বেশ কয়েক বছর আগে জম্মু কাশ্মীরে পর্যটকদের বাসের ওপর জঙ্গি হামলায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছিল। জখমও হন কয়েকজন। হতাহতদের মধ্যে দু’চারজন বাঙালিও ছিলেন। এই প্রসঙ্গেই প্রয়াত জ্যোতি বসুকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জ্যোতিবাবু জবাব দিয়েছিলেন, ওরা যায় কেন? যাওয়ার দরকার কী?
আরও পড়ুন: ভারতে ডেল্টা প্লাসে আক্রান্ত বেড়ে ৪০
বহু বছর পর আবার অন্য একটি প্রসঙ্গে জ্যোতিবাবুর সেই মন্তব্যের কথা মনে পড়ল। সারা দেশে যখন বিশেষজ্ঞরা করোনার তৃতীয় তরঙ্গ নিয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, ডেল্টা প্লাসের সংক্রমণের সাবধানবাণী দিচ্ছেন, তখন দেখা যাচ্ছে, বহু মানুষ পুজোয় বেড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। রাজ্যের মধ্যে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার ঝোঁক বেশি। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে উত্তরবঙ্গমুখী ট্রেনের টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে। সেখানকার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে থাকার জন্য বুকিংও চলছে। শহর কলকাতার পর্যটন সংস্থাগুলির অফিসেও ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশে এই মুহূর্তে করোনার সংক্রমণ নিম্নমুখী। অনেক রাজ্য লকডাউন শিথিল করছে। কোথাও কোথাও লকডাউন তুলেও নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বিধিনিষেধ একটু শিথিল হতেই মানুষ দলে দলে বেরিয়ে পড়ছে। রাস্তাঘাটে, হাটে বাজারে, মল, রেস্তোরাঁয় ভিড় বাড়ছে। লোকজন দূরত্ব-বিধি মানছেন না। দিল্লি এইমসের অধিকর্তা রণদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, লকডাউন শিথিল হতেই যেভাবে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে, তাতে তৃতীয় তরঙ্গ আসতে বাধ্য। এখন থেকে সতর্ক না হলে ওই ঢেউ সামলানো যাবে না। রাজ্যের চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরাও তৃতীয় ঢেউ নিয়ে চিন্তিত। তাঁরাও ডাঃ গুলেরিয়ার মতোই বলছেন, এখনই সতর্ক না হলে মহা বিপদের আশঙ্কা। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আরও পড়ুন: দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ছাড়াল
হুজুগে বাঙালির আদিখ্যেতা দেখে মনে হচ্ছে না, তাঁরা করোনার তৃতীয় ঢেউ বা ডেল্টা প্লাসের সংক্রমণ নিয়ে আদৌ ভাবিত। করোনার প্রথম ঢেউ স্তিমিত হওয়ার পর গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে বহু মানুষ ছোটখাটো ট্যুরে বেরিয়ে পড়েছিল। দিঘা, মন্দারমণিতে সপ্তাহান্তে ভিড় উপচে পড়েছিল। পরিচিত অনেকেই এখানে ওখানে ঘুরতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তাঁদের মধ্যে অনেকে করোনায় আক্রান্তও হন। এক দিল্লীবাসী আত্মীয় বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন সপরিবার। ফিরে এসে করোনায় আক্রান্ত হন পরিবারের গৃহিণী। সকলেরই এক কথা, আর পারা যাচ্ছিল না। এক বছর ধরে ঘরবন্দি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছিলাম।
ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে তো রাজ্যে ভোটের দামামা বেজে গেল। আছড়ে পড়ল দ্বিতীয় ঢেউ। তার পরিণাম আমরা দেখলাম। তাতেও আমাদের শিক্ষা হল কি? দিন কয়েক আগেই দিল্লি এইমসের অধিকর্তা সতর্ক করে বলেছিলেন, দেশের মানুষ শিক্ষা নিচ্ছে না। এর ফল ভুগতে হবে। এই যে তৃতীয় ঢেউয়ের তোয়াক্কা না করে বাঙালি বেড়ানোর ছক কষছে, তার ফলও যে কী ভয়ানক হবে, তা আমরা টের পাব পরে।
অবশ্য অনেকে বলতে পারেন, এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে অন্য কারও নাক গলানো উচিত নয়। ঠিকই। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে কোথায় কবে বেড়াতে যাবে, এটা একান্তই কারও ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে দেখা জরুরি। অগ্রাধিকার কোনটাকে দেওয়া হবে? বেড়ানো আগে না জীবন আগে? বেড়ানো তো অপেক্ষা করতে পারে। জীবন কিন্তু অপেক্ষা করবে না। করোনাও কারও জন্য প্রতীক্ষায় থাকবে না। এই সঙ্কটকালে আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে। তা না হলে ঘোর বিপদ। এই করোনাকালে আর একবার মনে পড়ল জ্যোতিবাবুর সেই মন্তব্য, ওরা যায় কেন?
আরও কিছুদিন তো সবুর করা যেতেই পারে। বেড়ানো হারিয়ে যাবে না। হারাবে মূল্যবান জীবন।