“কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলেও খাই। বেদ, বিধি, শৌচাচার নাহি মানি তাই।” বলেছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর, জন্মেছিলেন এই অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার ওলাকান্দি গ্রামে, ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ তিথিতে, যশোমন্ত বিশ্বাস বা যশোমন্ত বৈরাগ্য আর মা অন্নপুর্ণার ঘরে। হরিভক্ত যশোমন্তকে তাঁর কৃষ্ণপুজো, হরিনাম সংকীর্তন ইত্যাদির জন্য গ্রামের মানুষ ঠাকুর বলতেন, যশোমন্ত ঠাকুর, পরবর্তীতে তাঁর বংশধরেরাও ঠাকুর পদবিতেই পরিচিত হন। এসব জানা গেল কী করে? হরিচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ লীলামৃত রচনা করেছেন, কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার, ২৫৯ পাতার বই, ১৯২৫ ক্রিস্টাব্দে প্রকাশিত, দাম ছিল ২ টাকা। আজকের আলোচনায় হরিচাঁদ ঠাকুর সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য, ওই বই থেকেই নেওয়া, এটা আগেভাগে বলে রাখলাম। কারণ এ বিষয় নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি, তেমন কোনও লিখিত ইতিহাসও নেই, যা থাকা দরকার ছিল। কাজেই বহু কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে, তারমধ্যে স্ববিরোধও আছে, বহু মিথ তৈরি হয়েছে, বহু মিথ্যাও ছড়ানো হয়েছে। ক’দিন আগেই সেই জন্মতিথি গেল, এবং এই এতদিনকার এক জনগোষ্ঠী, যাঁরা এদেশে আছেন বংশানুক্রমে তাঁদের বলা হল, আপনাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কারা বলছে? এক ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগঠন, যাদের বিরুদ্ধেই গড়ে উঠেছিল এমন সব প্রতিবাদী ধর্ম, সাবঅলটার্ন রিলিজিয়ন। হরিচাঁদ ঠাকুর, তাঁর কথা, বাণী, উপদেশ নিয়ে আলোচনা করার আগে সেই সময়কার সামাজিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনাটাও জরুরি, খুব জরুরি। কারণ সামাজিক বা ধর্মীয় আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, তার উদ্ভব, তার বিকাশ সমাজের গঠন আর সেই সময়কার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে, এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে।
ধরুন শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম ইতিহাসের কথা, আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে শিকাগো, হে মার্কেটে শ্রমিক সমাবেশ, তাদের আন্দোলন আসলে সেই সময়ের শিল্প বিপ্লবের ফসল। নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, কারখানা তৈরি হচ্ছে, হাজারে হাজারে মানুষ সেই সব কারখানায় কাজ করতে যাচ্ছেন। মালিকরা মুনাফা কামানোর জন্য ১২-১৪-১৮ ঘণ্টা তাঁদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন, সেই প্রেক্ষিতেই শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের ৮ ঘণ্টার কাজের দাবি পেশ করেছিল, এটাই ছিল সেই সামাজিক প্রেক্ষাপট, যার