জনসভা নয়, সংসদে দাঁড়িয়েই বলেছেন ৩৭০টার বেশি আসন পাবে বিজেপি। হ্যাঁ, মোদিজি এটা বলেছেন। ৩৭০ নির্দিষ্ট করা মানে হল ৩৭০-৩৮০টা আসন এবার একলাই পাবে বিজেপি। এটাই তো বলেছেন? বলার পরেই দেশজুড়ে ভক্তকুলের উদোম উল্লাস, জয়ের উল্লাস। কেবল তাঁরাই উল্লসিত? না, এই ঘোষণা ভিত কাঁপিয়েছে বিরোধীদেরও, তাঁদেরও নড়বড়ে দেখাচ্ছে, তাঁরাও নার্ভাস। অবশ্যই আপকা কহনা সর আঁখো পর বলেই মোদিজির কথাই যে সত্য তা প্রচারে নেমেছে সংবাদমাধ্যম। কেউ কেউ তো এমনও বলার চেষ্টা করছেন যে ৩৭০? মোদিজি সম্ভবত নিজেকেই একটু আন্ডার এস্টিমেট করছেন, ওটা তাঁদের মতে নাকি ৪১০-এর কাছাকাছি হবে। কেন? ৪১০ কেন? কারণ ইন্দিরা মৃত্যুর সহানুভূতি হাওয়ায় ভর করে কংগ্রেস ৪০৪খানা আসন জিতেছিল, বাংলা থেকে সেই প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিযাত্রা। তো মোদিজিকে তো দেশের সব রেকর্ড ছুঁতে হবে, হয়ে উঠতে হবে নব ভারতের নির্মাতা। জাতির পিতা আছে, অন্তত জাতির জ্যাঠা তো হতেই হবে, তাই ৪১০, মানে কংগ্রেসের রেকর্ড ভেঙে এক অনন্যসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু তিনি নিজে একটু সামলে বলেছেন ৩৭০। আসুন একটু ৩৭০-এর হিসেবটা নেড়েঘেঁটে দেখা যাক।
শুরু করা যাক গুজরাত দিয়ে। ২৬টা আসনে ২৬টাই বিজেপিরই আছে, আর তো বাড়ানো সম্ভব নয়। রাজস্থানে ২৫-এ ২৫, এক দুটো কমতে পারে, বাড়বে কী করে? মধ্যপ্রদেশে ২৮টার ২৭টাতে বিজেপি আছে, কমলনাথ জিতেছিলেন কংগ্রেসের একমাত্র আসনটা, ছিন্দওয়ারা থেকে জিতেছিলেন। সেটাও বিজেপি জিতে নেবে? জিতলেও একটা আসন বাড়বে। হরিয়ানাতে ১০-এ ১০, বাড়বে না। দিল্লিতে সাতে সাত, আর তো বাড়ানো সম্ভব নয়। উত্তরাখণ্ডে পাঁচে পাঁচ, হিমাচলপ্রদেশে চারে চারখানা আসনই বিজেপির, বাড়বে কোথা থেকে? ছত্তিসগড়ে ১১তে ৯টা আসন পেয়েছিল বিজেপি, দুটো আসন বাড়তেই পারে। এতগুলো রাজ্যে যদি ধরেও নিই একশো শতাংশ আসন বিজেপিই জিতবে তাহলেও গোটা ৪ কি ৫টা আসন বাড়তে পারে। বিহারে নীতীশ কুমারকে আবার নেওয়া হয়েছে, কেন? বিজেপি একলাই ৩৭০ আসনে জিতেই যাবে যদি মনে করত তাহলে নীতীশ কুমারকে আবার জোটে নিল কেন বিজেপি? অমিত শাহ তো বলেই দিয়েছিলেন, নীতীশকে লিয়ে দরওয়াজা হমেশাকে লিয়ে বন্ধ হো গয়া, তাহলে সে দরজা আবার খুলল কেন? কারণ নীতীশ এধারে থাকলে বিজেপি বিহারে ৪০-এ বড়জোর গোটা ৭-৮ আসন পেত। গতবার বিজেপি জোটের কাছে ছিল ৪০টার মধ্যে ৩৯টা আসন। সেসব বুঝেই নীতীশকে জোটে নিল বিজেপি, কিন্তু তাতে কি ছবি বদলাবে?
