আমাদের বাংলা ভাষায় রানি শব্দের ব্যবহার যত্রতত্র, ছিটে বেড়া দেওয়া মাটির ঘরের উঠোনে রাঙা চেলি পরা মেয়েটির মুখ দেখে বরের পিসি বলেন, ওমা এ তো রানি গো। আমাদের পাড়াগাঁতে এত শত রানি আছে যে রানি শব্দ আলাদা করে কোনও ছবি তুলে ধরে না, আলাদা কোনও শিহরণ হয় না। কিন্তু এবারে নির্বাচনের মাঠে এক রানিমাকে এনে হাজির করেছে বিজেপি। কোথাও ছিলেন তিনি? সমাজ জীবনে? রাজনীতিতে? নিদেনপক্ষে দিদি নাম্বার ওয়ানের মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে? না, ছিলেন না। এঁরা থাকেন না, বাপকেলে বা শ্বশুরের সম্পত্তিতে এক জনবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেন, নিদেনপক্ষে নিজেদের পুরনো প্রাসাদকে এক হেরিটেজ রিসর্ট বানিয়ে দিন যাপন করেন। তাঁদেরই একজন এবারে কৃষ্ণনগরে বিজেপি প্রার্থী। হক আছে ওঁর, গণতান্ত্রিক হক, কত রাজারাজড়ারা দাঁড়িয়েছেন নির্বাচনে বিভিন্ন সময়ে, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে তো আকছার। আমাদের এই মধ্যবিত্ত বিদ্রোহী নাগরিক সমাজে রাজা রানিরা তেমন সাড়া ফেলেনি কোনও দিন। এবারে একজন এলেন, শুধু এলেন নয়, দলে যোগ দেওয়ার পরের দিনেই প্রার্থী, এবং তার দু’ তিন দিনের মধ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ফোন। এ এক আজব প্রধানমন্ত্রী যিনি তাঁর মস্তিষ্কের সবকটা গ্রে সেল দিয়েও বুঝে উঠতে পারেননি যে দেশটা সবার, দেশের সরকারে যে দল বা জোট আছে, এটা যেমন তাদেরও দেশ, যাঁরা বিরোধিতায় আছেন, এটা তাঁদেরও দেশ। দেশের এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি কেবল পুকুর থেকে মগরমচ্ছ ধরেন না, দেশের প্রত্যেক বিরোধী নেতাকে দেশ-বিরোধী, দুর্নীতিবাজ বলে দাগিয়ে দিতে চান। এবং এই নির্বাচনের আগে নবশিখিয়ে, মানে আনকোরা নতুন প্রার্থীদের ফোন করে করে তিনি সেই মূল্যবান কথাগুলো বোঝাতে চান। তো তিনি ফোন করলেন কৃষ্ণনগরের বিজেপি প্রার্থী রানিমাকে। কেন করলেন? উনি ক’দিন আগে সন্দেশখালির রেখা পাত্রকেও ফোন করেছিলেন। কেন? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক ধর্ষিতা মহিলা যিনি দাঙ্গাতে তাঁর পরিবারের অনেককে হারিয়েছেন সেই বিলকিস বানোকে ফোন করেছেন? না করেননি। মণিপুরের ধর্ষিতাদের একজনকেও? না। হাথরসের ধর্ষিতা মহিলার মা কি বাবাকে? না। কৃষক আন্দোলনে শহীদ একজনের পরিবারকে? না। ছেড়ে দিন, গুজরাতে নির্বাচনের সময় মোরভি নদীর সেতু ভেঙে অসংখ্য মানুষ মারা যান, তাঁদের একজনের পরিবারের সদস্যকে ফোন করেছিলেন? না করেননি। তাহলে এখানে ফোন কেন? সেটাই বিষয় আজকে। কৃষ্ণনগরের রানিমাকে মোদিজি আসলে কী বলতে চাইলেন?
প্রায় ৪৮ শতাংশ মুসলমান সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এক কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী রেখা পাত্র, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ফোন করে বললেন, তুমি হলে শক্তি-স্বরূপিনী। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার মেসেজ। শাহজাহানের দল অত্যাচার চালাচ্ছে, তুমি শক্তি-স্বরূপিনী। আর কিছু বলতে হবে? এ খেলা তো নতুন নয়, এভাবেই হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির ঘৃণা আর বিষ ছড়ানোর কাজটা সুচারুভাবে করাটাই তো ওঁর কোর কম্পিটেন্সি।
আরও পড়ুন: দিলীপ ঘোষ কি শুভেন্দু অধিকারীর পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন?
