এমনিতে বিজেপিতে যাওয়ার এক সহজ উপায় হল তীব্র ঘৃণা ছড়াতে পারা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা, মহিলাদের অসন্মান করা, এমন মানুষের সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা মিথ্যে, যাঁর সম্পর্কে দুটো কথা বলার জন্যও প্রচুর শিক্ষার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই গুণগুলো থাকলে খুব তাড়াতাড়ি বিজেপিতে একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নেওয়া যায়। এমনটা নয় যে এটাই বিজেপির ইতিহাস, শুরু থেকেই বিজেপিতে উঁচু জায়গায় চলে যাওয়ার এগুলোই মূলমন্ত্র। না, এমনটা নয়, এই ফিনোমেনন খুব নতুন, ২০১৪-র পর থেকে এগুলো শুরু হয়েছে। গডসে একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন, বললেন একজন এলেবেলে কর্মী নন, সাধারণ নেতাও নন, সাংসদ, তিনি এখন স্টার ক্যাম্পেনার। একজন সাংসদ, তিনি আবার মহন্ত, সবে জিতেছেন জয়পুর থেকে, জিতেই জানিয়ে দিয়েছেন রাস্তার ধারে যাঁরা মাছ মাংসে দোকান নিয়ে বসেছেন তাঁরা আর বসতে পারবেন না। একজন সাংসদ সংসদে বসেই মুসলমানদের যে ভাষায় সম্বোধন করলেন তা আমরা প্রকাশ্যে বলতে পারব না। সেই রমেশ বিধুরি রাজস্থান নির্বাচনে স্টার ক্যাম্পেনার কেবল নয়, বড় দায়িত্বে ছিলেন। অমিত শাহ সংসদে বসেই কাশ্মীর প্রশ্নে জওহরলাল কী কী ভুল করেছিলেন তা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। এরা স্বাধীনতার সময়ে ব্রিটিশদের দালালি করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশদের হাতে, মুচলেকা দিয়েছে বারবার। সেই তাঁরা আজ জওহরলাল নেহরুর ভুল ধরছেন, সংসদেই। তো সেই পথ ধরেই আরও এক হেট মাস্টার গিরিরাজ কিশোর, মন্ত্রী সাংসদ, গতকাল বলেছেন মমতা ফিল্মস্টারদের সঙ্গে নাচছেন, এটা ওনাকে শোভা দেয় না। একজন স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ কী খাবে, কী পরবে, নাচবে না গাইবে সেটা ঠিক করে দেবে এই বিজেপি? সেটাই বিষয় আজকে, কে নাচবে, কে গাইবে, সেটা ঠিক করে দেবে বিজেপি?
ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অভিনেতা অভিনেত্রীরা এসেছেন, আগে এই ফেস্টিভ্যাল ছিল ফিল্ম বাফদের জন্য। গোদার, ত্রুফো, ফেলিনি, যাঁরা ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনো করেন এবং গভীরভাবে বিশ্বের চলচিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন তাঁদের সমাবেশ হত। ঠিক ফেস্টিভ্যাল নয়, এক উৎসব নয়, তাকে আমরা ফিল্ম চর্চার এক ইভেন্ট হিসেবেই দেখতাম। পালাবদলের পরে তা উৎসব হয়ে উঠল। নামী দামি ফিল্মস্টার, বাংলার, মুম্বইয়ের এসে হাজির, তাঁদের এক ঝলক দেখতে মানুষও হাজির। আবার পাশাপাশি একেবারে ভালো ছবি দেখানো হচ্ছে না তাও নয়, কিন্তু অনেক বেশি মানুষের উৎসব হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: Aajke | সিপিএম আর তৃণমূল একই সুরে কথা বলছে