থেকে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ঠিক তেমনই হঠাৎ হরিচাঁদ ঠাকুর, এক নতুন ধর্ম নিয়ে হাজির হলেন, হঠাৎ মানুষজন তাঁর উপদেশ শোনার জন্য জড়ো হলেন, হঠাৎ সেই মানুষজন হরিচাঁদ ঠাকুরের কথার মধ্যে শান্তি, সুখ, স্বস্তি খুঁজে পেল, এমনটা নয়, এর এক সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে। ভারতবর্ষের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ হিন্দু ছিলেন, তাঁরা কি নিজেদের হিন্দু বলতেন? না, মধ্য এশিয়া বা পারস্য থেকে আসা মানুষজন সিন্ধু নদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে থাকা মানুষজনকে, হিন্দু বলা শুরু করেন, সেই ব্যবসায়ীরা, পর্যটকেরা বা দখলদারি করতে আসা যোদ্ধারা তাদেরকে হিন্দু বলা শুরু করেন, তার আগে পর্যন্ত সিন্ধু আর গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষজন, প্রায় এক ধরনের ধর্মাচরণ করতেন, যজ্ঞ করা, যজ্ঞে পশু আহুতি দেওয়া, উপনিষদ বেদ পাঠ তার চর্চা করার মধ্য দিয়েই তাদের ধর্মাচরণ চালু ছিল। সমাজে বিভিন্ন কাজের ভিত্তিতে বর্ণভেদ ছিল, রাজা, সামন্ত, যোদ্ধারা ছিলেন ক্ষত্রিয়, যাঁরা পুজো পাঠ করতেন, যজ্ঞ করতেন, উপনিষদ বেদ চর্চা করতেন, তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ, যাঁরা ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি করতেন তাঁরা বৈশ্য, আর যাঁরা এই তিন জাতির সেবা করতেন, ফাইফরমাশ খাটতেন, তাঁরা ছিলেন শূদ্র। একজন শূদ্রের ব্রাহ্মণ হওয়া আটকাত না, একজন ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ হতেই পারতেন, একজন বৈশ্য তাঁর কাজের দিক থেকে হয়ে উঠতেন শূদ্র, কিন্তু ক্রমশ এই বর্ণভেদ হয়ে উঠল জন্মভিত্তিক, ব্রাহ্মণের ছেলে অশিক্ষিত হলেও ব্রাহ্মণই হল, ক্ষত্রিয়ের কাপুরুষ ছেলেটিও ক্ষত্রিয়ই হল, মূলত ব্রাহ্মণদের চেষ্টায়। তাদের চর্চায় ধর্মাচরণ হয়ে উঠল অনেক জটিল, বিভিন্ন শাস্ত্র আর তাদের ব্যাখ্যা নিয়ে হিন্দু ধর্ম ক্রমশ এক শক্তপোক্ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
ইতিমধ্যেই হিন্দু ধর্ম ছড়িয়ে গেল দক্ষিণে, ধর্ম হয়ে উঠল এক বর্মকঠিন আনুষ্ঠানিক জটিল ব্যবস্থা। যা ছিল মানুষের স্বাভাবিক আচরণ, তাই হয়ে উঠন নিয়ম কানুনের আগলে এক শক্তিশালী ব্যবস্থা, এক বিরাট প্রতিষ্ঠান। যে ধর্ম এককালে ভগবান বা ইশ্বরের অস্তিত্বকেও নাকচ করা চার্বাককে মহর্ষি বলেছিল, সেই ধর্মই এখন চুন থেকে পান খসলে ফতোয়া জারি করা শুরু করল, বর্ণের মধ্যেও বর্ণভেদ চালু হল, শূদ্রের মধ্যেও নমঃশূদ্র। সেই আচার বিচারকেই সনাতন বলা সেই তখন থেকে চালু হল। বেদ উপনিষদ তো দূরস্থান, এমনকী ভাষাশিক্ষা, সাধারণ পাঠদান, অস্ত্রশিক্ষাও কুক্ষিগত করল উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়রা, শূদ্রদের অধিকার ছিল না বেদ পাঠের, উপনিষদ নিয়ে চর্চা করার। এবং এরপর থেকে আরও কঠিন হতে শুরু করে বর্ণভেদ, এক উদার ধর্মাচরণ হয়ে ওঠে কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদ, জন্ম, মৃত্যুকে ঘিরে অসংখ্য লোকাচার কেবল তৈরিই হল না, সেগুলো অমান্য করার অপরাধে প্রাণদণ্ডও হয়ে উঠল স্বাভাবিক ঘটনা। ইতিমধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এসেছে, তারা হিন্দু ধর্মের নিপীড়িত মানুষদের কাছে টেনেছে, আরও উগ্র হয়েছে হিন্দু মনুবাদ, আরও কঠিন হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। রাজা, শাসক, সম্রাটদের সাহায্য পেয়েছে, আরও নতুন নিয়ম কানুন হয়েছে। এরই মধ্যে ইসলাম এসেছে শাসকের হাত ধরে, তথাকথিত হিন্দু নিম্নজাতের মানুষজন ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করেছে, এবং এই সময়েই দেশজুড়ে সেই শূদ্র, নমঃশূদ্র, অচ্ছুৎ মানুষজনকে ধরে রাখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন মানুষরা এগিয়ে এলেন, মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, হিন্দু কঠিন ধর্মাচরণ থেকে সরে এসে, এক সরল ধর্মাচরণের কথা বলা শুরু করেন তাঁরা।
সেই সব মানুষ, যাঁরা মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারের শিকার, তাঁদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন অনেক মানুষ, তাঁদেরই একজন ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। শ্রী শ্রী হোরি লীলামৃত পড়লে জানা যাবে, এক নমঃশূদ্রের ঘরে জন্ম নেওয়া এক মানুষ কীভাবে সমাজে শোষিত, অবহেলিত, প্রতারিত তথাকথিত নিচু জাতের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, অস্ত্র ছিল নামগান, হাতে কাম, মুখে নাম। হরিনামে বিভোর, মাতোয়ারা এই মানুষদের ব্রাহ্মণরা বলল, মত্ত, উন্মাদ। হরিচাঁদ ঠাকুর বললেন, বেশ তো, আমরা মাতোয়ারা, আমরা মতুয়া। জন্ম হল এক নতুন সমাজের, তারা কাজ করে আর নামগান করে, তারা মতুয়া। তাদের কোনও দেবদেবী নেই, কোনও উপাসনা পদ্ধতি নেই, তারা আচার বিচারকে অস্বীকার করেছে, তারা বেদ উপনিষদকে অস্বীকার করেছে, তারা মাতোয়ারা হোরি নামে, কৃষ্ণ রাধা প্রেমে মাতোয়ারা, তারা মতুয়া। কেমন অত্যাচার ছিল ওই ব্রাহ্মণদের? আসুন ওই শ্রী শ্রী হোরি লীলামৃত থেকেই ক’টা লাইন পড়া যাক। রমাকান্ত বৈরাগী, যিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের বাবার কাছে প্রায়সই যেতেন, তিনি বাসুদেব মানে কৃষ্ণের এক মূর্তি স্থাপন করে পুজো করতেন, গরিব ঘরে সেই বাসুদেবের পুজোর বিবরণ আছে এই বইতে—
মুলা, থোড়, মোচা, কাঁচা রম্ভার ব্যঞ্জন
আতপের অন্ন দিত, না দিত লবণ।
ছোলা, ডাল, মুগ, বুট, গোধুম চাপড়ি
তৈল, হরিদ্র বিনে ঘৃত পক্ক বড়ি।
ভোগ লাগাইয়া সাধু, আরতি করিত
বাসুদেব খেত, তাহা চাক্ষুস দেখিত।
একদিন গ্রামবাসী বিপ্র একজন,
বাসুদেব ভোগরাগ, করিল দর্শন।
ক্রোধ করি, বলে বিপ্র, এ কোন বিচার?
শূদ্রের কি আছে অন্নভোগ অধিকার?
শূদ্র হয়ে বাসুদেবে অন্ন দিলি রাঁধি?
কোথায় শুনিলি বেটা, এমত অবধি?
হারে রে বৈরাগী তোর এত অকল্যাণ?
শূদ্র হয়ে, হবি নাকি ব্রাহ্মণ সমান?
