তেমন অবস্থায় পড়লে ভূতের মুখেও রামনাম শোনা যায়, সেরকম পাঁকে পড়লে হাতিও অসহায় হয়ে পড়ে, তেমন প্যাঁচে পড়লে কূটকচালিতে অভ্যস্ত মন্থরার মুখেও মিষ্টি কথা শোনা যায়। এসব আমরা জানি। তেমনিই আজ বিজেপির মুখে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদির কথা শুনে মনে যদিও এক পৈশাচিক আনন্দই হচ্ছে কিন্তু তবুও গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা তো বলতেই হবে। বহুদিন ধরেই কলকাতা পুলিশ ধর্মতলাতে জনসভা করার জন্য অনুমতি কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই দিয়ে আসছে। সিধু-কানহু ডহরে, শহীদ মিনারের তলায় আর বাস গুমটির পাশে। ডোরিনা ক্রসিং ইত্যাদিতে জনসভার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না বহুদিন আর ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে ওই এক ২১ জুলাই ছাড়া অন্য কোনও জনসভার অনুমতি দেওয়া হয় না। এবং এসবই ওই রাস্তা, ট্রাফিক জ্যাম ইত্যাদির জন্যই দেওয়া হয় না বলেই প্রশাসন থেকে জানানো হয়। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সোনার হরিণ চাই, এক নেতা অন্য নেতার মুখ দেখেন না, ৯০ শতাংশ সাংসদ জানেন এরপর থেকে পেনশনই ভরসা। আবার জিতে ফিরে আসবেন তেমন ভরসা নেই, কিন্তু সোনার হরিণ চাই। ওই ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই জনসভা করবেন এবং যেমন তেমন নয়, সেই সভাতে আসছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই। সামনেই বিশাল কর্মসূচি নেওয়া আছে, ১ লক্ষ মানুষ নাকি একসঙ্গে গীতা পাঠ করবে। যে গীতাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলা আছে, যে গীতা সত্যের জয়ের কথা সুনিশ্চিত করে সেই গীতা পাঠ করাবে এই মুহূর্তে দেশের সবথেকে জনবিরোধী দল। তার আগের প্রস্তুতি হিসেবেই ছোটা মোটা ভাইয়ের আগমন। সেই জনসভার অনুমতি দিচ্ছে না প্রশাসন, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, ধর্মতলায় বিজেপিকে জনসভা করার অনুমতি কেন দেওয়া হবে না?
কলকাতা পুলিশ প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে জনসভার অনুমতি দেওয়া হবে না তো বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই গিয়েছে আদালতে। তাঁরা দুঃখ পেলেই হয় আদালতে যান না হলে রাজভবনে। আদালত রায় দেবে, বিচারপতি ধর্মাবতার হুজুর মাই বাপ যা বলবেন তাই তো হবে। কিন্তু সে তো রায় আসার পরে, তার আগে এই দাবি নিয়ে কিছু কথা বলে নিই। আরএসএস–বিজেপি গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলছে? যাদের শাসনকালে বছরের পর বছর অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, কবি সাহিত্যিক বিনা বিচারে জেলে পচে মরে?
আরও পড়ুন: গৌতম আদানি বাদ পড়লেন? বাদ দেওয়া হল? সরে গেলেন?
সেই বিজেপি গণতান্ত্রিক অধিকার মিছিল মিটিংয়ের অধিকারের কথা বলছে যারা মিলিটারি পুলিশ দিয়ে দেশের মানুষের থেকে আলাদা করে রেখেছে কাশ্মীর ভ্যালিকে? যারা মণিপুরের জাতি দাঙ্গার পরে বিরোধী নেতাদের রাজ্যে ঢুকতেই দিতে চায় না? যারা বিরোধিতা করেছে এমন প্রত্যেক সাংবাদমাধ্যমকে হয় কিনে নিতে চায় না হলে ইডি-সিবিআই পাঠিয়ে ভয় দেখায়? এই মুহূর্তে নিউজ ক্লিকস-এর সম্পাদক জেলে, বিশ্বাসযোগ্য কোনও অভিযোগও নেই তাঁর বিরুদ্ধে। সেই বিজেপি হঠাৎ গণতন্ত্রের কথা বলছে? এই ক’দিন আগে আমাদের এই বাংলা থেকেই তৃণমূল নেতানেত্রীরা কর্মী সমর্থকদের নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। গণতন্ত্র বাদই দিলাম সাধারণ শিষ্টাচার তাকে তুলে রেখে সেই মন্ত্রী তাদের সঙ্গে দেখা করেননি, তাঁদের দিল্লিতে সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, মনে নেই? ত্রিপুরাতে বিরোধীদের রাস্তার ধারে মিটিংও করতে দেওয়া হয় না, জানেন না এ রাজ্যের বিজেপি নেতা সুকান্ত, শুভেন্দু, দিলু ঘোষেরা? মনে নেই কৃষি বিলের বিরুদ্ধে লড়াকু কৃষক আন্দোলনকে কতটা অগণতান্ত্রিকভাবে স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল? রাস্তায় গজাল পুঁতে, বার্বড ওয়ার দিয়ে ঘিরে, বিদ্যুৎ কেটে, জল বন্ধ করে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা মনে নেই? মনে নেই মন্ত্রীপুত্র আন্দোলনকারীদের তেনার থর গাড়ির চাকার তলায় পিষে মেরেছিলেন? সেই বিজেপি আজ হঠাৎ ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারে না এমন এক ভাব দেখিয়ে বলছেন, এ রাজ্যে গণতন্ত্র বিপন্ন? বিজেপি, যার ডিএনএ-তে গণতন্ত্র নেই, জাতির পিতাকে হত্যা যারা করেছে তাদের উত্তরাধিকারিরা আজ গণতন্ত্রের কথা বলছে? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে বিজেপি কিছুদিন আগেই ত্রিপুরাতে বিরোধীদের জনসভা করার অনুমতি দেয় নি। যে বিজেপি মাত্র ক’দিন আগেই দিল্লিতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের জনসভা করার অনুমতি দেয়নি, তারাই আজ ভিক্টোরিয়ার সামনে জনসভা করার অনুমতি না পেয়ে বলছে গণতন্ত্র বিপন্ন, আপনারা কী বলবেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই এক মজা। বহু শাসক গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেন, আর তার পরিণাম ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কোনও মানুষকে মেরে উলঙ্গ করে ল্যাম্পপোস্টে লটকে দেওয়া গণতন্ত্র তো নয়ই, সাধারণ মানবিকতা বোধের বিরোধী। কিন্তু ইটালিতে স্বৈরাচারী শাসক মুসোলিনিকে ওইভাবেই ঝোলানো হয়েছিল, কেউ সেদিন গণতন্ত্রের কথা, মানবতার কথা বলেওনি ভাবেও নি। এরকম হয়, অগণতান্ত্রিক শাসনের শেষটা বড্ড অগণতান্ত্রিক ভাবেই হয়। কিন্তু এসবের পরেও আমরা আজও বলব, সাধারণ গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার মেনেই বিজেপিকেও ওইখানেই, ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হোক। একখানা জনসভার অনুমতির অছিলায় ভূতের মুখে রামনাম আমরা শুনতে চাই না।