আজকের বিষয় ধনখড় ফাইলস, তবে তার আগে এই মুহূর্তের হেডলাইনস
ধনখড় সাহেব কাশ্মীর ফাইলস দেখলেন৷ দেখার আগেই সাংবাদিকদের জানিয়েই রেখেছিলেন যে তিনি অমুকদিনে, অমুক সময়ে কাশ্মীর ফাইলস দেখতে যাচ্ছেন৷ মানে জানিয়েই রেখেছিলেন, আমি বিষ ছড়াবো, আপনারা দয়া করে, আমার ওগরানো বিষ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবেন৷ মিডিয়া তার দায়িত্ব পালন করেছে৷ মিডিয়াকে তিনি জানিয়েছেন, তিনি আপ্লুত, ইতিহাসের এই না বলা অধ্যায়কে তুলে আনার জন্য পরিচালককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, এবং রাজ্যের প্রত্যেক মানুষকে এই ছবি দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন৷ ভাগ্যিস বয়স বেশি৷ শরীরে কুলোবে না৷ না হলে আমরা দেখতাম, ধনখড় সাহেব হাতে মই, পোস্টার আর আঠার বালতি নিয়ে রাজ্যময় কাশ্মীর ফাইলসের পোস্টার লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ অটোতে চেপে মাইক ফুঁকে ছবি দেখার আবেদন করছেন৷
কোন মানুষের কাছে আবেদন করছেন? যে মানুষের ঘরে রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে হাজার টাকা, গত ১৫ দিনে যে মানুষ দেখেছে, কেবল পেট্রলের দাম বেড়েছে ৯ টাকা ২০ পয়সা, স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম৷ সেই মানুষকে তিনি বলছেন, একমাত্র হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য এক ছবি তৈরি করা হয়েছে, তা যেন তারা দেখে ফেলে, এটা নাকি ইতিহাস।
আগেই অনেকবার বলেছি, এই বাংলায় বিজেপির সবথেকে কার্যকরী ভূমিকা, রাজ্যের রাজ্যপালের হাতে, ধনখড় সাহেব বখুবি সেই দায়িত্ব পালন করছেন৷ নির্দেশ শাহ – মোদীর, অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। তিনি বললেন ইতিহাস৷ ব্যস ওমনি এক সাম্প্রদায়িক প্রচার, ইতিহাস হয়ে গেল? আসলে মানুষের অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা, অশিক্ষার ফায়দা তুলছে এই ধনখড়, শাহ, মোদীর দল, বিজেপি-আরএসএস।
সেই নিরক্ষর অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে থাকা গ্রামটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ যেখানে ১০০ জনের ৯৯ জন নিরক্ষর, আর একজন অর্ধশিক্ষিত বাস করতো। ওই ১ জন তাঁর অর্ধশিক্ষা দিয়ে, চাতুরি দিয়ে মানুষ ঠকাত৷ গ্রামের লোক তাঁকেই শিক্ষিত মনে করত৷ সে যা বলত তাতে বিশ্বাস করত। তো সেই গ্রামে একদিন হঠাৎ এক পণ্ডিত এসে হাজির৷ সে গড় গড় করে ইংরিজি বলে, সংস্কৃত বলে, ব্যাখ্যা করে। বোঝায় মানুষকে, যে ভাই, তোমাদের ঠকানো হচ্ছে। এসব দেখে সেই অর্ধশিক্ষিত প্যাঁচ কষল, সে সবাইকে ডাকল৷ বললো, বেশ তো, আমি একটা প্রশ্ন করব, উনি উত্তর দিতে পারলে, আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাব৷ আর উনি না পারলে, আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। সবাই রাজি হল৷ সব্বার সামনে সেই অর্ধশিক্ষিত, পণ্ডিতকে প্রশ্ন করল, বলত দেখি পণ্ডিত, আই ডোন্ট নো মানে কী? পণ্ডিত বলল, আমি জানি না। সব্বাই শুনল৷ অর্ধশিক্ষিত উল্লাসে ফেটে পড়ে বলল, গাঁওবালো, দেখো, উনি নিজেই স্বীকার করছেন, উনি জানেন না। ব্যস, পণ্ডিতকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হল। এবার ভাবুন, যদি ওই গ্রামে কিছু শিক্ষিত থাকত, তাহলে তাঁরা তো সত্যিটা বলে দিত, অন্তত বলে দিতে পারত৷ একজন থাকলেও তাঁকে তো সত্যিটা বলে যেতে হবে৷ এটাই তো শিক্ষার দায়৷ আমরাও সেই দায় পালন করছি, সত্যি কথাটা বলার চেষ্টা করছি৷ আর ইতিহাস, সেই সত্যির একটা অংশ, আগে ঘটে যাওয়া প্রত্যেক ঘটনাকে সামনে এনে, তার থেকে ইতিহাসের সার বার করতে হয়,
