১৯৭৮-এ রাজস্থান বনাম বালিয়া মামলা চলছিল সুপ্রিম কোর্টে। জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের বেঞ্চ থেকে এসেছিল জামিন নিয়ে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার সার কথাটা। তিনি বলেছিলেন, বেল ইজ রুল, জেল ইজ এক্সেপশন। জামিন দেওয়াটাই নিয়ম, জেলে রাখাটা নিয়মের বাইরের ব্যাপার। কিন্তু সে সব তো সভ্য সমাজের কাজ কারবারের কথা। এখন জেলটাই নিয়ম কখনও সখনও জামিন দেওয়া হয়। পাঁচ বছর জেলে থাকার পরে একটা সামান্য অপরাধের প্রমাণ না পাওয়ার পরে নিঃশর্ত মুক্তি পেলেন একজন হুইল চেয়ারে বসা প্রতিবন্ধী শিক্ষক, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর জি এন সাইবাবা। না, বেল দেওয়া হয়নি। বেল দেওয়া হয়নি অশীতিপর জেসুইট চার্চের ফাদার স্ট্যান স্বামীকে, তিনি অসুস্থ হয়ে জেলেই মারা গেছেন।
ধরুন ইডি আপনাকে একটা মামলাতে ধরল, কিছুদিন পরে একটা চার্জশিট দিল, সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট, তারপর আবার একটা, তারপর আবার একটা, কোনওটাই প্রমাণিত হচ্ছে না কিন্তু নতুন নতুন অপরাধের তালিকা সংযোজিত হচ্ছে, আপনাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না আপনি জেলেই পচে মরুন। এটাই কার্যপদ্ধতি। নকশাল আমলে এ বাংলাতে এরকম একটা ব্যাপার খুব চালু ছিল, নকশাল বলে একজনকে কৃষ্ণনগরের একটা মামলাতে ধরা হল, যেদিন ছেলেটি জামিন পেল, ঠিক সেই দিন আদালত চত্বরেই তাকে ক্যানিংয়ের আর একটা মামলাতে ধরা হল। মানে জেলে পচে মরো। ঝাড়খণ্ডে বেআইনি খনন এবং সেই টাকার অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে জেলে রয়েছেন প্রেম প্রকাশ, গত ১৮ মাস ধরে তিনি জেলে এবং জামিন নাকচ হয়ে যাচ্ছে। ইডির হাতে রয়েছে পিএমএলএ-র ৪৫ নম্বর ধারা, যতক্ষণ না ইডি স্পেশাল কোর্ট মনে করছে আটক মানুষটি অপরাধে জড়িত নন বা বাইরে গেলেও অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করবেন না ততক্ষণ তারা জামিন না দিয়েই সেই অভিযুক্তকে আটক রাখতে পারে।
আরও পড়ুন: কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট (পর্ব ২৭)
হিসেব খুব সোজা, আপনি জেলে বসেই যোগাযোগ করে নিন, মোটা ভাইদের সঙ্গে বা তাঁদের সাকরেদদের সঙ্গে, তারপর বলুন ভুল হয়ে গেছে। জেল থেকে বেরিয়েই মুরলীধর লেনে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দেব, সরকার মোদি-শাহ, আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে কিচ্ছুটি বলব না, যা বলব গান্ধী নেহরু ইন্দিরা রাজীব সোনিয়া রাহুলের বিরুদ্ধে বলব। ব্যস, মিটে গেল। অমনি ইডি কর্তারা বুঝে যাবে আপনি জেল থেকে বের হয়ে লক্ষ্মীছেলেটি বনে যাবেন। আপনার জামিন হবে। আর না হলে থাকুন, কালেচক্রে জামিন হলে আবার ক’দিন পরে দফতরে কর্তারা হানা দেবেন, আবার জেল। সেইখানেই একটা মোক্ষম আঘাত এল, জাস্টিস খান্না আর জাস্টিস দত্তের বেঞ্চে বিচার চলাকালীন বিচারপতিরা জানালেন পিএমএলএ-র ৪৫ ধারার চেয়ে সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে এক নাগরিকের মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকার দেওয়া আছে। একজন মানুষকে দিনের পর দিন জেলে রেখে দেওয়া যায় না। তাঁরা ইডি-সিবিআই-এর কাজের ধরন আর উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। আমরা এই কথাই তো বার বার বলে আসছি, এক জেল খাটা আসামির অভিযোগের ভিত্তিতে বড়জোর একটা তদন্ত শুরু হতে পারে কিন্তু সেই ভুয়ো অভিযোগের ভিত্তিতে একটা মানুষকে দিনের পর দিন জেলে রেখে দেওয়াটা সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের বিরোধী, আমরা সেই কারণের বিচার চাইছি, সুবিচার চাইছি, কলকাতা টিভির জন্য, কৌস্তুভ রায়ের জন্য।
দেখুন ভিডিও: