সংসদীয় রাজনীতিতে একদল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসবে, অন্যদল বিরোধী পক্ষ। একদল বলবে আমরা মানুষের জন্য কাজ করছি আগের সরকার যা করেনি, অন্যদল বলবে আমরা যা করেছিলাম তা এই সরকার আজও করে উঠতে পারেনি। একদল বলবে সরকার অগণতান্ত্রিক, অন্যদল বলবে আগের সরকারে থাকা দলের নেতারা এক একজন খাঞ্জা খাঁ ছিল, জবাব আসবে আজ শাসকদলের নেতারা মানুষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। পুলিশি বাড়াবাড়ি, ধর্ষণ, রেশন চুরি, বেকারত্ব, চাকরি চুরি, উন্নয়ন, বিকাশ, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ, শিশুমৃত্যু এরকম হাজার ইস্যু আসবে। সেই ইস্যু নিয়ে বিরোধীরা মাঠে নামবে, সরকারে থাকা দল বলবে বিরোধীরা শিশুমৃত্যু কি ধর্ষণ কি দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছে। বাজি ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগল, পুড়ে মরল জনা আট কি দশ কি বারো, এ ঘটনা প্রায় সব আমলেই ঘটেছে, যার আমলেই হোক না কেন। বিরোধী যারা তাঁদের অভিযোগ ওখানে সরকারি দলের দেখরেখে তৈরি হচ্ছিল বোমা, সরকারে থাকা দল বোমা, বন্দুক, খুনের রাজনীতি করছে। এ কি আপনারা শোনেননি? হরেক কিসিমের জমানাতে এসব শুনেছেন, আধা ফ্যাসিস্ট রাজত্ব ছিল কংগ্রেস আমলে, ঘরছাড়া হয়েছে আমাদের হাজার হাজার কর্মী, জ্যোতি বসু তাঁর প্রায় সমস্ত ভাষণে এসব কথা বলেছেন। একই কথা তৃণমূল কংগ্রেস এসে বলেছে, বলেছে সাঁইবাড়ির কথা, বলেছে ২১ জুলাইয়ের কথা। আবার আজকের বিরোধী কংগ্রেস এবং বামেরা সেই একই অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে আনছে। এগুলো সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গ, এসব নৌটঙ্কি দেশের মানুষ জানে, বাংলার মানুষ বুঝে গেছে। কিন্তু এসবের থেকে অনেক আলাদা বিজেপির প্রচার, বিজেপির বিরোধিতার জায়গাটাই আলাদা। ইডি গিয়েছিল শেখ শাহজাহানকে ধরতে, তার দলবল আর সমর্থকরা সেদিন এমন রুখে দাঁড়িয়েছিল যে ইডিকে ফিরে আসতে হয়, সম্মিলিত হেনস্থার মুখে পড়তে হয়, মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। তারপর থেকে শেখ শাহজাহান নিরুদ্দেশ, এর কিছুদিন পর থেকেই এলাকাতে নাকি গণ অভ্যুত্থান। জানা যাচ্ছিল ওই শাহজাহান, তার সাকরেদ শিবু উত্তমদের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ অত্যাচারিত গ্রামবাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে। তাদের রোষের সামনে পড়ে ওই শিবু আর উত্তমও গা ঢাকা দিয়েছিল, আপাতত তারা গ্রেফতার। অত্যাচারের তালিকায় গণধর্ষণ, ধর্ষণের অভিযোগও আছে। স্বাভাবিক, এই ইস্যু ছাড়বে কেন বিরোধীরা, ছাড়া উচিতও নয়। বিভিন্ন এলাকাতে শাসকদলের এই মাঝারি নেতারা যে সব আমলেই এক একজন খাঞ্জা খাঁ হয়ে ওঠেন তা তো আমরা জানি। কাজেই বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস বাম তার বিরোধিতায় নেমেছে, সরকারে থাকা দল তৃণমূল এসব অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলছে। এও খুব স্বাভাবিক। মানুষ এসব কথা শুনছেন। কিন্তু ওই যে বললাম, বিজেপি দলটাই আলাদা, তাদের লক্ষ্য আলাদা, তাদের পথ আলাদা, তাদের বিরোধিতার মধ্যে থাকে এক অন্য উদ্দেশ্য যা স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। যে ক্ষত যত গভীর হবে, বিজেপি নেতারা সেই ক্ষত থকে তত বেশি লাভ পায়, চুলোর দোরে যাক দেশ, দেশের সমাজ, ওনাদের লক্ষ্য কেবল বিরোধিতা নয়, এক স্থায়ী গভীর ক্ষত তৈরি করা। তাই প্রচার হচ্ছে শেখ শাহজাহান ধর্ষণ করেছে হিন্দু মহিলাদের, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে।
