এবারে বরাহনগর বিধানসভায় উপনির্বাচনে সিপিআইএম প্রার্থী কমরেড তন্ময় ভট্টাচার্য বরাহনগরে পা রেখেই মনে করিয়েছেন জ্যোতি বসুর কথা, যিনি এই আসন থেকে জিতে বিধানসভাতে যেতেন। সেদিন বরাহনগর বিধানসভার এলাকা খানিক আলাদা ছিল, তা হোক, সত্যিই তো এই আসনে জ্যোতিবাবু লড়তেন এবং ৭২-এ ভোট লুঠের পরে ৭৭-এ তিনি সাতগাছিয়াতে চলে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই জিতেছেন বারবার। যে আসন আপাতত তৃণমূলের হাতে। কিন্তু এই বরাহনগর কামারহাটি এলাকার মানুষ জ্যোতি বসুর পাশে ছিলেন, তাঁর মিটিংয়ে শেষদিন পর্যন্তও উপচে পড়ত মানুষ। জরুরি অবস্থার আগে থেকেই, ৭০ সাল থেকেই এই অঞ্চলে কংগ্রেসি গুন্ডা মাস্তানদের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়েছিলেন শয়ে শয়ে সিপিএম কর্মী, খুন করা হয়েছে অনেককে। প্রায় প্রতিটি পাড়ায় ওই সময়ে নিহত সিপিএম পার্টি কর্মীর শহীদ বেদি আছে, হ্যাঁ, তাঁরা খুন হয়েছিলেন কংগ্রেসি গুন্ডাদের হাতেই। আজ উল্টোরথ দেখছি, রাজ্য জুড়ে হাত আর কাস্তের নির্বাচনী জোট। সময়ের দাবি, কাজেই জ্যোতি বসুর বরাহনগরের কথা না মনে আনাই সমীচীন, কারণ সে কথা বলতে গেলেই ৭২-এ সাতসকালেই এক ঘণ্টার মধ্যে যে কংগ্রেসি মাস্তান গুন্ডারা ব্যালট বক্সে গুঁজে দিয়েছিলেন ছাপ্পা ভোট, সে কথাও তো বলতে হয়, বলতে হয় বরাহনগর, কামারহাটি অঞ্চলে লাগাতার খুন, ভুয়ো এনকাউন্টারের কথা। বলতে হয়, এমনকী ৭৭-এ ভোটের পরেই ওই কংগ্রেসি গুন্ডাদের হাতে কমরেড রঞ্জন ব্যানার্জির শহীদ হওয়ার কথা। আজকের বাম কংগ্রেস জোট তো ইতিহাস মেনে হয়নি, ইতিহাসকে অস্বীকার করেই হয়েছে। কাজেই পুরনো কথা না তোলাই ভালো। কিন্তু আমরা তত পুরনো নয়, মাত্র আড়াই তিন বছর আগেই কিছু কথা নিয়েই আলোচনা করব, সে সব কথা বলেছিলেন কমরেড তন্ময় ভট্টাচার্য। খুব জরুরি আলোচনার মতো কিছু কথা, যদিও তা সম্ভবত উনি নিজেই ভুলে গেছেন, আমরা মনে করিয়ে দিই, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, বরাহনগরের ভোটের আসরে কমরেড তন্ময় ভট্টাচার্য।
২০২১ সালে হেরেছিলেন তন্ময় ভট্টাচার্য। হারার পরে উনি যা যা বলেছিলেন তার মূল বিষয়গুলো হল:
১. ১৯৪৬ সালের পর এই প্রথম বামশূন্য বিধানসভা গঠিত হচ্ছে। কংগ্রেস শূন্য বিধানসভা গঠিত হচ্ছে। এত বড় একটা ডিজাস্টারের দায় কেউ নেবেন না এমনটা হওয়া উচিত না। এই ডিজাস্টারের দায় নেওয়া প্রয়োজন।
২. এটা মূলত মোদি-বিরোধী ভোট। লকডাউনে নাজেহাল মানুষের ভোট। এনআরসি-র ভয়ে ভীত সংখ্যালঘু ভোটের রক্ষাকর্তা হিসেবে তৃণমূলকে বেছে নেওয়ার ভোট। সবটা মিলে এটা মানুষের সচেতন, সুচিন্তিত রাজনৈতিক রায় তৃণমূলের পক্ষে। বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য তারাই প্রধান শক্তি বলে মানুষ মনে করেছেন।
৩. একদল পার্টির নেতা বক্তৃতা করেন যে, “আমরা ভোটের রাজনীতি করি না, আমরা রাস্তায় থাকি।” তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। তাঁরা রাস্তায় থাকুন। যারা ভোটের রাজনীতি করে তারা ভোট পেয়েছে, ঠিকই আছে। মানুষ তাদেরই বেছে নিয়েছে। রাস্তায় থাকা তো তাদের গর্ব। আমি আমার নেতাদের বলছি আপনি যাতে সেখানে নিশ্চিন্তে থাকেন সেই জন্য মানুষ আপনার হাতে একটা ফুটো বাটি ধরিয়ে দিয়েছে। এবার আপনি ভাবুন, বাটিটা হাতে নিয়ে ঘুরবেন নাকি ভোটের রাজনীতি করবেন!
