সৃষ্টিকর্তা নিয়ে তর্ক আর আলোচনা খুব পুরনো। সেই কবে থেকেই মানুষ বার বার প্রশ্ন করেছে যে যদি প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে এক সৃষ্টিকর্তা থাকাটা জরুরি হয়, তাহলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পিছনেও তো আরেকজন সৃষ্টিকর্তা থাকাটা জরুরি হয়ে পড়ে এবং তার পিছনে আর একটা তার পিছনে আর একটা। এ এক জটিল ধাঁধা। তেমনই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় বেড়ে ওঠা গজিয়ে ওঠা শাহজাহান উত্তম শিবুদের সৃষ্টিকর্তা কে? এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। এমনি এমনিই তো এক একজন খাঞ্জা খাঁ তৈরি হয়ে যাচ্ছে না, এমনি এমনিই তো মাতব্বরের দল আজ জমি কেড়ে নেওয়ার, কাল ঘর ভেঙে দেওয়ার, পরশু পুকুর দখল করে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে না। কোথাও তো এক শক্তপোক্ত খুঁটি থাকে। এবং ভাবলে ভুল হবে যে এই খাঞ্জা খাঁ বা রায়বাহাদুরেরা কেবল এই বাংলাতেই আছে, অন্য জায়গাতে রামরাজত্ব চলছে। অন্য জায়গার ছবি আরও সাংঘাতিক। যখন বাংলার বিজেপির ছোট বড় মেজ সেজ বাবুরা শাহজাহানের পিছনে কে তা মানুষের সামনে আনার দাবি করছেন, তখন ব্রিজভূষণের পিছনে কে সেই দাবি কিন্তু তুলছেন না। কে ছিল ওই হাথরসের ধর্ষকদের পিছনে? সেই প্রশ্ন কি তুলেছেন শুভেন্দু অধিকারী? না, তোলেননি। কারা মণিপুরে নগ্ন করে হাঁটাল ধর্ষিতা মহিলাকে? কাদের প্রশ্রয়ে সেই জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল? তা নিয়ে একটা কথাও সদ্য দলে ঢোকা ন্যাড়া কৌস্তভ বাগচি জিজ্ঞেস করবে? না করবে না। ঠিক যেমন তৃণমূলের কোনও নেতা প্রশ্ন তুলছেন না, উত্তরও দিচ্ছেন না বিভিন্ন এলাকাতে এই শিবু উত্তম শাহজাহানের দল গজিয়ে উঠছে কার প্রশ্রয়ে, এই প্রশ্নের। আর সেটাই বিষয় আজকে, সন্দেশখালির শাহজাহানের পিছনে কে?
১৯৯৯-এ একটা মানুষ ট্রেকার চালাত, হ্যাঁ, গাড়ির ড্রাইভার, মারকুটে, ঝামেলাবাজ ড্রাইভার। তার পিছনের খুঁটি কে? দাদু মোসলেম শেখ, সরবেড়িয়া অঞ্চলের সিপিএম দলের পঞ্চায়েত প্রধান, এরপর সেই দাদুর দৌলতে এলাকার ইঁটভাটা ভেড়ির তোলা আদায় থেকে শাহজাহানের মাতব্বর হওয়ার হাতেখড়ি। ২০০৯ সালে বসিরহাট হেরে যাচ্ছে বামেরা, কিন্তু সরবেড়িয়া লালে লাল। মাতব্বর কিন্তু ওই শেখ শাহজাহান।
আরও পড়ুন: আজকে (Aajke) | ন্যাড়া কৌস্তুভ বাগচি কেন বিজেপিতে?
