দেশ তো একদিনে তৈরি হয় না, পাঁচ বছরেও নয়। দেশের শ্রীবৃদ্ধি এক ধারাবাহিক ব্যাপার, অন্তত যতক্ষণ দেশে এক গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে, সংবিধান আছে, যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বহু আলাপ আলোচনার পরে আমাদের হাতে, দেশের মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সেই গণতান্ত্রিক কাঠামো আর সংবিধানের হাত ধরে দেশ চলতে থাকে। কখনও দ্রুত গতিতে, কখনও একটু ধীর গতিতে, কখনও সখনও দু’ কদম পিছিয়ে গেলেও আবার এগিয়ে যায় দেশ। পৃথিবীর ইতিহাস সেরকমই বলে। রাজতন্ত্রের বদলে, সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর বদলে এক নির্বাচিত সরকার, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সে দেশের আপামর মানুষের জন্য ধ্রুবতারার মতো এক সংবিধান পৃথিবীর সভ্যতার এগিয়ে চলার ইতিহাস লিখেছে। আর যে যে সময়ে সেই গণতন্ত্র উবে গেছে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার কেবল এক কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনই সেই দেশ, সেই সমাজ পিছিয়েছে। কারণ সমাজ বিজ্ঞান বলছে, আসলে ব্যক্তি মানুষের পূর্ণ বিকাশ গোটা সমাজের চালিকাশক্তি, ব্যক্তি মানুষের বিকাশ বাধা পেলে সমাজ পিছিয়ে পড়ে। একটু বড়সড় সাম্রাজ্য, যেখানে বংশানুক্রমে বাবা, তার ছেলে তার ছেলের শাসন চলেছে, সে মুঘল সাম্রাজ্যই হোক বা রোমান এমপায়ার বা চোল শাসন, আমরা দেখেছি সে দেশ, অঞ্চল, সমাজ ততক্ষণ এগিয়েছে যতক্ষণ সেই সাম্রাজ্যের শাসক সাধারণভাবে মানুষের বিচিত্র আর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি। যেই মাত্র সেই রাজা, সেই সম্রাট বাণিজ্য থেকে সঙ্গীত থেকে খাদ্যে নিজের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করেছেন, সেই মাত্র তা আচমকাই ভেঙে পড়েছে।
তাই সেই এক ব্যক্তির শাসন, এক ব্যক্তির বা ছোট্ট এক গোষ্ঠীর শাসনের চেয়ে উন্নততর শাসন ব্যবস্থা হিসেবেই মানুষ ক্রমশ এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে, নির্বাচিত সরকার তৈরি করেছে, সেই সরকারও যে কাজ করবে তার এক দায়রা বেঁধে এক সংবিধান তৈরি করেছে। কিন্তু যেই মাত্র তা লঙ্ঘিত হয়, সেই মাত্র দেশ পিছোতে থাকে, আচমকাই ভেঙে পড়ে। ক’দিন আগেই এমনই এক প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কথা বলছিলাম, যে পাকিস্তানের প্রথম পুরুষ কায়েদে আজম জিন্নাহ বলেছিলেন পাকিস্তান সমস্ত ধর্মের মানুষদের অধিকারকে স্বীকার করে। তাঁর কথা শুনেই বহু হিন্দু, শিখ থেকে গিয়েছিলেন সে দেশেই। এবং একটা সময়ে তো পাকিস্তান ইউরোপের কাছে ব্রাইট বয়, চৌখস ছেলে হয়ে উঠেছিল, আমাদের থেকে বাণিজ্যে এগিয়ে ছিল, জিডিপিতে এগিয়ে ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান হয়ে উঠল এক সৈনিক শাসিত দেশ, যে তকমা তার এখনও যায়নি। দেশ ভেঙেছে। এই উপমহাদেশে ওই পাকিস্তান থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সাফল্যে সব দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচন হয়, সামরিক বাহিনীর কর্তারা আপাতত রাজনীতিতে নেই, এক সংবিধান আছে, দেশের সরকার এমনকী ইসলামিক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। আবার দেশও এগোচ্ছে। গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন আছে, তার বিস্তার, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে বইকী, কিন্তু বাংলাদেশের আপাত গণতন্ত্রও সে দেশের বিকাশ আর উন্নয়নের কারণ বইকী।