কত বাড়বে? সাত-আটের জায়গাতে এখন বিজেপি ২০-২২টা আসন পাবে, কিন্তু তাতেও কম করে ১৭-১৯টা আসন হারাবে এনডিএ জোট বা বিজেপি। মহারাষ্ট্রে? গতবার বিজেপিই পেয়েছিল ২৩টা আর এনডিএ পেয়েছিল ১৮টা, ৪৮টা আসনের ৪১টা ছিল এনডিএর কাছে। এবারে? হ্যাঁ, শিবসেনাকে ভাঙা হয়েছে, এনসিপিকে ভাঙা হয়েছে, এমনকী কংগ্রেসের নেতাদেরও ভাঙা হয়েছে, কিন্তু আগের আসন ধরে রাখা যাবে? তিন-চারটে হলেও কমবে। তেলঙ্গানাতে চারটে আসন ছিল বিজেপির, সবে বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেল, বিজেপি মাত্র আটটা আসন পেয়েছে। মানে চারটে লোকসভার সাধারণ হিসেবে অন্তত ২০-২২টা এমএলএ জিতিয়ে আনার বদলে আটজন এমএলএ জিতেছে, তেলঙ্গানাতে অন্তত দুটো আসন কমবে। অন্ধ্রপ্রদেশে শ্যাম রাখি না কূল রাখির সমস্যা। চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে জোট করলে ওয়াই এস আর রেড্ডির বিরোধিতা করতে হবে, আর ওয়াই এস আর রেড্ডির সঙ্গে জোট করলে চন্দ্রবাবু রেড্ডি বিরুদ্ধে যাবেন। কিন্তু যাই হোক, অন্ধ্র থেকে বিজেপি একটা আসনেও জিততে পারবে না। পুরো দাক্ষিণাত্যে ১২৮টা আসনের মধ্যে বিজেপি কর্নাটকে ২৫টা আর তেলঙ্গানাতে চারটে আসন পেয়েছিল। কোথায় বাড়বে? কেরালাতে একটা আসন পেলেও পেতে পারে, কর্নাটকে খুব কম করে ১৩-১৪টা আসন কমবে, তেলঙ্গানাতে অন্তত দুটো আসন কমবে। দাঁড়াল কী? এখনও পর্যন্ত করা হিসেবে অন্তত ১৯-২০টা আসন হারাবে বিজেপি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পাকিস্তান গাড্ডায়, আমরা কোন পথে?