২০১১, বিধানসভা নির্বাচন, সন্দেশখালি কে জিতছে? নিরাপদ সর্দার, সিপিএম-এর বিধায়ক। পাশাপাশি সব আসনে হারলেও সন্দেশখালি লাল দুর্গ। তখনও শাহজাহান এবং তাঁর দাদু সিপিএমে। দাপটের সঙ্গে ভোট করিয়েছিল ওই শাহজাহান। এরপর ২০১৩, শাহজাহান বুঝে ফেলেছে সারসত্য, পড়ে ফেলেছে দেওয়াল লিখন, আলতো করে দল বদলে তিনি তৃণমূল। এর আগে অন্তত মাথার উপর একটা লোকাল কমিটি কি কিছু নেতার কম হলেও একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল, এবারে তাও উধাও, উনিই নেতা। ২০১৬, তখতা পলট, সন্দেশখালি তৃণমূলের দখলে, নিরাপদ সর্দার যিনি ২০১১তে ৪১ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিলেন তিনি পেলেন ৩১ শতাংশ ভোট, হারলেন। নিরাপদ সর্দার এরপর সন্দেশখালিতে নেই, তিনি থাকেন তাঁর কলকাতার বাড়িতে। ২০১৭ তে সেই দাদুও পড়ে ফেলেছেন দেওয়াল লিখন, মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন যজ্ঞে হিসসা নিতে তিনিও তৃণমূলে। পরেরবার মানে ২০২১-এ বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে, সিপিএম সে আসনে প্রার্থীই দেয়নি, আইএসএফ দাঁড়িয়েছিল, ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, বিজেপি ৩৫ শতাংশ। এ ভোটেও ভোট করিয়েছেন ওই শাহজাহান, হ্যাঁ তৃণমূলের হয়েই কিন্তু তার আগে তিনি এক দোলাচলে কাটিয়েছেন কিছুদিন। কারণ তৃণমূল দলে তাঁর মেন্টর গাইড শুভেন্দু অধিকারী দল ছেড়েছেন। শেষপর্যন্ত ভুল করেননি, তৃণমূলেই থেকে গেছেন। কিন্তু একটা ভুল তো করেইছিলেন, তা হল শুভেন্দু অধিকারীর নির্দেশ মেনে বিজেপিতে যাননি। আর একটু খতিয়ে দেখুন, ইডি সিবিআই গেছে তাঁদের বাড়িতে যাঁরা কোনও না কোনও সময় শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু বিজেপিতে যাননি। সেই তালিকাতেই শাহজাহানও ছিলেন, ইডি গেল এবং ইডি সামলাতে গিয়ে শাহজাহান খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। আসলে এই শাহজাহানের দল কোনও দলেরই হন না, এঁরা সময়ে সুযোগে শাসকদলে ভিড়ে যান, কারণ জানেন মধুভাণ্ড ওইখানেতেই আছে। এঁরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, দেশ, সংবিধান কিছুই বোঝেন না, এঁদের মাথায় আছে ধান্দা। মাত্র আজই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ভারি সত্যিটা বলেছেন কুণাল ঘোষ, তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেছেন “নেতা অযোগ্য গ্রুপবাজ, স্বার্থপর। সারাবছর ছ্যাঁচড়ামি করবে আর ভোটের মুখে দিদি অভিষেক দলের প্রতি কর্মীদের আবেগের উপর ভর করে জিতে যাবে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করবে, সেটা বারবার হতে পারে না।” এই খানেই শাহজাহানের জন্ম, এই ক্ষমতা আর তার মধুভাণ্ডই আসলে শাহজাহানের সৃষ্টিকর্তা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই শাহজাহান, উত্তম শিবুরা কি কোনও দলের? এরা কি কেবল তাদের ধান্দাবাজির জন্যই বারবার শাসকদলকেই ব্যবহার করে না? কিছুদিন আগে যারা সিপিএম ছিল, এখন তারাই তৃণমূল, কিছুদিন পরেই এরা আবার বিজেপি হয়ে উঠবে না? শুনুন দর্শকরা কী বলেছেন।
ত্যাগব্রতের যাবজ্জীবন একদিন যাদের ব্রত ছিল, তারাই আজ চলেছে দশ ঘোড়ার জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে, পথচারীদের তফাত করে দিয়ে। সে তো ছিল তাদের কথা যাঁদের এককালে হলেও এক ত্যাগ, লড়াই, আদর্শ ছিল, আজ যাদের কথা হচ্ছে তাদের কোনও কালেই কোনও আদর্শ ছিল না, এরা রাজনীতি বলতে চেনে শাসকদল, রাজনীতি বলতে জানে হাতে ক্ষমতা। আর সেই ক্ষমতা হাতে নিয়ে এরা যুগে যুগে সমান। কে উধাও করে দিল ভিখারি পাসোয়ান কে? কারা করন্দাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কৃষক খুন করেছিল? কারা বানতলায় ছোট্ট করে ধর্ষণ করেছিল? কারা বগটুই থেকে সন্দেশখালির মাতব্বর। সব্বাই জানে এরা কোনও দলের নয়, এরা ক্রিমিনাল, এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই রাজনীতিকে ব্যবহার করে। আমাদের রাজ্যের কেন? কোনও শাসকদলই কি সেই কথা বুঝতে পারে? হ্যাঁ পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়, এই যা।