অন্ধ্রপ্রদেশে ৪টে আসন ছিল, এখন শূন্য। ২০১৯-এর অক্টোবরে হরিয়ানা আর মহারাষ্ট্রে বিধানসভার ভোট হয়, ভোটের আগে হরিয়ানায় ৪৭ জন আর মহারাষ্ট্রে ১২২ জন বিধায়ক ছিল, এখন হরিয়ানায় ৪১ জন, মহারাষ্ট্রে ১০৬ জন বিধায়ক আছে। ২০২২ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্জাব আর উত্তরাখণ্ডে ভোট হয়েছিল, তার আগে উত্তরাখণ্ডে ৫৭ জন আর পঞ্জাবে ৩ জন বিজেপির বিধায়ক ছিল। আজ উত্তরাখণ্ডে ৪৭ জন, পঞ্জাবে ২ জন বিধায়ক আছে। ২০২২-এ মার্চে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন হয়, সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ৩১২ জন এমএলএ ছিল, আজ ২৫৪ জন। মানে ১৩টা রাজ্যে বিধানসভায় ১৭৩ জন বিধায়ক কমেছে। একটা রাজ্য অসমে গত নির্বাচনেও ৬০ ছিল, এখনও ৬০ জন বিধায়ক আর অরুণাচলপ্রদেশ, বিহার, গোয়া, পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচলপ্রদেশ, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, মিজোরাম, মেঘালয়, মণিপুর, কর্নাটক, ত্রিপুরা, দিল্লি, পন্ডিচেরি এই ১৫টা রাজ্যে মোট ৩২৫ জন বিধায়ক বেড়েছে। ছিল ১৮১, হয়েছে ৫০৬। তার মানে ৬৬ শতাংশ মানুষের এলাকায় বিজেপি কমেছে, মাত্র ৩৪ শতাংশ মানুষ থাকে এমন এলাকায় তারা বেড়েছে, এবং সব মিলিয়ে মোট বেড়েছে ২০ জন। এবং ২০ জনের বৃদ্ধিকে বিরাট জয়, অশ্বমেধের ঘোড়া, বিজেপির জয়যাত্রা, মোদি-শাহের জয়যাত্রা ইত্যাদি বলে ঢাকঢোল পেটানো শুরু হয়েছে। সেই তিনিই মানে দ্য গেট চাণক্য বলেছেন ৫ রাজ্যে জিতবেন। তার মানে উনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে জেতার কথা বলছেন না, যেভাবে গতবার মধ্যপ্রদেশ বা কর্নাটক জিতেছেন, যেভাবে মহারাষ্ট্রে সরকার তৈরি করেছেন, সেইভাবেই সরকার তৈরি করার কথা বলছেন দ্য গ্রেট চাণক্য অমিত শাহ। ৩ ডিসেম্বর মানুষ জবাব দেবে।