আরও পড়ুন: Aajke | অমিত শাহ নিজেই আসন কমাচ্ছেন, আসলে ক’টা আসন জিতবে বিজেপি?
৪. আমি জানি আমার মুখে এই কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার পার্টির অনেক কোট আনকোট শৃঙ্খলাবদ্ধ নেতা এবং সৈনিকরা বলছেন পার্টি কর্মী হিসেবে এসব ভিতরে আলোচনা করতে হয়, প্রকাশ্যে না। আমি বলতে চাই যেখানে গোটা সিস্টেমটাই উলঙ্গ হিয়ে গেছে সেখানে কিসের ভিতর আর কিসের বাইরে! যা বলার আজকে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে স্পষ্ট করে বলা উচিত এবং আমি মানুষের কাছে তাই আমার সমস্ত কথাগুলোকে স্পষ্ট করে বলতে চাইছি।
৫. জোট বলেন সংগঠন বলেন সবটা নিয়েই নতুন করে ভাবতে হবে। ফেব্রুয়ারির ব্রিগেডে আসা মানুষ এবং তাদের পরিবার তারাও সকলে আমাদের ভোট দিয়েছে কি না তারও বুথভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
৬. আইএসএফের সাথে জোট করার জন্য পলিটব্যুরোর যে একজন দু’জন নেতা অত্যধিক মাত্রায় আগ্রহী ছিলেন এবং ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সমাবেশে অধীরকে থামিয়ে আব্বাস সিদ্দিকিকে দিয়ে থামতে বলানো এই যে প্রয়াসটাও নেওয়া হয়েছিল এটা জনগণকে এবং জাতীয় কংগ্রেসের মতো একটা দলকে অসম্মান করা হয়েছে বলে আমি মনে করি এবং সেই অসম্মান জনগণ বা জাতীয় কংগ্রেস ভালোভাবে মেনে নেবে না এটাই স্বাভাবিক ছিল।
৭. আমরা নিজেরা আন্দোলন করি, চ্যানেলে বসে বলি যে শ্রমিকের ৭০০ টাকা ন্যূনতম দৈনিক মজুরি দিতে হবে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা আমরা বক্তৃতায় বলি যে ২১ হাজার টাকা আয় না থাকলে একটা সংসার চলে না আর আমাদের পার্টির যারা সর্বক্ষণের কর্মী, যারা তাঁদের গোটা জীবনটা পার্টির জন্য দিয়েছেন আমরা তাঁদেরকে চার-পাঁচ হাজার টাকা দিই। আমি যদি মনেই করি একুশ হাজার টাকা না হলে একটা সংসার চলবে না তাহলে পার্টির একটা হোলটাইমারের একুশ হাজার টাকার কমে চার পাঁচ হাজার ছ’ হাজার টাকায় কী করে চলবে এটা আমাদের নেতৃত্ব ভাবেন না কেন?
৮. এই ডিজাস্টারের দায় উঁচুতলার নেতৃত্বকে নিতে হবে। দায় আমি নেব না। দায় নিচুতলার কর্মীরা নেবে না। নির্দেশ উপরের তলার কর্মীরা দেন, পরিকল্পনা উপরের তলার কর্মীরা করেন আমরা যদি সেই নির্দেশ মোতাবেক না চলে থাকি তারা আমাদের শাস্তি দিন যদি আমি না চলে থাকি আমাকেও শাস্তি দিন। কিন্তু লোকসভায় শূন্য করে দেওয়ার পরও কেউ দায় নিলেন না, বিধানসভায় শূন্য করে দেওয়ার পরও কেউ দায় নেবেন না এটা চলতে পারে না।
আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম যে কমরেড তন্ময় ভট্টাচার্য ২০২১-এর ভোটে মানুষের রায়কে মোদি সরকারের বিপক্ষের রায় বলেছিলেন, সেই একই মানুষ এবারে দিদি মোদি এক হ্যায়, মোদিকে সরাতে হলে দিদিকেও সরাতে হবে বলছেন কী করে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
রাজনীতি রাজনীতির মতো চলুক, কিন্তু রাজনীতির আঙিনাতে দ্বিচারিতার জায়গা নেই। মাত্র তিন বছর আগে প্রকাশ্যেই যা যা বলেছিলেন তন্ময়বাবু তা হাতের কাছেই রয়েছে, তার কোনও জবাব উনি পেয়েছেন কি না জানা নেই, পেয়ে থাকলেও তা মানুষকে বলেননি। বলেননি যে যে নেতার আইএসএফ প্রীতির জন্যে দলের মান ইজ্জত খোয়া গেছে, সেই নেতাই কী করে দলের রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন? বলেননি যে হোলটাইমারদের ভাতা কতটা বাড়ানো হয়েছে, বলেননি এখনও যে মানুষ যদি মমতাকে, তৃণমূলকে মোদি-বিরোধী বলেই মনে করেন তাহলে মমতা মোদি এক হ্যায় স্লোগানের অর্থ কী?