ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝরনা
আয় আয় আয় আয় সে রসের সুধায় হৃদয় ভর-না
দুপুর আড়াইটে এখন। ময়দানের চিরপ্রসিদ্ধ বটতলা ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা ইস্টবেঙ্গল টেন্টের (East Bengal Tent) দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তার সওয়ারি হয়ে পুরোটা ঘুরে এলাম। তালতলা আর পুলিশ দুটো পরপর মাঠ জুড়ে লিগ ক্রিকেট চলছে। হকি লিগের হোর্ডিং ইস্টবেঙ্গলের বাইরে। কাস্টমস টেন্টের পাশ দিয়ে কোনাকুনি এগিয়ে গেলে মোহনবাগানের (Mohun Bagan) সামনেও তাই। সেই হকি হোর্ডিং। ইডেন ক্লাব হাউসের (Eden Club House) সামনে ভিড় থাকার প্রশ্ন নেই। দুটো টিম প্র্যাকটিস ও প্রেস কনফারেন্স ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভিড় না থাক, মৃদু জটলাও যে নেই। ক্লাবহাউস টিকিট (Clubhouse Ticket) নিয়ে দাবিদাওয়া নেই। ক্লাবহাউসের সামনে চমৎকার ফুলের ডেকরেশন ছাড়া বোঝার কোনও উপায় নেই যে ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেন্স (Eden Gardens) জোব চার্ণকের শহরের বিশেষ কোনও উপলক্ষের জন্য তৈরি হচ্ছে।
সেই রাম নেই। সেই অযোধ্যাও না। তেত্রিশ বছর আগের প্রাক রঞ্জি ফাইনাল (Ranji Trophy Final) শিহরণ হয়ত ক্রিকেট লোকেশন থেকে অতীতের মতো নেই। কিন্তু ইডেনের পাশ দিয়ে চক্কর দিতে দিতে ভাবছিলাম,বর্তমান সময়ের সঙ্গে পুরনোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নির্বাচনের যেমন সমস্যা, তেমনি রঞ্জি ফাইনাল ঘিরে সাবেকি আবেগ আর বর্তমানেরই কী করে পারস্পরিক তুলনা হয়? কী করে বাছবেন বাংলার সর্বকালের সেরা দলের মিডল অর্ডারে অশোক মালহোত্রা না মনোজ তেওয়ারি? শ্যামসুন্দর মিত্রকে এক কথায় নেবেন চাপের মুখে অবিশ্বাস্য অনুষ্টুপ মজুমদারের দাবি নিমেষে স্প্যামে পাঠিয়ে? একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়া অধ্যুষিত সময়ে লোকেশনকেন্দ্রিক উত্তেজনা না থাকা মানে অবধারিত আগ্রহের অভাব —কী করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে? অতীতে যারা বটতলার বাইরে দাঁড়িয়ে টিম চলে যাওয়ার পরেও সম্বরণ আবার ফিরবেন কিনা জল্পনায় মত্ত থাকত তাদের বংশধরেরা এখন যদি ল্যাপটপের সামনে বাংলার পুরনো ম্যাচগুলো ইউটিউবে নাড়াঘাঁটা করে, সে-ও তো ক্লাব হাউসের সামনে অদৃশ্য ভিড় জমাচ্ছে।
শুধু প্রেক্ষিতে বিশাল তফাৎ। তাৎপর্যের তফাৎ। এবং তা শুধু ৩৩ বছর আগে-পরের সময় বলে নয়। বাংলার রঞ্জি ফাইনালের সেবার প্রিভিউ লেখার আগে এক ইতিহাসবিদের বকুনি খেয়েছিলাম। আমার জিজ্ঞাস্য ছিল, রামায়ণের শবরী রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য দেখা করার জন্য আনুমানিক কত বছর অপেক্ষা করেছিল বলে মনে হয়? ইতিহাসবিদ নাতিদীর্ঘ বকুনিতে বলেছিলেন, মহাকাব্য ঘিরে মিথ আর কল্পনা যেখানে মিলে মিশে চুরচুর হয়ে যায় সেখানে এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই অবান্তর। আসলে বাংলার রঞ্জির জন্য ৫১ বছর হা হাহুতাশ করে বসে থাকার সঙ্গে শবরীর তিতিক্ষার তুলনা টানতে চেয়েছিলাম। মনে হত যতদিন না এই ট্রফিটা তার ক্যাবিনেটে ঢুকছে ,পরাধীন ক্রিকেট রাজ্য হিসেবে গ্লানির জীবন চলবে।