নেপালও একইভাবে এগোচ্ছে, তারা ছিল ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্র, তাই নিয়ে রাজতন্ত্রে পড়ে থাকা এক কুণ্ঠিত বাহাদুর তকমা ছেড়ে এখন সেই নেপাল, দেশ জুড়ে রাস্তাঘাট, শিল্প বাণিজ্য নিয়ে রীতিমতো তাক লাগানো অগ্রগতির দিকে এগোচ্ছে। মালদ্বীপ, সটান জানিয়েই দিয়েছে আমরা কোনও দেশের দাদাগিরি মানব না, ভারতের ট্যুরিস্ট যাওয়া কমলেও তাদের মোটের ওপর অর্থনীতি ভালো হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা আবার ছন্দে ফিরছে। অন্যদিকে এশিয়ান টাইগার চীন হু হু করে এগোচ্ছিল বটে কিন্তু সেই গতি থেমেছে, ঘরে বাইরে বিভিন্ন সমস্যা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সারা পৃথিবীতে ক্রমশ সঙ্গী হারাচ্ছে। চীনের মধ্যেই গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। বার্মা বা মায়ানমারের দিকে তাকান, সে দেশের নাম গুগল করলে মিলিটারির ছবি উঠে আসছে, সামরিক শাসন আর গণতন্ত্রহীনতা সে দেশের যাবতীয় সুখ সমৃদ্ধি কেড়ে নিয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা এক বাঁকের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। এমন নয় যে আমাদের দেশে বিরোধীরা ক্ষমতায় আসেনি, বহুবার এসেছে। ৭৭তে কংগ্রেসকে হারিয়ে এসেছে, তারপরে আবার কংগ্রেস এসেছে, আবার হেরেছে, বিরোধী বিভিন্ন দল ক্ষমতায় এসেছে, বিজেপির নেতৃত্বে সরকার তৈরি হয়েছে, পাঁচ বছরের এক শাসনে অনেক কিছু হয়েছে আবার অনেক কিছুর অভাব ছিল, ফলে মানুষের রায়ে সে সরকারের বদল হয়েছে। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত যা হয়েছে তা ছিল কোথাও উন্নয়ন, কোথাও অনুন্নয়ন, বৈষম্য, কোথাও দারুণ অগ্রগতি, কোথাও পিছিয়ে পড়া। মাঝেমধ্যেই গণতন্ত্র কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা হয়েছে, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ৭৫ থেকে ৭৭ জরুরি অবস্থা জারি করে গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যেই মাত্র আবার নির্বাচনের সুযোগ এল মানুষ সেই স্বৈরাচারের জবাব দিয়েছিল।
কিন্তু আজ ছবিটা আলাদা। এক্কেবারে আলাদা। এখন আপনি যদি মনে করেন নিয়মিত নির্বাচন হওয়াটাই গণতন্ত্র, তাহলে আছে, এদেশে গণতন্ত্র আছে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র কীভাবে থাকবে যদি পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই অগণতান্ত্রিক হয়ে যায়? মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার কে নিয়োগ করবে? সেই প্যানেলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারক, চিফ জাস্টিস ছিলেন, ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশে বিরোধী দলের নেতা। তো চিফ জাস্টিসকে সরিয়ে দেওয়া হল। তার বদলে আরেকজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী। মানে তিনজনের মধ্যে দুজনই সরকারে যে দল আছে সেই দলের শীর্ষ নেতা। অর্থাৎ নির্বাচন যিনি করাবেন তিনি নিরপেক্ষ হবেন না। না হলে কী হবে? এই ব্যবস্থা হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশন কি খুব নিরপেক্ষ ছিলেন? তাও নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে কখনও সেনাবাহিনীর নাম করে ভোট চাইছেন, কখনও দেশের সেনাবাহিনীকে বলা হচ্ছে মোদিজির সেনা, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি ধর্মের নামে ভোট দিতে বলছেন। এসব তো নির্বাচনের আইন কানুন বিরোধী, এরকম অভিযোগও জমা পড়েছে। কিচ্ছু হয়নি। নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য খানিক মুখ খুলেছিলেন, সেই অশোক লাভাশার গুষ্টির প্রত্যেকের ঘরে ইনকাম ট্যাক্স পৌঁছে গিয়েছে। এরকমভাবে নির্লজ্জ পদ্ধতিতে দেশ আগে কখনও চলেনি। ইডি-সিবিআই বেছে বেছে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ঘরে যাচ্ছে, তাদের জেলে পুরছে। মোদি জমানাতে যতগুলো মামলা হয়েছে তার ৯৫ শতাংশ মামলা বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধেই হয়েছে। এবং মজার কথা হল সেই বিরোধী নেতারা তাদের দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেই মামলা বন্ধ, ইডির হানাদারি বন্ধ, সিবিআই