কলকাতা: দীর্ঘ দুবছর চার মাস জেল খাটার পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান (Journalist Siddique Kappan)। সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাপ্পান জানিয়েছেন, তাঁর উপর কী পরিমাণ অত্যাচার করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে মাওবাদী (maoist link) যোগ স্বীকার করার জন্য কীভাবে মানসিক চাপ (mental torture) দেওয়া হয়েছে। গত দু’বছরের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ৪৩ বছরের এই সাহসী সাংবাদিকের মন্তব্য, ভারতে সাংবাদিকতা (journalism in India) এখন বিপদের মুখে।
কাপ্পান যে একচুলও বাড়িয়ে বলেননি, তা বোঝা যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউশনের (International Press Institution) এক রিপোর্টে। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, এই ছয় মাসে ভারতে ৮৩ টি সংবাদ স্বাধীনতা হরণের (press freedom violation) ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় নিরাপত্তার (national security) দোহাই দিয়ে শুধু এপ্রিল মাসেই কেন্দ্রীয় সরকার ২২টি ইউটিউব চ্যানেল (YouTube Channels) বন্ধ করে দিয়েছে। মে মাসে কাশ্মীরের একটি বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক অনলাইন মিডিয়া ফ্রি প্রেস কাশ্মীরকে হেনস্তা করা হয়েছে।
ওই সংস্থা আরও বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ২০ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার (Narendra Modi Government)। সব ঘটনাই বিজেপি শাসিত (BJP ruled states) রাজ্যগুলোতে ঘটেছে। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (UAPA) আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বিশিষ্ট সাংবাদিক ফাহাদ শাহকে (Fahad Shah) এই আইনেই ফাঁসিয়ে বহুবার গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্তত ১৮ জন সাংবাদিককে পুলিশ হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। গত বছরের মে মাসেই বেগুসরাইতে সুভাষ মাহাত নামে এক সাংবাদিক খুন হয়েছেন। আজ পর্যন্ত সেই খুনের তদন্ত একটুও এগোয়নি।
কাশ্মীরের বিশিষ্ট সাংবাদিক ফাহাদ শাহ
আইপিআই বলছে, মোদি সরকার সংবাদ মাধ্যমের মুখ বন্ধ করার জন্য অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কাশ্মীরে টানা ৫৫২দিন ধরে অনলাইন সেন্সরশিপ (online censorship) চালু করেছিল। উপত্যকায় মোবাইল, ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। মণিপুরেও (Manipur) পাঁচদিন সমস্ত যোগাযোগ স্তব্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার।
আরও পড়ুন: China Spy Balloon: চীনের ‘স্পাই বেলুন’ মিসাইল ছুড়ে নামাল আমেরিকা
মোদি সরকার যে পছন্দের বা তাঁবেদার ছাড়া আর কোনও সংবাদ মাধ্যমকে পছন্দ করে না, তার টাটকা উদাহরণ হল কলকাতা টিভি (Kolkata TV)। কলকাতা টিভি মোদি সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির তীব্র সমালোচক বলেই বারবার তাদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। গত দু’বছরে সেই নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়েই কলকাতা টিভির সম্প্রচার বন্ধের চেষ্টা করেছে সরকার। বিষয়টি এখন বিচারাধীন। কলকাতা টিভির অফিসে একাধিকবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হানা দিয়েছে। তবু কলকাতা টিভি মাথা নত করেনি।
আইপিআই তাদের রিপোর্টে আরও বলছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার উপর আক্রমণের ঘটনা এক উদ্বেগজনক অবনতির জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আসলে এই সরকার বা বিজেপি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের মুখ যেন তেন প্রকারে বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। কখনও সরাসরি হামলা চালিয়ে, কখনও আইন দিয়ে তারা এই কাজ করে চলেছে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সিদ্দিক কাপ্পান তাঁর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, হাথরাসের ধর্ষণ ও খুনের (Hathras Incident) ঘটনাকে চাপা দেওয়ার এবং সাম্প্রদায়িক বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার (UP Government)। তাই কখনও তাঁকে পিএফআই (PFI) সদস্য বা কখনও ভুয়ো সাংবাদিক (fake journalist) তকমা দিয়েছে। এমনকী মাওবাদী বা ইসলামিক জঙ্গি বানিয়ে দেওয়ারও কম চেষ্টা করেনি সরকার। এর পাশাপাশি জেলে তাঁর উপর যে অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছিল, তারও উল্লেখ করেছেন কাপ্পান।
তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা শুনে বারবারই মনে পড়ছে ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) আমলের সেই জরুরি অবস্থার (Emergency) কথা। মোদি জমানায় স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার জন্য যে কেন্দ্রের শাসকদল এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সিদ্দিকের অভিজ্ঞতা সেটাই ফের তুলে ধরেছে দেশবাসীর সামনে। তিনি একশো শতাংশ সত্যি কথাই বললেন যে, ভারতে সাংবাদিকতা এখন বিপদের মুখে। সত্যিই, ভারতে সাংবাদিকতা এখন চরম বিপদের মুখে।