ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের জোট হচ্ছে না কেন? সেই জোটে কোথায় কী কী অসুবিধে, কোথায় কোন নেতা বলেই দিলেন জোট হবে না, কোথায় কোন নেত্রী বলে দিলেন আমরা একলাই লড়ব ইত্যাদি নিয়ে ঘামাসান চলছে। সন্ধের কলতলায় এটাই বিষয়, গন্ডায় গন্ডায় রাজনৈতিক পণ্ডিত সারাদিন ধরে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স যে ভেঙে ছারখার হয়ে গেছে সেটা প্রমাণ করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। এবং সে সব আলোচনার অনেকটা সত্যিও। সত্যি তো এই বাংলায় যখনই অ্যালায়েন্সের আলোচনা শুরু হয়েছে বা আবার আলোচনা শুরু হয়েছে এরকম কথা শোনাও গেছে, ততবারই মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী সাংবাদিকদের ডেকে হয় রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চেয়েছেন, না হলে জানিয়েই দিয়েছেন তিনি বাম-কংগ্রেস ঐক্য দেখতে চান। অর্থাৎ তাঁর সমস্ত এনার্জি আপাতত এই বাংলাতে কংগ্রেস তৃণমূল জোট যাতে না হয় তার জন্যই তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং প্রয়োজনে তা ব্যবহারও করছেন। কারণ? কারণ খুব সোজা, উনি খুব ভালো করেই জানেন কং বাম জোট হলে বহরমপুরে তিনি জিতে গেলেও জিতে যেতে পারেন, অন্তত বামেদের কমিটেড ভোটটা তিনিই পাবেন আর কংগ্রেস তৃণমূল জোট হলে তাঁকে দিদিমণি দাঁড় করিয়ে হারাবে। বামেদের ভোটও পাবেন না, কাজেই এই জোট হলে তিনি দিল্লি যেতে পারবেন না, বাম কংগ্রেস জোট হলেও পারবেনই তেমন নয়, কিন্তু একটা ক্ষীণ আশা তো থাকবে। ওদিকে বিহারে এটা তো অবশ্যই আলোচনার বিষয় যে নীতীশ কুমার চলে যাওয়ার পরে ছবিটা বদলেছে, আফটার অল এই ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের তিনি তো ছিলেন এক প্রধান পুরোহিত। কিন্তু এই নীতীশের যাওয়া নিয়ে এক অদ্ভুত ফ্যালাসি আছে, বিহারে নীতীশের এনডিএ-তে ফিরে আসা এনডিএ-তে বহু সমস্যা তৈরি করেছে, তা নিয়ে পরে আলোচনায় আসছি, কিন্তু লালু, কংগ্রেস বাম জোটে সমস্যা কমেছে। তাঁরা আসন সমঝোতা সেরে ফেলতে সময় নেবেন না, কারণ নীতীশ থাকলে উনি তো ৪০-এর মধ্যে গোটা ১৬ আসন চাইতেন, আর সেটা দিলে আরজেডি বা কংগ্রেস বা বামেদের ভাগে কম পড়ত, আসন নিয়ে টানাহেঁচড়া চলত। কাজেই বিহারে নীতীশ গিয়ে বিহার রাজনীতিতে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের বাকি পার্টনারদের সমস্যা নেই, সমস্যা সারা ভারতের রাজনৈতিক ছবিতে, সেখানে এক নতুন তৈরি জোটের মাথা খসে যাওয়ার লজ্জাজনক অবস্থাকে নিয়ে। যাঁরা নীতীশ কুমারের মধ্যে এক নব্য সেকুলার নেতাকে খুঁজে পেতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা বিব্রত।
ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের আরেকটা বড় গাঁট ছিল আপ, দিল্লি, হরিয়ানা, গুজরাত নিয়ে আসন আলোচনা এগোচ্ছিল না, তো সেই গাঁট খুলেছে, পঞ্জাবে বিজেপি ফ্যাক্টর নয়, আর বিজেপি যেখানে বড় ফ্যাক্টর নয় সেখানে দুটো বড়দল এক জোটে এলে বরং বিজেপির সুবিধে। মানে ধরুন পঞ্জাবে আপ আর কংগ্রেস এক জায়গাতে এল, তাহলে সরকার বিরোধী সমস্ত ভোট চলে যাবে অকালি বিজেপির দিকে, বিজেপি আসন বাড়াতে না পারলেও ভোট পার্সেন্টেজ বাড়াবে। একই অবস্থা কেরালাতেও, ওখানেও কংগ্রেস সিপিএম জোট হলে বিজেপির দিকে যাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট, এমনিতেই কেরালাতে বিজেপির ভোট কিন্তু নয় নয় করে ১২-১৩ শতাংশ, তা এবারে বাড়বে। কিন্তু সিপিএম কংগ্রেস জোট হলে তা ৩০ শতাংশ ছুঁয়ে যেতে পারে। তো আপ-এর আলোচনাতে ফেরা যাক, আপ আর কংগ্রেসের সবচেয়ে সফল জোট দিল্লিতে, এই জোটের ফলে আর যাই হোক বিজেপি ৭টাতে ৭টা আসন পাবেই তার সম্ভাবনা নেই, বরং ওই সাতের মধ্যে তিন কি চারটে আসনও হারাতে পারে বিজেপি। গুজরাতে গতবার সবক’টা আসন পেয়েছিল বিজেপি, এবার আপ-কংগ্রেস জোটের ফলে অন্তত একটা আসনে বেশ ভালো লড়াই তো হবেই। এরপরের সমস্যা ছিল উত্তরপ্রদেশে, বিএসপি কার্যত ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে, দলের নেতারা কেউ কংগ্রেস, কেউ বিজেপি কেউ বা এসপি-তে যোগ দিচ্ছেন। এরকম একটা অবস্থায় কংগ্রেস এসপি জোট বিজেপিকে আসন বাড়াতে দেবে না, দু’ তিনটে কমলেও কমতে পারে। ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের সবচেয়ে ঊর্বর ভূমি ছিল মহারাষ্ট্র, সেটা বিজেপি নেতারা ভালো করে জানতেন, জানতেন বলেই প্রথমে শিন্ডেকে ভাঙিয়ে এনে শিবসেনাকে দু’ টুকরো করেছেন। করার পরে বুঝেছেন এটা যথেষ্ট নয়, এবারে তারা এনসিপিকে ভাঙালেন, তারপর কংগ্রেসকেও ভাঙাচ্ছেন। কিন্তু অন্যদিকে এই রাজ্যে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের আসন সমঝোতা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তামিলনাড়ু একটা রাজ্য যেখানে বিজেপির কিছুই নেই, এখনও তাদের ভোট ৫-৬ শতাংশের কম। তা এবারে বাড়তেই পারে কিন্তু তা দুই ডিজিট ছুঁয়ে ফেলবে এমন সম্ভাবনাও কম। এডিএমকে বিজেপি জোট হচ্ছে না, হলে বিজেপি আরও কম ভোট পাবে। অন্যদিকে ডিএমকে কংগ্রেস আর বামেদের আসন সমঝোতা নিয়ে সমস্যা নেই, আর ক’দিনের মধ্যেই তা কিন্তু একটা শেপ নিয়ে নেবে, ঘোষণাও হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২০২৪-এ মোদিজি আবার জিতে ক্ষমতায় এলে কী কী হবে?
ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেস ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার জোট আছে এবং আসন সমঝোতা নিয়ে তেমন অসুবিধে নেই। অসমে কংগ্রেস বড় দল, কিছু ছোট দলের সঙ্গে কথা চলছে, অন্ধ্রে ওয়াইএসআর রেড্ডির বোনকে পেয়ে খানিক উজ্জীবিত, তেলঙ্গানাতে সবেমাত্র জয়ের রেশ আছে আর রাজস্থান ছত্তিশগড় বা মধ্যপ্রদেশে আসন সমঝোতার ব্যাপারই নেই। ওখানে কংগ্রেস মুখোমুখি হবে বিজেপির, কমল নাথ এবং তাঁর পুত্রের গতিবিধি খুব সুবিধের নয়, কিন্তু তাতে নতুন করে কীই বা হবে, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের আছেই তো একটা আসন, ওই ছিন্দওয়ারা। কমল নাথের ছেলে নকুল নাথ সেখান থেকে কংগ্রেসের সাংসদ, দোলাচলে আছেন কিন্তু একই দলে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াও থাকবেন আর কমল নাথও থাকবেন, এটা বেশ জটিল ইকুয়েশন, বিজেপি তার পাকা ঘুঁটি কাচাবে? মনে হয় না। তার মানে কী দাঁড়াল? এক এই বাংলা ছাড়া ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স কিন্তু জোটে আছে, তার আসন সমঝোতা হয়েই গেছে বা হওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনও অসুবিধে নেই। বাংলার জোট জাতীয় রাজনীতিতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেই জোটে এ রাজ্যে ফলাফলের খুব বিরাট ফারাক হবে তেমনও নয়। কংগ্রেস বাম জোট হলে কংগ্রেস অন্তত দুটো আসন, তৃণমূল ৩১-৩২টা আসন পেতেই পারে, না হলে কংগ্রেসের পক্ষে একটা আসন জিতে আসাও হয়ে উঠবে না। বিজেপির আসন ১৪-১৫ হবে বাকিটা তৃণমূল। কিন্তু যদির কথা নদীর ধারে রেখেই বলছি, এই জোট বাংলাতেও যদি হয়ে যায় তাহলে কিন্তু ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স দেশজুড়েই একটা জোট হিসেবেই নির্বাচন লড়বে, আসনের হিসেবে না হলেও। লড়াইয়ের দিক থেকে তারা একটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধে খানিক এগিয়েই থাকবে, সেটা জানেন ইন্ডিয়া জোটের নেতারা, লালু যাদব ফোন করেছেন, অখিলেশ যাদব ফোন করেছেন মমতাকে। এক্কেবারে বন্ধ হওয়া আলোচনা আবার শুরু হয়েছে, আগামী দু’ তিন কি চারদিনের মধ্যেই তা বোঝা যাবে কারণ আর যাই হোক ১০ মার্চ ব্রিগেড র্যালি থেকে মমতা ৪২টা আসনের তালিকা পড়ে জানিয়ে দেবেন, এটা নিশ্চিত। সেদিন থেকেই এই রাজ্যে ২০২৪-এর নির্বাচনী লড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে যাবে। এটা গেল ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের কথা। এবারে চলুন এনডিএ-র আলোচনায়, যা নিয়ে ভেঁপু মিডিয়া কোনও কথা বলছে না। ওদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাষণেই বলে দিয়েছেন বিজেপির আসন বাড়ছে, শরিকদের আসন কমছে।
