দিন দুই আগেই চার রাজ্যের ফলাফল বের হওয়ার পরে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূল নেত্রী সাফ জানিয়েছেন, এটা বিজেপির জয় নয়, কংগ্রেসের পরাজয়। কংগ্রেস তাদের আত্মম্ভরিতা ছেড়ে যদি আসন সমঝোতা করত, তাহলে এই হার এড়ানো যেত। তো এই কথা শুনেই বহরমপুরের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো এই চার রাজ্যে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার আবেদন পর্যন্ত করেননি, আজ এসব কথা বলছেন কেন? অবশ্য এ বাংলাতে ওনার কথার মূল্যই বা কতটুকু? আগামী কাল রাহুল-সোনিয়া জোট চাইলে ওনাকেই কালীঘাটে যেতে হবে, হেঁ হেঁ করে হাসতেও হবে। তাহলে ওনার কথা কেন এল? এল কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কথাগুলো বলার পরের দিনে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী, সিপিএম দলের পলিটব্যুরো নেতা পিনারাই বিজয়ন হুবহু একই কথাই বলেছেন। উনিও বলেছেন, “কংগ্রেস যদি সিট শেয়ারিং করত তাহলে এই হাল হত না, ওরা ক্ষমতালোভী, সব ওরা একা পাবে। এই কারণেই ওদের পতন হয়েছে।” এবং অধীররঞ্জন চৌধুরী, বহরমপুরর কংগ্রেস নেতা এটাও জানেন যে এই চার রাজ্যের চার রাজ্যেই সিপিএম লড়েছে, রাজস্থানের ১৭টা আসনের ১৫টাতেই সিপিএম-এর লড়াই ছিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, তাদের প্রচার স্বাভাবিকভাবেই ছিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্তু উনি তা নিয়ে একটাও কথা বলবেন না। কারণ কং–তৃণমূল জোট ভেস্তে দেওয়ার এক মহাদায়িত্ব ওনার কাঁধেই তো রয়েছে। আজ সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, সিপিএম আর তৃণমূল একই সুরে কথা বলছে।
দেশের রাজনীতিতে এখন এক সাড়ে বত্রিশভাজা সার্কাস চলছে। এক ধারের সার্কাস সংবিধানকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার, সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলার, কেবল বুকনি দিয়ে দেশ চালানোর। অন্যদিকে দুর্নীতির সার্কাস, নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ির সার্কাস, আদর্শহীনতার এক অপূর্ব সার্কাস চলছে। আপনি এই বাংলাতে তৃণমূল আর সিপিএম-এর লড়াইকে যদি সাপ আর নেউলের মতো করেই দেখেন, খুব ভুল করবেন কি? না, এক্কেবারেই নয়, তারচেয়েও হিংস্র সে লড়াই। সামাজিক মাধ্যমে দু’ দলের সমর্থকরা একে অন্যকে বা তাদের বিরুদ্ধ মতকে যে ভাষায় আক্রমণ করছেন, তা বিজেপির ট্রোলবাহিনীর চেয়ে তো কম নয়। এবং এই বাংলাতেই গলায় গলায় বন্ধুত্ব কং–বামের। পতাকা একসঙ্গে বেঁধে টাঙানো হয় গাছে গাছে।
আরও পড়ুন: Aajke | দেশের বড় শহরের মধ্যে কলকাতায় অপরাধ সবচেয়ে কম, শুভেন্দু শুনছেন?
এবার চলে যান কেরলে, কেরল জুড়ে রাজনৈতিক লড়াই শুধু নয় মারপিট, খুনোখুনি, আইন আদালত চলছে মূলত কংগ্রেস আর বামেদের। একদল অন্যদলকে বিজেপির বি টিম বলছে। যে কথা কেরলের পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, হুবহু সে কথা ত্রিপুরাতে মানিক সরকারও বলেছেন। সেখানে আবার আরেক অবস্থা, খাতায় কলমে ত্রিপুরাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট আছে, বাংলায় সত্যি জোট আছে আর কেরলে সত্যিই লড়াই আছে। আর সেই জন্যই মাঝেমধ্যেই এ রাজ্যের তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে, কেরলের সিপিএম পলিটব্যুরো নেতার বক্তব্য খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। মানুষ চূড়ান্ত বিভ্রান্ত, তার উপরে আবার কমরেড ইয়েচুরি নাকি রাহুলের ফিলোজফার, মেন্টর অ্যান্ড গাইড। ইন্ডিয়া জোটে তৃণমূল নেত্রী আর সিপিএম নেতার হাস্যমুখর ছবিও ছাপা হয়। কিন্তু দুই দলই মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষের সামনে একে অন্যের বাপবাপান্ত করেই চলেছে। কোনওভাবেই তাদের কোনও জোট অসম্ভব, দুটো দলই জানে, তাই ভোট আসার আগেই সমস্ত অস্ত্রে শান দিয়ে প্রতিদিন নিয়ম করে একে অন্যকে অক্রমণ করে চলে। কিন্তু পাবলিক? মানে আম জনগণ? মোদি সমর্থক জনগণ, আরএসএস–বিজেপি কর্মী নেতারা এই সাড়ে বত্রিশ ভাজা জোটের একবার এধার একবার ওধারের কথা শুনে আনন্দিত, জানি। কিন্তু সেই তাঁরা? যাঁরা বহুস্বরের কথা বলেন, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, যাঁরা ধর্মকে এক ব্যক্তিগত আচরণ বলে মনে করেন এবং এই ধারণার থেকেই যাঁরা আরএসএস–বিজেপি রাজত্বের অবসান চান, তাঁদের অবস্থার কথা ভাবুন, তাঁরা কতটা বিভ্রান্ত, কতটা অসহায়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, চার রাজ্যের নির্বাচনে পরাজয় নিয়ে সিপিএম আর তৃণমূল দলের বিশ্লেষণ এক। দুটো দলই মনে করে কংগ্রেসের অহংবোধ, কংগ্রেস নেতাদের আসন ভাগাভাগি না করতে চাওয়ার ফলেই চার রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপিই জিতে গেছে। আপনাদের কী মত? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
আসলে তৃণমূল নেত্রী এবং সিপিএম নেতা পিনারাই বিজয়ন খুব বাস্তব অবস্থার কথাই বলেছেন, এই বলার মধ্যে তাঁদের বাস্তব বোধই ফুটে উঠেছে। একই কথা সমাজবাদী দল বলেছে, ইন্ডিয়া জোটের অনেকেই আবার প্রকাশ্যে বলেননি, কিন্তু এটাই মনে করেন যে কংগ্রেস তার জমিদারি মেজাজ ছেড়ে মাটিতে নামুক। বাস্তব অবস্থা বুঝেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক আসন সমঝোতা হোক। যতটা সম্ভব হোক, সেটা আটকানোর জন্য কিছু কংগ্রেসি নেতা তাঁদের ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মাঠে আছেন, সেই তাঁদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দিয়েই এই জোট এক নির্বাচনী জোট হয়ে উঠুক, আরএসএস–বিজেপি বিরোধী মানুষজন এটাই চায়।