অন্য কোথাও তেমন নয় কিন্তু প্রাথমিকভাবে ওই বনগাঁ, রানাঘাট ইত্যাদি মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজনদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেখানে সেখানে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৯ লাগু হয়ে যাওয়ার পরে উল্লসিত মানুষজনদের দেখেছিলাম আমরা ঢোল, ডঙ্কা, করতাল নিয়ে পথে নেমেছিলেন। আমাদের দেশটাই এমন, খুব সামান্য কিছু প্রাপ্তিও মানুষের নজর কাড়ে, ৫০০ টাকার খয়রাতি মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্বাচনী প্রচার মঞ্চ থেকে দেশের এক নতুন শ্রেণির মানুষের উদ্ভব হয়েছে বলে ঘোষণা করেন, তাঁরা হলেন লাভ্যার্থী, কী লাভ হয় তাদের? মাসে ৬ কেজি গম, আটা কখনও সখনও তেল। আহা কী আনন্দ, ঘরে আজ পেটভর্তি খাবার। ওদিকে দেড় কোটি টাকার শাড়ি আর ১৩ কোটি টাকার ঘড়ি পরে আম্বানি পুত্র আর পুত্রবধু খবরের কাগজের প্রথম পাতায়, লুকিয়ে ছুপিয়ে নয়, প্রকাশ্যেই সম্পদের এই অশ্লীল প্রদর্শনী চলছে। সেই দেশেই হঠাৎ এক ঘোষণা হয়, সবসে উঁচা রাম মন্দির বনেগা, মানুষের চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, বানানো নয়, সত্যি। সেই দেশে এক আইন পাশ হল, আইন সভাতে আইন পাশ হল, সেখানে বসে আছেন কারা? দেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। আবার সেই ভোটারদের এক বড় অংশ এই বাংলা, অসম, দিল্লি, ছত্তিশগড়, বিভিন্ন রাজ্যে আছেন, যাঁরা নাকি নাগরিক নন, অন্তত সেটাই মনে করে আমাদের সরকার, তাই তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আইন এনেছেন তাঁরা। মজার কথা হল সেই আইন এসেছিল এক নতুন সরকার আসার পরে। সেই সরকার যাওয়ার মুখে আরেক নির্বাচনের আগে চার বছর তিন মাস পরে সেই আইনকে লাগু করার কথা ঘোষণা হল এবং সেই ঘোষণার পরে আমাদের রাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজনের এক অংশের উল্লাস আমরা দেখলাম। অবশ্য প্রাথমিকভাবে সেই উল্লাসের পরে আবার নানান প্রশ্ন উঠছে, উল্লসিত মানুষজনের মাথায় চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। মতুয়া মানুষজনের মাথায় কিছু দুষ্টু মানুষ একটা প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছেন, আর সেটাই বিষয় আজকে, শান্তনু ঠাকুর, সাংসদ, নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন? সত্যিটা জানুন।
মতুয়ারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন? না, সবাই নয়, এদেশেও বহু মতুয়া ভক্ত ছিলেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ঠাকুর পরিবারের প্রত্যেকেই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তা নিয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই, এ তো তাঁদের বইপত্রেই বলা আছে। তাহলে সবথেকে আগে তো যিনি এই সিএএ লাগু করে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজটি করেছেন বলে দাবি করছেন, তিনি কি নিজে ওই ৫০ টাকার ফর্ম ভরে আবেদন করেছেন। জানিয়েছেন যে আমি আদতে বাংলাদেশের নাগরিক, আমাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। কারণ আইন তো সাধারণ মতুয়া যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বা ওই শান্তনু ঠাকুরের মধ্যে কোনও ফারাক দেখে না। করেননি। তাহলে অন্যদের বলছেন কেন? সাধারণ মতুয়া ভক্তরা সেই প্রশ্ন করছেন না কেন?
আরও পড়ুন: Aajke | বাম + কংগ্রেস + আইএসএফ জোট হচ্ছে?
গিয়ে জিজ্ঞেস করুন সাংসদ মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরকে, আপনি ওই ফর্ম ভরছেন না কেন। জানি উনি বলবেন ওনার পাসপোর্ট আছে, ভোটার কার্ড আছে, আধার কার্ড আছে, উনি তো দেশের নাগরিক। আমরাও তো তাইই বলছি, সাধারণ মতুয়া ভক্তদেরও অনেকের পাসপোর্ট আছে, সবার আধার কার্ড আছে, রেশন কার্ড আছে, ভোটার কার্ড আছে, তাহলে তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে কেন? আসলে উনি আবেদন করবেন না, করতে পারবেন না কারণ যে মুহূর্তে উনি ৫০ টাকা দিয়ে ওই ফর্মটি ফিল আপ করছেন, সেই মুহূর্তে তিনি এদেশের নাগরিক নন। তার মানে প্রকারান্তরে তাঁকে স্বীকার করে নিতে হবে যে নির্বাচনের সময় প্রার্থীপদের আবেদনপত্রতে নিজেকে তিনি ভারতীয় বলেছিলেন তা ছিল মিথ্যে তথ্য, এখনই তাঁর সাংসদ পদ কেবল খারিজ হবে না তাঁকে জেলে যেতে হবে, কারণ আইনত কোনও বিদেশি আমাদের দেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না এবং মিথ্যে তথ্য দেওয়াটা আইনত অপরাধ। দুই হল, তিনি নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলবেন এবং তার সপক্ষে তাঁকে একটা কাগজ দেখাতে হবে, কোন কাগজ দেখাবেন? তিনি যে ধর্মীয় নিপীড়নের জন্যই এদেশে চলে এসেছিলেন, সেটা বললে তার সপক্ষেও তাঁকে প্রমাণ দেখাতে হবে। তিনি সেটাও দেখাতে পারবেন না। অতএব সেসব কাগজপত্র জোগাড় করতেও তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত মাস তিন চার, তার মানে এবারের নির্বাচনও লড়া হয়ে উঠবে না। ঠিক সেই জন্যই তিনি ওই ৫০ টাকা দিয়ে নাগরিকত্বের আবেদনপত্র জমা করবেন না, কিন্তু সাধারণ মতুয়াদের করতে বলছেন, কিছু সাধারণ মতুয়া ভক্ত মানুষজন তাতে উল্লসিত। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যদি মতুয়ারা এদেশের নাগরিক না হন তাহলে তাঁদের গুরুবংশের শান্তনু ঠাকুরও তো এদেশের নাগরিক নন। আর যদি তিনি নাগরিক না-ই হন তাহলে তিনি কীভাবে গত নির্বাচনে নিজেকে দেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করে প্রার্থীপদের আবেদনপত্র দাখিল করেছিলেন? কেন তিনি নিজে এখনও নতুন আইনের ধারা অনুযায়ী ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করেননি? শুনুন কী বলছেন মানুষজন।
নাগরিকত্ব নিয়ে আরএসএস–বিজেপি, মোদি–শাহ চিন্তিত নয়, তাঁদের লক্ষ্য হল তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণের উপর ভর করে এক মধ্যযুগীয় শাসন কায়েম করা। কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের বোঝাতে হবে যে আমাদের দেশ এক হিন্দু রাষ্ট্র, এখানে মুসলমান বা অন্যান্য সংখ্যালঘুরা আদতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ৮০ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যার ৭০-৮০ শতাংশের সমর্থন জোগাড় করতে পারলেই এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখছেন মোদি শাহ। হয়নি, হবেও না। মানুষকে কিছুদিন বোকা বানানোই যায়, চিরদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। শান্তনু ঠাকুরের মিথ্যাচার ধরা পড়বে, আজ না হয় কাল।