তো এই এনডিএ জোটের ফল্ট লাইনগুলো কোথায় কোথায়? ২০১৯-এ তখনও রামবিলাস পাসোয়ান বেঁচে, তাঁর দল এলজেপি পেয়েছিল ৬টা আসন, এবারে সেই দল ভেঙে দু’ টুকরো, যদিও সেই দু’ টুকরোই আছে এনডিএ-তে, ৬টা আসন তাঁরাও দাবি করছেন, দেবে বিজেপি? নীতীশ কুমার পেয়েছিলেন ১৬টা আসন, এবারে পাবেন? উনিও জানেন পাবেন না, বিজেপিও জানে পাবে না, কিন্তু ওনার দলের সাংসদরা আসন ছেড়ে দেবেন বিজেপিকে? তুমুল ঝামেলা চলছে, বিহারে এখনও অনেক নৌটঙ্কি বাকি আছে, বলে রাখলাম মিলিয়ে নেবেন। এর উপরে আছে জিতন রাম মাঞ্ঝির মতো নেতা, আসন কেবল নয়, সেফ সিট না পেলে বিধানসভায় খেলা দেখিয়ে দেবেন। কোত্থেকে আসবে সেই আসন? বিহার বিজেপির কাছে, এনডিএ-র কাছে বেশ বড় সমস্যা। এর পরের ফল্ট লাইন মহারাষ্ট্র, এনসিপি ভেঙেছেন বেশ করেছেন, এবারে সেই ভাঙা এনসিপি আসন চাইবে তো? সেদিকেই তো বেশি সাংসদ, ওদিকে শিন্ডে কি ছেড়ে দেবে? শিবসেনা বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকেও তো সংসদে থাকতে হবে, কাজেই তিনিও দাবি করছেন, কংগ্রেস থেকে যাঁদের ভাঙানো হল তাঁদের আসন দিতে হবে। এই বিরাট বানরের পিঠে ভাগের পরে বিজেপির হাতে কী পড়ে থাকবে? সব মিলিয়ে মহারাষ্ট্র এনডিএর -আসন সমঝোতার আরেক বড় সমস্যার জায়গা।
অন্ধ্রপ্রদেশ, জোট কার সঙ্গে হবে, কার সঙ্গে লড়াই? চন্দ্রবাবু আর জগন রেড্ডিকে তো এক জোটে রাখা যাবে না। একজন থাকলে অন্যজন বিরোধিতা করবেই, এ সমস্যা নিয়ে চুল ছিঁড়ছে বিজেপি নেতৃত্ব। তেলঙ্গানা বিধানসভা নির্বাচনের আগে বন্দি সঞ্জয় কুমারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এখন তাকেই আবার ফিরিয়ে এনে ভুল শুধরোতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু সেখানেও সমস্যা, কিছুদিন আগেই যে নেতৃত্ব বন্দি সঞ্জয় কুমারের সমর্থকদের সরিয়ে দিয়ে নিজেদের লোকজন খাড়া করেছিলেন, তাঁরাই এখন বিক্ষুব্ধ। রাজস্থানে সব খুইয়েছেন বসুন্ধরা রাজে, মধ্যপ্রদেশে সব খুইয়ে চোখের জল ফেলেছেন মামাজি শিবরাজ সিং চৌহান। এনাদের ভূমিকার দিকে তাকিয়ে থাকবে রাজনৈতিক মহল, ওদিকে সমুদ্রের তলায় ময়ূরপুচ্ছ নিয়ে নেমে পড়লেও উত্তর পূর্বাঞ্চলে মণিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে পারবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী? এরকম নয় যে এনডিএ হেরেই যাবে, কিন্তু আমি যেটা বলছি সেটা হল এরকমও নয় যে জিতেই বসে আছে এনডিএ, ওই ৩৭০-এর দাবি নেহাতই এক ফাঁকা আওয়াজ। বাংলায় অবকি বার ২০০ পার বলার পরে ৭০ পেয়েছিল বিজেপি। খুব কষ্টেসৃষ্টে সেই প্রশ্ন একজন সাংবাদিক করেই ফেলেছিল অমিত শাহকে, অমিত শাহ বলেছিলেন আমরা আমাদের দলের কর্মীদের জন্য একটা বেঞ্চমার্ক সেট করি, ওটা টার্গেট। তো এবারের টার্গেট ৩৭০, কিন্তু সেই টার্গেট আর আসল ফলাফল আলাদা হয়ে যেতেই পারে, বিজেপির আসন সংখ্যা ২৫০-এর তলাতে চলে এলেও অবাক হবেন না।