এবারে উত্তরপ্রদেশ, যদি ৩০৩-এর বদলে আরও ৬৭টা বাড়ানোর হিসেবই ছিল হাতে, তাহলে রাষ্ট্রীয় লোকদলের জয়ন্ত চৌধুরিকে ভাঙানোর দরকার কী ছিল? কিন্তু তারপরেও কি গতবারের ৬৪টা আসন বিজেপির হাতে থাকবে? ৮০টা আসনের ৬৪টা বিজেপি জিতেছিল, এবারে কত? যদি বাড়ায়, তাহলেও ৭০, মানে ৬টা আসন বাড়াবে রামমন্দিরের পিঠে চড়ে নয়, জাঠেদের ভোটের বড় অংশ নিয়ে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে আসন বাড়ানোর জায়গা নেই। বাকি থাকলো আমাদের বাংলা, এখনও জোটের আশা ছাড়েননি অনেকে, এবং কংগ্রেস তৃণমূল জোট হলে জোট পাবে ৩৫-৩৬টা আসন, বিজেপি ছয় কি সাতটা। মানে গতবারের থেকে অন্তত ১১-১২টা আসন কম। জোট না হলে অন্তত আটটা আসন কমবে বিজেপির। সেটা হলেও বিজেপির মোট আসন ৩০-৩২টা কমবে। তাহলে মোদিজি এই ৩৭০-এর বিশুদ্ধ বাওয়ালটা দিচ্ছেন কেন? কারণ উনি একটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, সাইকোলজিকাল ওয়ার। নির্বাচনের আগেই এক মাহোল তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাতে বলা হচ্ছে সব শেষ, আমরাই আছি। এবং সেটা শুনে একেবারে যে কাজ হচ্ছে না তা নয়, বিরোধীদের এক বড় অংশ নার্ভাস, কিছু নেতা শিবির বদলানোর কথা ভাবছেন। যদি মোদিজির দেওয়া হিসেবে এতটুকুও সত্য থাকত, সম্ভাবনা থাকত তাহলে এসব বলার পরেও মহারাষ্ট্রে নতুন করে কংগ্রেস ভাঙানো, নতুন করে বিহারে নীতীশ কুমারকে ভাঙিয়ে নিয়ে আসা, রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা জয়ন্ত চৌধুরিকে ভাঙিয়ে নিয়ে আসার এসব চেষ্টা তাঁরা করতেন না। তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন বাস্তব ছবিটা এক্কেবারে আলাদা। এবং কেবল তাঁরাই জানেন তাই নয়, তাঁদের হয়ে যারা মাঠে নেমেছে সেই সংবাদমাধ্যমও জানে গ্রাউন্ড রিয়েলিটির হাল হকিকৎ। কিন্তু তারাও বাজনা বাজাতে শুরু করেছে। ধরুন ইন্ডিয়া টুডে, তাদের সার্ভেতে জানিয়েই দিয়েছে খেলা শেষ, বিজেপি জিতছে ৩০৪খানা আসন। মালিক বলছে ৩৭০, কিন্তু ওনারা জানেন ওসব বললে সাধারণ বিশ্বাসযোগ্যতাতেও চোট পড়বে, আবার সত্যি কথাটা বললে, ইডি ইনকাম ট্যাক্স বা সিবিআই-এর রেডও হতেই পারে, তাই গতবারের চেয়ে একটা বেশি আসন দিয়ে সার্ভে শেষ করেছে।
কিন্তু গোটা সার্ভেটা খুঁটিয়ে দেখলে এত বড় বড় ফুটো বেরিয়ে আসবে সেটা আমরাও ভাবতে পারিনি। এই সার্ভের প্রথম গলদটা হল তাদের পদ্ধতিতে। তারা লিখিতভাবেই জানিয়ে দিয়েছে যে এই সার্ভে করা হয়েছে টেলিফোনে, মানে সরাসরি সামনা সামনি গিয়ে নয়। তো মাত্র গত বছরের সিএসডিএস-এর সার্ভে বলছে, দেশে ৬৯ শতাংশ মানুষের হাতে টেলিফোন বা মোবাইল ফোন আছে, ৩১ শতাংশ মানুষের কাছে নেই। কারা এই ৩১ শতাংশ? নিশ্চিতভাবে দেশের সবচেয়ে গরিব মানুষজন। তাহলে ওই সিএসডিএস-এর আরেকটা সার্ভের দিকে নজর রাখা যাক। যেখানে বলা হচ্ছে, যাদের মোবাইল ফোন আছে তাদের ৪১ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেয়, যাদের নেই তাদের ৩৫ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেয়। তার মানে গরিব লোকজনেদের অন্তত ৬ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেয় না, যে হিসেব এই সার্ভেতে এলই না। এরও পরে বলা হয়েছে, এই সার্ভে ৩ শতাংশ এদিক ওদিক হতে পারে। তার মানে বিজেপি ৪২ শতাংশ ভোট পাবে বলা হয়েছে সেটা ৩৯ শতাংশ হতেই পারে, কংগ্রেস ৩৭ শতাংশ ভোট পাবে বলেছে সেটা ৪০ শতাংশ হতেই পারে। সার্ভেতেই একথা বলা আছে, কিন্তু মানুষ তো সার্ভের এসব দেখেন না, মোট কে কত পেতে পারে ধরে নিয়েই পার্সেপশন তৈরি করেন। কাজেই এই সার্ভেও আসলে সেই সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ারের অঙ্গ মাত্র। এবং মজা এখানেই শেষ নয়, এই সার্ভেতে মানুষের মতামত বহু বিষয়ে নেওয়া হয়েছে, সেখানে অর্থনীতির বহু প্রসঙ্গ আছে। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বেকারত্ব নিয়ে আপনারা কতটা চিন্তিত? ৫২ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত চিন্তিত, ১৯ শতাংশ মানুষ চিন্তিত। মানে যাদের মধ্যে সার্ভে করা হল তাদের ৭১ শতাংশ বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত, তাদের মনে হয়েছে বেকারত্ব বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কী ভাবছেন? ৬২ শতাংশ মানুষ বলেছেন খুব খারাপ অবস্থা, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। আপনার আর্থিক অবস্থার হাল কেমন? উত্তরে ৩৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন আগের থেকেও খারাপ, ২৯ শতাংশ বলছেন আগের মতোই আছে।
মানে ১০ বছর বিজেপি শাসনের পরে ৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করছেন অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ বা আগের মতোই আছে। মাথায় রাখুন এরমধ্যে সেই গরিব অংশের মানুষ নেই যাঁদের একটা মোবাইল ফোনও নেই। তারপরে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আচ্ছা এই অবস্থা পাল্টাবে বলে কি আপনি মনে করেন? ৩০ শতাংশ মনে করেন আগের চেয়েও অবস্থা খারাপ হবে, ৩৬ শতাংশ মনে করেন যা ছিল তাই থাকবে। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনাদের কি মনে হয় আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে? ৪৫ শতাংশ বলেছেন হ্যাঁ বাড়ছে, মাত্র ৩৭ শতাংশ বলেছেন, না বাড়ছে না। প্রশ্ন, সরকারি নীতিতে কার লাভ? ৫২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বড় ব্যবসায়ীদের এই জমানাতে লাভ হয়েছে। দুর্নীতি কমেছে? ৪৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, না কমেনি। ৪৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন কমেনি। আচ্ছা, যে দেশের মানুষ মনে করে বেকারত্ব বাড়ছে, মনে করে মূল্যবৃদ্ধি অসহ্য হয়ে উঠছে, মনে করে যে এই সরকার কেবল বড় ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করছে, মনে করে যে বৈষম্য বাড়ছে, তারা এই সরকারে যে দল আছে তাদের ভোট দেবে? কেন? রামমন্দির করেছে বলে? এটা সার্ভে না সার্কাস? আসল সত্যিটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আর তাঁর সুরে সুর মেলাচ্ছে পেটোয়া সংবাদমাধ্যম, কিন্তু ফাঁকফোকর দিয়ে সত্যি বেরিয়ে আসছে। এ দেশের গরিষ্ঠাংশ মানুষ এই সরকারকে অপদার্থই মনে করে, মনে করে এই সরকারের আমলে বেকারত্ব বাড়ছে মূল্যবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু এটাও ঘটনা যে তাদের সামনে এক দূর্বল, একে অন্যের সঙ্গে চুলোচুলিতে ব্যস্ত বিরোধী দল, সেখানেই সমস্যা, আর তার সুযোগ নেওয়ার জন্যই এই ঢাক বাজানো হচ্ছে, বাজাচ্ছেন আমাদের চৌকিদার।