ব্রাহ্মণ কহিল গিয়া, ব্রাহ্মণ সকলে
শুনিয়া ব্রাহ্মণ সব, ক্রোধে ওঠে জ্বলে।
জন দশ বিপ্র গেল বৈরাগীর বাড়ি,
ক্রোধভরে, বাসুদেবে লয়ে এল কাড়ি।
বৈরাগী নির্মল চিত্তে দিলেন ছাড়িয়া,
বলিল রে প্রাণ বাসু, সুখে থাক গিয়া।
কাঙ্গালের কাছে তুমি ছিলে অনাদরে,
আদরে খাইও এবে ষোড়শপচারে,
ভাল হল ব্রাহ্মণেরা লইল তোমারে,
সুখেতে থাকিবা এবে খট্টার উপরে,
দুঃখিত দরিদ্র আমি, কপর্দক নাই
বহুকষ্টে, থোড় মোচা তোমারে খাওয়াই।
দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু, পায়স, পিষ্টক
লুচি, পুরি, মন্ডা খেও, যাহা লয় শখ।
দরিদ্র নমঃশূদ্র, রমাকন্তের ঘরে থোড় মোচার ভোগ হত, ব্রাহ্মণদের নিদান, নমঃশূদ্ররা কৃষ্ণকে ভোগ দেবে? এ তো অন্যায়। তারা সেই মূর্তি কেড়ে নিয়ে গেল, তার প্রতিবাদ নেই, বরং রমাকান্ত নিজেকেই বোঝাচ্ছেন, যে ওই ব্রাহ্মণদের বাড়িতে, তাঁর বাসুদেব, অন্তত ভালো ভালো খাবার তো পাবে, খাটে শুতে তো পাবে। বৈষম্যটা খেয়াল করুন, কেবল বাসুদেবের পুজোর অধিকার নয়, সেই তথাকথিত নিচু জাতের নমঃশূদ্র রমাকন্তের ঘরে ঘি, দুধ, দই নেই, খাটও নেই। এই অবিচার, এই শোষণকে চিহ্নিত করেছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর, এই পিছিয়ে পড়া মানুষজনকে নিয়ে, নতুন ধর্মাচরণ করতে শিখিয়েছিলেন ওই হরিচাঁদ ঠাকুর। বেদ, উপনিষদ, হিন্দু দেবদেবীকে বাদ দিয়েই এক সমাজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন ওই হরিচাঁদ ঠাকুর, এবং এইখানেই তাঁর ওই শিক্ষা, তাঁর কথা আজকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক। ওই বইতেই পড়লাম, চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের কথা, পুরীতে জগন্নাথধামে গিয়ে চৈতন্য হারিয়ে গেলেন? তাঁকে উচ্চজাতির মানুষেরা খুন করল? শ্রী শ্রী হরিচাঁদ লীলামৃততে কবি লিখছেন,
গৌরাঙ্গের ভক্ত যত জগন্নাথে কয়,
আহারে রাক্ষস তোরে কে করে প্রত্যয়?
কে বলে ঈশ্বর তোরে কে করে বিশ্বাস?
গৌরাঙ্গ খাইলি ওরে, দুরন্ত রাক্ষস?
খাইলি গৌরাঙ্গ, মন্দিরেতে পেয়ে একা?
ভাল যদি চাস তবে, শ্রীগৌরাঙ্গ দেখা।
জগন্নাথ মন্দিরে ব্রাহ্মণ পুরোহিত পান্ডাদের এই চোখেই দেখেছেন তথাকথিত নিম্ন শ্রেণির মানুষজন। আসলে বেদ, উপনিষদ, মনুবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করে, কোনও দেবদেবীর পুজোকে সামনে না রেখে, এক সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর, মতুয়া সমাজ। আজ যখন আরএসএস–বিজেপির নেতৃত্বে সেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, সেই মনুবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে, তখন হরিচাঁদ ঠাকুর, তাঁর কথা, বাণী আর উপদেশ আরও প্রাসঙ্গিক, আরও জরুরি। তারচেয়েও জরুরি হল এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে তাঁদের ধর্মের স্বরূপটা বোঝানো। আজ নাগরিকত্ব দেবার ভুয়ো আর অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা তাঁদের ভোট লুঠ করতে চায়, সেটা ওই মাতোয়ারা মানুষদের বোঝানোটা প্রত্যেকের কর্তব্য।