যাঁদের ভালো লাগছে তাঁরা সবাই এক্কেবারে আম আদমিও নন, আবার কিছু লোকের বিচ্ছিন্নতা পছন্দ, তাঁদের ভালো লাগছে না। কিন্তু বিজেপির গিরিরাজ কিশোর কি সেই আঁতেল চলচ্চিত্রপ্রেমীদের প্রতিনিধি? একেবারেই নয়, ওনার অভিমত, মহিলা মুখ্যমন্ত্রী এসব নাচাগানায় কেন? রাজ্যের কাজ করুন, রাজ্যের সমস্যা দেখুন, ফিল্মস্টারদের সঙ্গে কেন? সে হক আর ধক তো আছে আমাদের ফকিরের, তিনি মুম্বই ফিল্ম স্টারদের সঙ্গে সেলফি তুলে পোস্ট করবেন, বিষ ছড়ানো ফিল্ম কাশ্মীর ফাইলস-এর প্রোপাগান্ডা করবেন, ভুলেই যাবেন দেশের এক প্রান্তে মহিলাদের নগ্ন করে, ধর্ষণ করে প্যারেড করানো হচ্ছে, সেদিকে চোখও ফেরাবেন না। তখন ওনার মাথায় দ্য কেরালা স্টোরি, এ অধিকার তো কেবল চওকিদারের আছে। অধিকার আছে যোগীজির যিনি গোটা বলিউডকে ডেকে নিজের রাজ্যে যাতে ব্যবসা আসে তার বন্দোবস্ত করবেন। কিন্তু একই কাজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করলে এ রাজ্যের খোকাবাবু থেকে সাংসদ মন্ত্রী গিরিরাজ কিশোর এক গলায় কেবল নিন্দা করবেন না, কটু মন্তব্য করবে। আসলে ওনাদের দর্শনেই এটা আছে, ওনারা তো চান মহিলারা রান্নাঘরেই থাকুক, সন্তান প্রতিপালনে মন দিক, ওনাদের এটাই তো লক্ষ্য, সেটাই ওনারা প্রকাশ করছেন। এভাবেই কিছু ধর্মান্ধদের হাতে পড়ে, আরও পরিষ্কার করে বললে ধর্মীয় মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়লে দেশ, সমাজ রসাতলে যায়। আফগানিস্তানের দিকে তাকান, সে দেশে মহিলারা একসময় ওয়ার্কফোর্সের ৫৭ শতাংশ হয়ে উঠেছিল। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি ছিল, এক ধর্মীয় মৌলবাদ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার মুখে। ইরানের দিকে তাকান, একই অবস্থা। এই একই ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে জোয়ান অফ আর্ককে জ্যান্ত পুড়ে মরতে হয়েছিল, একই মৌলবাদীরা মহিলাদের বেদ পাঠ বন্ধ করেছিল, মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। আজ আবার সেই মৌলবাদীরা উঠে দাঁড়িয়েছে, আজ আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বিজেপির সাংসদ যে কথা বলার সাহস পেলেন তা একদিনেই হয়নি, আমাদের হীরণ্ময় নীরবতাই তাঁকে সাহস জুগিয়েছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিজেপি সাংসদ গিরিরাজ কিশোর বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সলমনের সঙ্গে নাচছেন, এটা তাঁর শোভা দেয় না, তার মানে কে কী খাবে, কে কী পরবে তো ছিলই এখন কে কার সঙ্গে গান গাইবে বা নাচবে সেটাও কি বিজেপিই ঠিক করবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এক উদার বহুস্বরের সমাজকে এক কদর্য মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি, আরএসএস। যে সমাজে মহিলাদের রান্নাঘর আর সন্তান প্রতিপালনেই সময় কেটে যাবে, যে দেশে বেদ নিয়ে বাঘা বাঘা মুনি ঋষিদের সঙ্গে বিতর্কে নেমেছেন ঘোষা, লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, সেই দেশে মহিলাদের সম্বন্ধে যারা এই ধরনের কথা বলতে পারে তারা আর যাই হোক সেই সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে না।