কলকাতা: ১৬০ দিন পার, তবু অধরা জামিন। শুনানির শেষ পর্বে হঠাৎ ইডির আইনজীবীর মনগড়া সওয়াল। আদালতে নথি দিতে ব্যর্থ ইডি। কলকাতা হাইকোর্টের (Calcutta High Court) ভর্ৎসনার মুখে ইডির আইনজীবীরা। শুক্রবার কৌস্তুভ রায়ের (Kaustuv Roy) জামিনের (Bail) মামলার শুনানির ১৪ তম দিন ছিল। আদালত সূত্রে খবর, বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ আদালতে ঘোষণাও করেছিলেন এদিন তিনি শুনানি শেষ করে রায়দান করবেন। বিচারপতির মন্তব্য, আমার বিবেচনায় এই গ্রেফতার অগ্রিম গ্রেফতার। নথি খতিয়ে না দেখেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
কৌস্তুভ রায়ের আইনজীবী ওয়াই জে দস্তুর বলেন, পিনকনের বিজ্ঞাপন চালানো সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার করা হয় কৌস্তুভ রায়কে। গ্রেফতারের পর ইডি হেফাজতে ছিলেন আবেদনকারী। জেলে হেফাজতে থাকাকালীন জেলে গিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। জেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন কৌস্তুভ রায়। জেল হাসপাতালের সুপারিশে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। অন্য একটি মামলায় হাসপাতালে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পিনকনের মামলায় গত ৯ অগাস্ট থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁকে একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি তদন্তকারী অফিসার।
আরও পড়ুন: তৃণমূল কাউন্সিলরকে খুনের চেষ্টা, পিছনে কি দলীয় কোন্দল ?
তিনি আরও বলেন, তদন্তকারী অফিসারের কাছে মনোরঞ্জনের লেজার ও আবেদনকারী লেজার দুটিই ছিল। সেই লেজার খতিয়ে না দেখে প্রথম দিনেই আবেদনকারীকে গ্রেফতার করা হয়। আসলে মনোরঞ্জনের লেজারটিকে মনগড়াভাবে তৈরি করেছিল ইডি। গ্রেফতারের সময় শুধু মোবাইল ও কিছু ডেটা সিজ করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রেফতারের দিনই তা সিল করা হয়নি। ১৭ জুলাই গ্রেফতার করার সময় মোবাইল সিজ করে সিল করা হয়। সিল করার সময় থাকা সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতেই ১৯ তারিখে সেই সিল খোলা হয়। ২ দিন ফেলে রাখার পর ২১ জুলাই ডেটা পরীক্ষা করতে শুরু করে ইডি। পরে আবার সিল করার সময় আগের সাক্ষীরা সই করতে অস্বীকার করেন। কারণ যে সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই ডেটাগুলিকে পরীক্ষা করা হয়েছে সেটি একটি ইজরায়েলের রিমোট কন্ট্রোল সফটওয়্যার। ফলে সেখানে সম্ভাবনা থেকে যায় অতিরিক্ত সংযোজনের। এছাড়াও সিল করার সময় যে সিম আইএমইআই নাম্বার ছিল পরবর্তীকালে সিল খোলার পর পুনরায় সিল করার সময় দেখা যায় ওই আইএমইআই নম্বরের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই কারণেই সাক্ষী ওই পঞ্চনামায় স্বাক্ষর করতে চাননি, তা ইডির নথি থেকেই প্রমাণিত। বারংবার ইডির কাছে নথি চেয়েও পাওয়া যায়নি। তারা বারবার জানিয়েছে তারা যা কিছু জমা করবে তা আদালতে।
কৌস্তুভ রায়ের আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী, গ্রেফতারির সময়, কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে সেই সমস্ত নথি দিয়েই গ্রেফতার করতে হয়। পিনকনের ৮০০ কোটির আর্থিক দুর্নীতি। বিজ্ঞাপন বাবদ পাঁচ বছরে মাত্র ৭২ লক্ষ টাকার ক্যাশ লেনদেন হয়েছে। যা মাত্র ০.১০ শতাংশ। তাও এই ক্যাশ অর্থ নেওয়া হয় মনোরঞ্জনের দেওয়া চেক বাউন্সের প্রেক্ষিতে। কিন্তু ইডি বারংবার বলে আসছে প্রচুর টাকার লেনদেন। মনোরঞ্জনের সঙ্গে বিজ্ঞাপন বাবদ আর্থিক লেনদেনের সমস্ত হিসাবই আয়কর আইন অনুযায়ী দেখানো আছে। ইডি যে সমস্ত ভুয়ো বিলের গল্প বলছে সেটা ঠিক নয়। ট্যাম ও বার্কের রিপোর্ট অনুযায়ী বিজ্ঞাপনগুলি যে চলেছে তা পরিষ্কার। সুতরাং ইডির ভুয়ো বিলের তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ট্যাম ও বার্কের রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও পিনকনের থেকে কলকাতা টিভির প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।
বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, আপনারা কবে জামিনের মামলাটি ফাইল করেছিলেন? তাতে ওয়াই জে দস্তুর বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বর। সেই সময় চার্জশিট জমা পড়েনি। তাই পরবর্তীকালে আমরা অতিরিক্ত হলফনামার মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য জানাই। ইডি প্রথমে ২ কোটি ৮ লক্ষ টাকার আর্থিক লেনদেনের কথা বললেও পরে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকার ক্যাশ লেনদেনের প্রেক্ষিতে কোনও ভাউচার বা নথি দেখাতে পারেনি। ৫০ লাখের ডিডির মিথ্যে গল্প ইডি কোনওদিনও প্রমাণ করতে পারবে না। কলকাতা টিভি ও ইসরোর অডিট রিপোর্ট থেকেই তা প্রমাণিত। এদিন পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকার ডিডির কোনও প্রতিলিপির নথি ইডি আদালতে হাজির করতে পারেনি। পিনকনের মূল মামলায় ৯ জন অভিযুক্তের নাম থাকলেও ইডি তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, ইডি বেশ কিছু মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আদালতে সামনে তুলে ধরেছে। ওয়াই জে দস্তুর তাতে বলেন, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলা চলাকালীন ইডির আইনজীবী এমভি রাজু আদালতে জানিয়েছিলেন যতদিন পর্যন্ত না ইডির ম্যানুয়াল তৈরি হয়, ততদিন আমরা সিবিআই এর ম্যানুয়াল ফলো করি। কিন্তু এক্ষেত্রে সিবিআইয়ের ম্যানুয়াল অনুযায়ী মোবাইল ফোন সিজ করবার পর তা সিএফএসএল-এ পাঠানো হয়নি। তাই আইনত ওই মেসেজগুলোর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। এছাড়াও ওখানে সিম কার্ডের পরিবর্তন হয়েছে।
বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ ইডির আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা আদালতে বলেছেন নতুন করে তদন্ত করতে গিয়ে আপনারা ১৩৮ কোটি আর্থিক দুর্নীতির তথ্য পেয়েছেন। শুধুমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে তো একজন অভিযুক্তকে দীর্ঘদিন হেফাজতে ধরে রাখা যায় না। কোন নথির ভিত্তিতে আপনারা এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনছেন, সেই নথি আদালতে পেশ করুন। নতুবা তদন্তকারী অফিসারকে স্বাক্ষর করে সেই সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট জমা করতে বলুন।
আদালতের নির্দেশ মতো শুক্রবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইডি সেই নথি পেশ করতে পারেনি। এরপরেই বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ ভর্ৎসনা করেন ইডির আইনজীবীকে। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, আপনারা আদালতে নথি জমা করতে যখন পারবেন না তখন আদালতের কাছে ১৩৮ কোটির কথা তুললেন কেন? আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আজই এই মামলার রায় ঘোষণা করবো। আমি যদি এখন রায় ঘোষণা করি তাহলে আমাকে আপনাদের আনা প্রথম অভিযোগের ৪ কোটির উপরেই রায় ঘোষণা করতে হবে। সেক্ষেত্রে ১৩৮ কোটির বিষয়টা বাদ দিতে হবে। আপনারা কেন প্রথমে এই ১৩৮ কোটির বিষয়টা বলেননি। যেহেতু আপনারা আদালতে ১৩৮ কোটির বিষয়টা তুলে ধরেছেন তাই আমি আমার নির্দেশিকা থেকে ওই ১৩৮ কোটি বাদ দিতে পারি না।
এতে ইডির আইনজীবী ধীরাজ দ্বিবেদী বলেন, আমি আদালতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, শুধু এই মামলা নয় প্রত্যেকটি মামলার ক্ষেত্রে আমি দেখছি আপনারা সব সময় শেষ মুহূর্তে এসে একটি করে কাগজ আদালতে পেশ করেন। এর ফলে বিচার প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। সিবিআই হলে আমি বিষয়টা খতিয়ে দেখতাম। আপনারা আর্থিক লেনদেনের তদন্ত করেন। কিন্তু আপনাদের এই তদন্তটা অনেকটা পুলিশের তদন্তের মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ধীরাজ দ্বিবেদী বলেন, আমি আদালতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, আপনাদের তদন্তকারী অফিসার কোথায় ? ইডির সুপিরিয়র, আমার বস নন। এইভাবে আপনারা প্রতিটি মামলায় বিলম্ব করেন। আপনারা সুপ্রিম কোর্টে এক ধরনের কথা বলেন আবার হাইকোর্টে এক ধরনের কথা বলেন।
ওয়াই জে দস্তুর বলেন, নিম্ন আদালতে আবার অন্য কথা বলে।
বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, আমি চেয়েছিলাম আজই মামলার রায়দান করতে। কিন্তু ইডির পক্ষ থেকে ১৩৮ কোটির নথি জমা না পড়ায় আমার পক্ষে রায়দান করা সম্ভব হচ্ছে না।
আগামী ২ জানুয়ারি ইডিকে ১৩৮ কোটি টাকার নথি আদালতে জমা করতে হবে। ঐদিনই কৌস্তুভ রায়ের জামিন মামলার রায়দান করবে আদালত। ১৪ দিন শুনানি হলেও ইডির গাফিলতির দিকে ইঙ্গিত করেই কার্যত রায়দান করতে পারলেন না বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ।
আরও খবর দেখুন