ভগৎ সিং স্যান্ডার্সকে খুন করেছিলেন এটাই ইতিহাস নয়, ওই ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার, শোষণটাও ইতিহাস৷ তাকে বাদ দিয়ে কেবল স্যান্ডার্স হত্যা, কেবল হত্যা, খুনই মনে হবে। তাই ইতিহাস পাঠের প্রথম শর্ত হল, একটা সময়ে কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা নয়, তার প্রতিটি ঘটনা, তার পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে আনা, সেটাই ইতিহাস।
এই কাশ্মীর ফাইলস ছবিতেই, একটা ডায়ালগ আছে, মিথ্যে বলার থেকেও বড় অপরাধ হল, সত্যিটাকে না বলা। কাশ্মীর ফাইলস গোটা ছবিতেই সেটাই হয়েছে, কিছু সত্যি কথা তো বলা হয়েছে, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হল, বহু সত্যি কথা চেপে গিয়েছেন পরিচালক। আসুন দেখা যাক কোন সত্যি তিনি বলেছেন, কোন সত্যি তিনি চেপে গিয়েছেন, আর তার ফলে তৈরি এক অর্ধসত্য কিভাবে বিদ্বেষ বিষ ছড়ানোর এক যন্ত্র হয়ে উঠেছে, এই সিনেমা, দ্য কাশ্মীর ফাইলস।
যেটা সত্যি সেটা কী? সেটা হল কাশ্মীরে কাশ্মিরী ব্রাহ্মণদের ওপর অত্যাচার হয়েছে, কেবল অত্যাচার হয়েছে বললেও কম বলা হবে, নৃশংস অত্যাচার হয়েছে, সেই অত্যাচারের ফলে অনেকে মারা গিয়েছেন, বিরাট সংখ্যক কাশ্মীরী ব্রাহ্মণদের তাঁদের বাসভূমি ছেড়ে পালাতে হয়েছে, নিজভূমেই তাঁরা হয়েছেন উদ্বাস্তু। এ কথাগুলো তো সত্যি, দিনের আলোর মত সত্যি। কিন্তু সেই সময় কাশ্মীরে কি কেবল কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ খুন হয়েছে? কাশ্মীরের মুসলমানরাই কি তাদের খুন করেছে? এটা কি হিন্দু বনাম মুসলমান দাঙ্গা ছিল? একবার দয়া করে ভাবুন, ১৯৪৭ এ দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিনের মধ্যেই কাশ্মীরে ভারত বনাম পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, কাশ্মীরের এক বিরাট অংশ ভারতের সীমার মধ্যে আসে, এক অংশ পাকিস্তানের দখলে থেকে যায়, যে অঞ্চলটিকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বলা হয়, আর লাইন অফ কন্ট্রোলের মধ্যে থাকা, কাশ্মীরের অংশ নিয়ে জম্মু কাশ্মীর রাজ্য তৈরি হয়। সারা দেশে তখন দাঙ্গা চলছে, উদ্বাস্তু আসছে ওপার থেকে এপারে, এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। কাশ্মীরের বড় অংশই, মানুষের বিরাট ভাগই থেকে গেল ভারতের সঙ্গে, কেন? তাদের নেতা শেখ আবদুল্লার জন্য, ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের জন্য, তাদেরকে দেওয়া হল বিশেষ অধিকার, কিছু সুবিধে, তাঁরা ভারতেই শুধু থাকলেন না, কেবল কাশ্মীরি পুরুষেরাই নয়, কাশ্মীরি মহিলারাও সেদিন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লড়েছিলেন, অস্ত্র হাতেই লড়েছিলেন, তাঁদের ৯৯% ই ছিল মুসলমান। না কাশ্মীরে দাঙ্গা হয় নি।
৪৭ থেকে ৮৬ পর্যন্ত কাশ্মীরে দাঙ্গা হয় নি, কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা সুরক্ষিত ছিলেন, ইসলাম নয়, কাশ্মিরিয়ত ছিল সেই কাশ্মীরের ভিত্তি। ৯৩% মুসলমান আর ২-৩% কাশ্মীরি পন্ডিত, হিন্দু সাকুল্যে ৬%। দিব্যি ছিলেন তাঁরা। ছবিতে একথা বলা হয়েছে? যদি এই লড়াই হিন্দু মুসলমানের হত, তাহলে কতজন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ বেঁচে থাকতেন? সেদিন এমন কোনও লড়াই ছিল না। হল কখন? কাদের ভুলে, কাদের প্ররোচনায় হল এমনটা? আসলে সেই শুরু থেকেই কাশ্মীরের খুব কমসংখ্যক কিছু মানুষ, আজাদ কাশ্মীরের কথা বলতেন, তাঁরা পাকিস্থান নয়, ভারতও নয়, আজাদ কাশ্মীরের দাবি তুলতেন, আবার কংগ্রেস বিরোধী কিন্তু প্রো ইন্ডিয়ান কিছু গোষ্ঠি ছিল, কাশ্মীরে পুতুল সরকার রেখে বকলমে কেন্দ্র সরকারের শাসন চলতো, তার বিরোধী ছিলেন বহু মানুষ।