বঙ্গজ ক্রীড়ায় উৎসাহী ক্রিকেট – ইতিহাসবিদ মুহূর্তে বলে দেবে বাংলার প্রথম রঞ্জিজয় ১৯৩৮-৩৯ সালে। রঞ্জি ট্রফি চালু হওয়ার মাত্র চার বছর শুরু হওয়ার মধ্যে দক্ষিণ পাঞ্জাবকে হারিয়ে। কিন্তু তাতে ব্যাপক চোনা পড়ে থেকেছে সম্মিলিত ইংরেজ ও বাঙ্গালি একাদশ সেই কৃতিত্বে হাত দিয়েছিল বলে। চার্লস টেগার্ট তার সাতবছর আগে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তর্কযোগ্যভাবে কলকাতার সবচেয়ে যোগ্য এবং একই সঙ্গে কুখ্যাত পুলিশ কমিশনারের কুকীর্তির রেশ তখন বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন তখনও জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। সেই আবহে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন স্নাতক লংফিল্ডসহ ছয়জন সাহেবকে নিয়ে গড়া কীর্তি কী করে বাঙ্গালি মননে দোলা দিতে পারে? তাই ফাইনালজয়ী কার্তিক বসু – কমল ভট্টাচার্যরা রাজ্যের মানুষের হৃদয়ে কখনও শিবদাস-বিজয়দাস হননি।
আর তাই সম্বরণদের রঞ্জিজয় প্রকৃত অর্থে বাংলার প্রথম। বাংলা ক্রিকেটের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল সেই বিজয়। যা দশকান্তরের গঞ্জনার উপযুক্ত উত্তর দিয়ে পেরেছিল যে শুধু পঙ্কজ রায় নন। বাংলা দলগতভাবে ক্রিকেট খেলতে জানে। মনে রাখতে হবে প্রাক সৌরভ সময়। বলিউড যেমন বিদ্রুপ করে তখন উত্তম কুমার সহ বাংলার পুরুষ অভিনেতাদের বলত, রসগোল্লাবাবু। তেমনি বাঙ্গালি ক্রিকেটারের পরিচয় ছিল পালানোয় পিএইচডি। সেই ভূমিসজ্জা থেকে উঠে এসে দেশের সেরা ক্রিকেটারদের হারিয়ে রঞ্জিজয় ভাবাই যায় না। সৌরাষ্ট্রর কোনও কোহলি, বুমরা বা রোহিত নেই। কিন্তু ১৯৮৯-এর রঞ্জিজয়ী বাংলাকে নক আউট থেকে ভারতের তখনকার টিমের আদ্দেককে খেলতে হয়েছিল। ভাইস ক্যাপ্টেন রবি শাস্ত্রী। রাজু কুলকার্নি। লালচাঁদ রাজপুত। আরশাদ আয়ুব। রমন লম্বা। মনিন্দর সিংহ। সঞ্জীব শর্মা। অতুল ওয়াসন। মনোজ প্রভাকর। ফাইনালের আগে প্রভাকর খেলছেন কিনা নিয়ে জল্পনা ছড়িয়েছিল। ঢাকা-তে ফোন করে তাঁকে জিজ্ঞেস করায় অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন, “হা হা বাংলা ভাবছিল তো আমি খেলব না। এখন ওদের জানার সময় হয়েছে যে নিউ বল আমার হাতেই থাকবে। আর আবার ওরা পালাবে।” মতি নন্দী ততদিনে সক্রিয় ক্রিকেট সাংবাদিকতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবু সামান্য অনুরোধে যে প্রথম দিন লেখার জন্য ইডেন প্রেস বক্সে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম তার একটাই কারণ। ক্রিকেট ইতিহাসের জলজ্যান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন। রাজ্যের সম্ভাব্য গৌরবেও।
