আজ নয় সেই ৫২ সাল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম নির্বাচন। সেই তখন থেকেই দুর্নীতির কিসসা শুনে আসছে দেশের মানুষ। কত রকমফের দুর্নীতি। তো প্রথম প্রথম দুর্নীতিগুলোর পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি, ৩০ কোটি। তারপর তা বাড়তে বাড়তে ৩০০, ৩০০০ কোটি, এখন দুর্নীতি মাপতে গেলে আগে লক্ষ তারপর কোটি বসাতে হচ্ছে। মানে তিন লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি, এইরকম অভিযোগও উঠছে। অর্থনীতি ট্রিলিয়নের ঘরে ঢুকছে, দুর্নীতি, বা বলা যাক দুর্নীতির অভিযোগও পাল্লা দিয়ে ট্রিলিয়ন ছুঁয়ে ফেলার চেষ্টাতে আছে। ইদানিং তো রাজনৈতিক বক্তৃতাও শুরুই হয় দুর্নীতির অভিযোগ দিয়ে, শেষও হয় ওই একই অভিযোগে। সবাই সব্বাইকে জেলে পোরার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তবুও এই দুর্নীতির কিসসাতে কি নতুন কিছুই নেই? আছে বইকী। ধরুন অন্তত একবার দুর্নীতির দায়ে বা দুর্নীতির ইস্যুতেই সরকারে থাকা দল হেরে গিয়েছিল। রেকর্ড ভোটে জিতে আসা রাজীব গান্ধী পরের নির্বাচনেই দলকে জিতিয়ে আনতে পারেননি। কিন্তু তারপর সেই দুর্নীতির কী হল? সে দুর্নীতির না পাওয়া গেছে কোনও প্রমাণ, না পাওয়া গেছে রাজীব বা সোনিয়ার সামান্যতম যোগাযোগ। অথচ তাবড় তাবড় বিরোধী নেতা অটল বিহারী থেকে আদবানি, জ্যোতি বসু থেকে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, ভি পি সিং থেকে লালু যাদব জনসভায় জনসভায় বলেছেন, একবার ক্ষমতায় আসতে দিন, সব তথ্য রাখা আছে, টাকা বের করে আনব, জেলে পুরবো ইত্যাদি। বিপ্লবী পত্রিকা গণশক্তির প্রথম পাতায় রোজ, প্রতিদিন সেই দুর্নীতির তথ্য আর খবর। বহু বছর কেটে গেছে কেউ কথা রাখেনি, মানুষটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল মাটিতে, মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার গায়ে সেই দুর্নীতির কালি থেকেই গিয়েছিল, গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। আজ সেটাই বিষয় আজকে, দুর্নীতির কামান দাগছেন নেতানেত্রী, জনগণ বিভ্রান্ত।
সম্ভবত ওই সময় থেকেই মানে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্ব কংগ্রেসের পরাজয়, ওই দুর্নীতির দায় নিয়েই, আর সেটাই ভারতবর্ষের মানুষকে খানিক স্টোইক, খানিক নিরাসক্ত করে তুলেছিল। কিন্তু সেই দুর্নীতি ইস্যু আবার মাথাচাড়া দিল মনমোহন জমানার শেষ ক’ বছরে। না, এবারে ঠিক ওই বিরোধী নেতারা সামনে ছিলেন না, বরং সামনে আন্না হাজারে, কেজরিওয়াল, প্রশান্তভূষণ, বাবা রামদেব, কিরণ বেদী আর পেছনে কে নেই? বিজেপি থেকে সিপিএম সব্বাই। এবারও সরকার পড়ল, কিন্তু ক্ষীর খেলেন নরেন্দ্র মোদি, ক্ষমতায় এল বিজেপি। এই উত্থানের কথা ভাবতেও পারেনি সমাজবাদী দল থেকে কমিউনিস্টরা।
আরও পড়ুন: Aajke | অমিত শাহের বাংলা ভ্রমণ
ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতি নিয়ে আরও সোচ্চার হল বিজেপি, আর সেই সোচ্চার হওয়ার পিছনে তাদের পাকা মাথা কাজ করছিল। তাঁরা কিছুদিনের মধ্যেই দুর্নীতিকে দুটো ভাগে ভাগ করে নিলেন, আমাদের দুর্নীতি, তোমাদের দুর্নীতি। মানে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষজন যদি বিজেপিতে থাকে তাদের কিচ্ছুটি হবে না, তাঁদের বাড়িতে ইডি যাবে না, সিবিআই যাবে না, ইনকাম ট্যাক্স যাবে না। কিন্তু দুর্নীতি যদি তোমাদের হয়, তাহলে নো পাসারন, ছাড় পাবে না। আর হলও তাই, দুর্নীতির অভিযোগে জেলে গেছেন যতজন, ইডি কেস হয়েছে যতজনের বিরুদ্ধে, যাঁরা বেল পেয়ে বাইরে বা জেলে তাঁদের ৯৯ শতাংশ বিরোধী দলের নেতানেত্রী, ঘনিষ্ঠ সমর্থক, কর্মী ইত্যাদি। এবং কোনও ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই, তোয়ালে মুড়ে পয়সা নিয়েছ? এদিকে চলে এসো, ওয়াশিং পাউডার নিরমা। কোটি কোটি টাকা তছরুপ করেছ? ইধার আ যাও, শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ারের দুর্নীতির কথা কে বললেন? প্রধানমন্ত্রী নিজে। তারপরের দিনেই অজিত পাওয়ার এনডিএ-তে, ওয়াশিং পাউডার নিরমা। তো শরদ পাওয়ারের ভাইপো যদি দুর্নীতির দাগ মুছে ফেলতে পারেন, তাহলে সেই একই অফার তো যাবেই অন্য ভাইপোদের কাছে, গেছে, মায়াবতীর ভাইপোর কাছে গেছে, মমতার ভাইপোর কাছে গেছে। অফার অ্যাকসেপ্ট না করলে পিছনে পড়ে থাকবে, রোজ ডাকবে, রোজ নোটিস পাঠাবে, অ্যাকসেপ্ট করে নিলে আর কোনও সমস্যাই থাকবে না। আর এই সহজ খেলাটা বুঝে গেছেন দেশের মানুষ। রাখাল রোজ বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করে ভয় দেখাত, শেষে মানুষ বুঝতে পেরে আর দৌড়ে আসত না। ঠিক সেইরকমই দুর্নীতির কথা শুনে মানুষ আর বিচলিত হন না। মানুষ দুর্নীতির অভিযোগে পাত্তাই দেন না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই বোফর্স থেকে দুর্নীতির অভিযোগই শুনে আসছে মানুষ, কোনও দুর্নীতিই কোনওদিনই প্রমাণিত হয় না, সেই জন্যেই কি মানুষ দুর্নীতির অভিযোগকে পাত্তাই দেয় না? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
আচ্ছা আজ হঠাৎ এই দুর্নীতির কাসুন্দি নিয়ে পড়লাম কেন? পড়লাম কারণ গতকাল বক্তৃতা মঞ্চ থেকে অমিত শাহ সেই একই দুর্নীতির কথাই বলে গেছেন, আগেও বহুবার বলেছেন। নারদা দুর্নীতির ভিডিও তো বিজেপি রাজ্য দফতরে বসেই দেখানো হয়েছিল, যেখানে শুভেন্দুকে হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গেছে। সেই দুর্নীতি প্রমাণ হয়নি, সারদার কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির একজনও শাস্তি পাননি। আবার নতুন করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চাকরি দুর্নীতি, গরু পাচার ইত্যাদির অভিযোগে। এখনও পর্যন্ত চার্জশিটও দেওয়া হল না। মানুষ জানেন এসবও আবার কালের স্রোতে পাল তুলে ভেসে যাবে কোন সুদূরে। কাজেই গতকাল হতাশ অমিত শাহ ছোট্ট ভাষণে যা বলেছেন, জনগণ তাকে পাত্তাও দেয়নি।