সন্দেশখালিতে অভিযোগ কি কেবল ধর্ষণের? তোলাবাজির অভিযোগও তো আছে আর এই সরকারের আমলে কাটমানি তোলাবাজি কোনও নতুন কথাও নয়, হচ্ছে তো। না হলে অঞ্চলে অঞ্চলে এইসব মাঝারি নেতাদের অমন প্রাসাদগুলো তৈরি হচ্ছে কোত্থেকে? অত্যাচার? তাও আছে, কারণ জার্সি পাল্টালেও আসলে তো এরা পুরনো ষাঁড়, প্রতিবার এরা জামা বদল করে কেবল নিজেদের রাজত্ব রাখতে, এও তো সবার জানা। আবার দেখুন একটা ঘটনা ঘটেছে, স্থানীয় মানুষ রাস্তায় মিছিল করছেন, সেখানে বিরোধীদের যেতে দেওয়া হবে না। আমরা তো দেখেছি নন্দীগ্রাম এপিসোডে সাংবাদিকদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে বিরোধী নেতাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ রাজ্যে সরকার বদল হয়েছে কিন্তু সরকারের কাজের পদ্ধতি কি বদল হয়েছে? বিরোধীদের যেতে দেওয়া হবে না, অথচ শাসকদলের নেতামন্ত্রীরা দিব্যি যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | দেব, মিমি, পদত্যাগ, রাজনীতি
এ নিয়ে প্রতিবাদ হোক, বিরোধীরা বলুক, বলছেও, স্বাভাবিক। কিন্তু বিজেপির প্রচার হল ওখানে তৃণমূল নেতা শাহজাহান হিন্দু মেয়েদের এনে ধর্ষণ করত, উত্তম আর শিবু শাহজাহানকে হিন্দু মহিলা সাপ্লাই করত। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে চলছে এই প্রচার। সেই এক গভীর ক্ষত তৈরি করার প্রক্রিয়া। ধর্ষণ যথেষ্ট নয়, অত্যাচার যথেষ্ট নয়, তোলাবাজি যথেষ্ট নয়, এক হিন্দু-মুসলমান বাইনারি তৈরি করাটাই তাদের উদ্দেশ্য। উত্তম-শিবু হল পতিত হিন্দু, তারা শেখ শাহজাহানের মহিলা সাপ্লায়ার, এটাই বিজেপির প্রচার। সরকারি দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা প্রচার করবে, তাদের বিভিন্ন ছোট ভুলকে তিল থেকে তাল করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কে করেননি? কিন্তু বিজেপি সেটাকেই এক গভীর সামাজিক ক্ষততে বদলে দেবে, আজ নয় বহু যুগ ধরে তার থেকে রক্তক্ষরণ হবে, এটাই তাদের রাজনীতি। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, এই ধর্ষণ, লুঠ, অত্যাচারের অভিযোগকে এক সাম্প্রদায়িক চেহারা দিতেই কি বিজেপি চেষ্টা চালাচ্ছে? তাদের উদ্দেশ্য কি ওই সন্দেশখালিতে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
অপরাধের গুরুত্ব ধর্মের ভিত্তিতে বাড়েও না, কমেও না। যদি হয়ে থাকে, তাহলে সন্দেশখালির শেখ শাহজাহানের ধর্ষণ বা সেখানকার উত্তম, শিবুর ধর্ষণের অপরাধ কম বা বেশি হয় না। হাথরসের দলিত মহিলাকে ধর্ষণ তো করেছিল আরেক দলিত পরিবারের পুরুষেরা, বা বিলকিস বেগমকে ধর্ষণ করেছিল তো উচ্চবংশের মানুষজন। স্থানীয় এমএলএ-র ভাষায় সংস্কারী ব্রাহ্মণেরা ধর্ষণ করেছিল, তাতে কি অপরাধের গুরুত্ব কমে বা বাড়ে? ধর্ষণ যেই করুক কোনও ভাবেই কোনও সময়েই কি ধর্ষণকে জাস্টিফাই করা যায়? বিজেপি এভাবেই চিন্তা করে, তাদের কাছে ধর্ষণের সঠিক বেঠিকও আছে। সেই কবে আরএসএস-বিজেপির গুরুদেব বিনায়ক দামোদর সাভারকার লিখেছিলেন, মারাঠারা যে মুসলমান রমণীদের বন্দি করে এনেছিল তাদের ধর্ষণ করাই উচিত ছিল কারণ মুসলমান রাজাদের সৈন্যরা সেটাই করে থাকে। তো গুরুদেবের চেলারা যে গুরুর মতোই চিন্তা করবে এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?