আবার লিখছি,পরিস্থিতি এবং পরিপ্রেক্ষিত বিচারে সম্বরণ-অরুণ লালদের রঞ্জি জয় কপিলের তিরাশির টিমের মতো ঐতিহাসিক এবং যতদিন এই প্রদেশে ক্রিকেট বেঁচে থাকবে ততদিন আলোচিত হবে। তা বলে উত্তরসূরিদের কৃতিত্বকে নিন্মগামী করার কোনও সুযোগ নেই। এরাও তো ইতিহাস ফিরিয়ে আনছে। সবুজ ঘাসে বাংলা স্বেচ্ছায় ফাইনাল খেলছে এ তো ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম স্টেডিয়ামের সবুজ উইকেটের ঐতিহ্যকে ফেরত আনা। যখন এখানে পিচ তৈরি করত সিসিএফসি মাঠের ইংরেজ মালি। যখন কংক্রিট স্ট্যান্ড এত বেশি হয়নি বলে অবারিত বয়ে যেত গঙ্গার হাওয়া। সবুজ ঘাসে স্বেচ্ছায় ফাইনাল খেলা মানে ব্যাটিং ইউনিটকেও ততটাই মনের জোর রাখতে হবে যে রকেটগুলো আমি সামলাতে পারব।
মনোজ তেওয়ারির নেতৃত্বে ব্যাটিং ইউনিট স্বেচ্ছায় সেই চাপ নিচ্ছে মানে তারা ইতিহাস তৈরিতে ব্যক্তিগত স্বার্থকে দূরে রাখতে প্রস্তুত। মনোজ এবং লক্ষ্মীর সম্মিলিত কাহিনিও কী রোমাঞ্চকর। বাংলা হারুক বা জিতুক, বঙ্গজ ক্রীড়া নথিপত্রে চিরকালীন থেকে যাওয়ার মতো। দ্বিতীয়জন অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি অবসরে চলে যেতে বাধ্য হন প্রথমজনের যথেষ্ট সহযোগিতা না পাওয়া। নতুন সময়ে তিক্ততার সেই পুরনো ইতিহাসের পাতাকে মাড়িয়ে গিয়ে দুই সিনিয়র কী চমৎকার ভাবেই না করেছেন নতুন ইতিহাসের বৃক্ষরোপণ।
লক্ষ্মীর প্রধান অভিযোগের পাত্র সাইরাজ বহুতুলের গুচ্ছের নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ ছিল বাংলা ক্রিকেট সম্পর্কে। আশা করা যায় ইন্টারনেটের যুগে বহুতুলে দূরে থেকেও কাছে রয়েছেন এবং দেখছেন বাংলা ক্রিকেটে আশ্চর্য যা সব ব্যাপার ঘটে তা আধুনিক মুম্বইতে মোটেও ঘটছে না। দেখছেন কোচের আদর্শ আচরণ তাঁর মতো টিমে এর তার দোষ ধরে বেড়ানো বা সিনিয়র ক্রিকেটারকে বলি করার মধ্যে নেই। আর সত্যি তো বাংলার কোচ-ক্যাপ্টেন মিলে নিজেদের মধ্যে যে জোট তৈরি করেছেন তাকে নবনীতা দেবসেনের লেখা মনে হয় –ভালোবাসার বারান্দা।
আইপিএলের যুগে। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মোটা অর্থের যুগে। তিনবার রঞ্জি ফাইনাল খেলে ব্যর্থ হওয়া রাজ্যের মন্ত্রী স্বপ্নের চূড়ান্ত দিগন্ত উন্মোচনে গোটা সিজন জুড়ে খাটছেন গঙ্গার ধারের কেবিনে বসে না থেকে –কবে হয়েছে? কোথায় হয়েছে? কখনও হয়েছে? অরুণ লাল তো ঠিকই বলেছেন যে শচীনের জন্য যেমন দু’হাজার এগারো বিশ্বকাপ জেতার শপথ নিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। তেমনি টিম বেঙ্গলের অঙ্গীকার করা উচিত, ক্যাপ্টেন মনোজ আপনাকে আমরা এটা দেব!
ক্রিকেটের সঙ্গে বসন্তের আলাদা কোনও রোমান্টিসিজম নেই। যদিও কার্ডাস লিখেছিলেন, ফ্র্যাঙ্ক উলি স্কোয়ার কাট মানে বসন্ত এসে গিয়েছে। বাঙালির একান্ত আপন স্টেডিয়াম ঘটনাচক্রে তার সর্বোত্তম দুই প্রহর-ই দেখেছে বসন্তে। একটায় সে স্টিভ ওয় বাহিনীকে হারায়। অন্যটায় কীর্তি আজাদের দিল্লির দর্পচূর্ণ করে। আবার যেন ময়দানে উড়ে আসা ক্রিকেট বসন্তের আবির প্রাক দোলযাত্রা রাঙিয়ে দেয় রঞ্জি ট্রফিকে। নবীন সাংবাদিক ম্যাচ শেষে যাতে রবি ঠাকুরে অভিব্যক্তি খুঁজে পায় —
বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা
বইল প্রাণে দক্ষিণ হাওয়া আগুনজ্বালা।