ওদিকে কৃষ্ণনগরের রানিমা, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়বাহাদুর, যিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সমর্থন করে রায়বাহাদুর উপাধি পেলেন, রাজত্ব পেলেন, খাজনা আদায়ের মানে লুঠপাটের লাইসেন্স পেলেন। সেই রাজার বংশধরকে জানালেন, ওসব বিরোধীদের বাজে কথায় কান দেবেন না, ওরা দেশদ্রোহী, ওরা দুর্নীতিবাজ। রানিমা প্রত্যুত্তরে বললেন সেদিন কেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সিরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। সিরাজের নেতৃত্বে নাকি হিন্দু মানুষজনদের উপর দারুণ অত্যাচার চলত, হিন্দুত্ব বিপদে ছিল, আর হিন্দুদের বাঁচাতেই নাকি উনি লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আরেক মহান রাজা জগৎ শেঠের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন মিরজাফরকে, এক বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনিকে হিন্দু-মুসলমান বাইনারিতে এনে দাঁড় করানোর অক্ষম প্রচেষ্টা। মাথায় রাখুন কৃষ্ণনগরেও ৩৬ শতাংশ মুসলমান সংখ্যালঘু ভোট আছে। এবং যথারীতি মুচলেকা বীর সাভারকরের শিষ্যের কাছে এ তো মেঘ না চাইতেই জল, কারণ এতদিন পরে বাংলায় এবং দেশে আবার হিন্দু খতরে মে হ্যায়, তাই মহারানিকে ভোট দিন। সমস্যা হল এই ফোনাফুনির ফলে কৃষ্ণনগরের পথেঘাটে আবার সেই বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। নবীনচন্দ্র সেনের কবিতার লাইন শোনা যাচ্ছে, আবার, আবার, সেই কামান-গর্জন। উগরিল ধূমরাশি, আঁধারিল দশ দিশি! শোনা যাচ্ছে রায়দুর্লভ, জগৎ শেঠ, মিরজাফরদের সঙ্গে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। ভালোই হল, প্রার্থী নিজে বলেই দিলেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন ইংরেজদের দিকেই, যেমনটা অনেক পরে মোদিজির গুরুদেব মুচলেকা বীর সাভারকর ইংরেজদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। মানুষ সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে মিরজাফর, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কি হিন্দুদের বাঁচানোর জন্যেই কি ক্লাইভের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
পিতৃপুরুষের অন্যায়ের দায়, পাপের দায় পরবর্তী প্রজন্মের উপর এসে পড়বে, এটা তো কোনও যুক্তির কথা নয়। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম যদি আগে ঘটে থাকা পাপের সপক্ষে কুযুক্তি এনে হাজির করেন, তাহলে? তাহলে বুঝতে হবে শরীরে সেই পাপের রক্ত এখনও প্রবাহমান। হিটলার বা গোয়েবলস বা গোয়েরিং, নাৎসিদের একজনের পরবর্তী প্রজন্ম ওই খুনি বদমাশদের নাম মুখেও আনেন না। সোনিয়া থেকে রাহুল গান্ধী বহুবার জরুরি অবস্থা জারি করা যে অগণতান্ত্রিক ছিল তা বলেছেন, পাকিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের একজনও ২৫ মার্চ ঢাকাতে যে নৃশংস গণহত্যা হয়েছিল তাকে সমর্থন করে একটা কথাও বলেন না। ইতিহাসে এরকম অনেক উদাহরণ আছে, জাপান বা জার্মানির রাষ্ট্রনায়কেরা বহুবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নৃশংসতার নিন্দা করেছেন উচ্চকণ্ঠে। আর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের হাতে দেশের স্বাধীনতাকে তুলে দেওয়ার ইতিহাস নিয়ে লজ্জিত নন আমাদের মহারানি, তিনি বরং এক মিথ্যে ইতিহাস রচনা করে নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতাকে জায়েজ বলে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন, কিন্তু মানুষ কি সেটা মেনে নেবেন?