এরমধ্যে ১৯৮৬র নির্বাচন হল, চূড়ান্ত রিগিং, সেনা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, পুলিশকে কাজে লাগিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স আর কংগ্রেসের জোট সেই নির্বাচনে জোট বেঁধেছিল, উল্টোদিকে কিছু ছোট ছোট দল, তাদের জোটের নাম ছিল মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট, মাফ। রিগিং হয়েছিল, কেমন রিগিং? আমির কাদের বিধানসভা কেন্দ্রে ন্যাশনাল কনফারেন্স এর প্রার্থী ছিলেন, দলের প্রবীণ একজন নেতা, তিনি হারছিলেন সুনিশ্চিত, এটা দেখেই তিনি গণণাকেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফিরে যান, মাফ এর প্রার্থী আপত্তি জানান, তাকে জেলে পোরা হয়, তাঁর কেন্দ্রে এজেন্টকেও জেলে পোরা হয়,২০ মাস পরে সেই প্রার্থী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পাকিস্থান চলে যান, এখন তিনি হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার মহম্মদ সালাউদ্দিন, তাঁর এজেন্ট ছিলেন ইয়াসিন মালিক।
মজার কথা দেখুন, এনারা তখনও দেশের সংবিধান মেনে নির্বাচনে লড়াই করছিলেন, এই ভুয়ো নির্বাচনের পর তাঁরা রাষ্ট্র আর সংবিধানের ওপর আস্থা হারান, সুযোগ নেয় পাকিস্তান৷ পাকিস্তান তার আগে ৬৫ তে, ৭১ এ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, তারা এই সময়ে অপারেশন টোপাজ শুরু করে, কাশ্মীরের সেই সব যুবক যারা মনে করছিল আজাদ কাশ্মীর তাদের ভবিষ্যৎ, তাদেরকে বোঝাতে শুরু করে, এই ভুয়ো নির্বাচন, সেই সুযোগ এনে দেয়, পাকিস্তান তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তাদের মিলিটারি ট্রেনিং দিতে শুরু করে, যে কাশ্মীরে ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত, তেমন কোনও বড় ঘটনা ছিল না, সেই কাশ্মীর হয়ে উঠল অশান্ত।
কাশ্মীরে তাণ্ডব চালানো এই মিলিট্যান্টদের শত্রু কারা ছিল? কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা? কেবল কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা? সিনেমাতে দেখানো হচ্ছে, কয়েকজন তাস খেলছেন, খবর আসছে, প্রাক্তন বিচারপতি নীলকন্ঠ গঞ্জুকে খুন করা হয়েছে, যিনি অমর চাঁদ নামে এক পুলিশ ইন্সপেক্টরকে খুন করার অপরাধে, মকবুল ভাটকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন, বলা হল, তিনি ছিলেন কাশ্মীরি পন্ডিত, ছিলেনই তো, কিন্তু তাঁকে মারা তো হল মকবুল ভাটের ফাঁসির বদলা নিতে, এটা ছবিতে দেখানো হল,
দেখানো হল না, ওই সময়েই ৮০ বছরের বৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতা মৌলানা মাসুদিকেও খুন করল, ঐ মিলিট্যান্টরাই, কারণ তিনি ছিলেন ভারতের পক্ষে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের অজস্র মন্ত্রী, নেতাদের খুন করা হল ওই একই কারণে, মন্ত্রী ছিলেন হিসামুদ্দিন বন্দে, মুহম্মদ আতাউল্লা সুরাওর্দি, আবদুল ঘনি ভিরা, ভালি আহমেদ ভাট, মুহম্মদ সুবান ভাট, পীর মুহম্মদ সফি, শেখ মঞ্জুর, আবদুল রশিদ দার, নাজির আহমেদ ওয়ানি, গুলাম কাদির মীর, আবদুল মাজিদ বন্দে এরকম আরও অনেক ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতারা খুন হল, কেন? তারা কংগ্রেসের সাথে ছিল, তাদেরকে মিলিট্যান্টরা ভারতবর্ষের এজেন্ট বলে খুন করেছিল, এর একটা খুন, একটা হত্যাও কি দ্য কাশ্মীর ফাইলসে দেখানো হয়েছিল? না হয়নি। কেন?
কারণ এগুলো দেখালে ছবিটা হিন্দু আর মুসলমানের লড়াই হয়ে উঠত না, হয়ে উঠত সময়ের ছবি, এক ইতিহাস, যেখানে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা মারা গেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, তার সঙ্গেই মারা গেছেন অজস্র মুসলমান, এমন রাজনৈতিক নেতা, যাদের মিলিট্যান্টরা মনে করেছে, এরা ভারতের পক্ষে, লড়াইটা ছিল পাকিস্থানে মদত প্রাপ্ত মিলিট্যান্ট আর ভারতের মধ্যে, সেই ইতিহাস না দেখিয়ে এক খন্ড চিত্র তৈরি করে, হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ করছে এই ছবি, যে ছবি দেখতে বলছেন রাজ্যের সফেদ হাতি ধনখড় সাহেব, এইখানেই তাঁর এজেন্ডা আর পাকিস্থানের মদতপ্রাপ্ত মিলিট্যান্টদের এজেন্ডা মিলে যায়। আগামীকাল, এ নিয়ে আরও কিছু কথা, আরও কিছু ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরবো। সঙ্গে থাকুন।