আর ডাকছে না। হিমন্ত বিশ্বশর্মা, তাঁর বিরুদ্ধে সারদার মামলা, জমি হাতিয়ে নেওয়ার মামলা ইত্যাদি চলছিল, তিনি কেবল দলবদল করলেন, ব্যস সব হানাদারি বন্ধ, এখন তাঁর নির্দেশেই ইডি চলছে। ক’দিন আগেই নরেন্দ্র মোদি বললেন, ন্যাচারালি করাপ্ট পার্টি হল এনসিপি, যার নেতা আর তার ভাইপো হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, ক’দিনের মধ্যেই সেই অজিত পাওয়ার শিবির বদল করলেন, ইডির নোটিস ওনার কাছে যাচ্ছে না। শরদ পাওয়ার বা তাঁর কন্যার কাছে যাচ্ছে। জেল থেকেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ডান হাত মণীশ সিসোদিয়া বলছেন, তাঁকে সাফ জানানো হয়েছে দল ছাড়ুন দু’ দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে যাবেন।
এই বাংলায় এক গোখরো সাপ টলিউডের নায়ক নায়িকাদের বলছেন তৃণমূলটা ছেড়ে দে, বিজেপিতেও আসতে হবে না বাকিটা আমি দেখে নেব। এসব লুকিয়ে ছুপিয়ে হচ্ছে না, সবার সামনে হচ্ছে। কে কথা বলবে? মিডিয়া? বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিনে নেওয়া হবে, চাকরি চলে যাবে, মালিক, সাংবাদিক সম্পাদককে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন লড়তে টাকা চাই, কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বিজেপির ফান্ডে, কর্পোরেট ডোনেশন, সাদা কালো হরেক কিসিমের টাকা নিয়ে মাঠে হাজির বিজেপির বিভিন্ন চেহারা। প্রতিটা খবরের কাগজে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন, রাস্তা ঘাটে হোর্ডিং ব্যানার, সর্বত্র কমল, সর্বত্র পদ্মফুল। দেখে মনে হতেই পারে আর কেউ কি মাঠে আছে? দেশে নির্বাচন ঘোষণাই হয়নি, অথচ সারদিকে ভেঁপু বাজানো হচ্ছে, মোদিজি জিতে তো গেছেনই, ৩৭০ না ৩৫০? সংখ্যা নিয়ে খানিক আলোচনা হচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে? সেই একই সমীক্ষা বলছে চাকরি নেই, ৬০,০০০ পুলিশের চাকরির জন্য ২৮ লক্ষ ছেলে মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, সেটাও বাতিল। স্বাধীনতার পরে এমন বেকারত্ব ভারত দেখেনি। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বৈষম্য বেড়ে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে যা দেখলে লজ্জা হয়, দেশে ১১ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের ৭৯ শতাংশ সম্পদ, দেশের ২১ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের ৯৩ শতাংশ সম্পদ। তাহলে বাকি ৭৯ শতাংশ মানুষ, ১১০ কোটি মানুষ কী খায়? কী পরে? হিসেব বলছে ৭০ শতাংশ মানুষের রোজগার বাড়েনি বা কমেছে। বলছে, ৬৩ শতাংশ মানুষ মনে করে অবস্থা একই আছে বা আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়াতে মোদিজি ৩৭০ নাকি ৩৮০ নাকি ৪০০ পার করবেন তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে? নাকি সবটাই রিগড? হ্যাঁ, এক মিথ্যের নির্মাণ চলছে গত ৯-১০ বছর জুড়ে, যে মিথ্যে অত্যন্ত চতুরভাবে আমাদের অন্যভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হচ্ছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার যাবতীয় ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, দেশের সংবিধানকে সরিয়ে রেখে এক স্বৈরাচারকে ক্রমশ এক লেজিটিমেসি, এক স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, যা বিপজ্জনক। হ্যাঁ, সে কাজে বিজেপি আরএসএস আর তার দোসরেরা অনেকটাই সফল, কিন্তু এ সফলতা তো চিরন্তন হতে পারে না, সভ্যতার চাকা থমকে দাঁড়াতে পারে, খানিক পিছনেও যেতেই পারে কিন্তু তাকে উল্টো পথে বেশিদিন রাখা যায় না, সে তার পথ খুঁজে নেবে। কিন্তু তার এক বিরাট মূল্য চোকাতে হবে সারা দেশের মানুষকে। হ্যাঁ, যাঁরা আজ মোদিভক্ত হয়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে জয়গানে নেমেছে, তাঁদেরও মূল্য চোকাতেই হবে, ইতিহাস তাই বলে।