Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeফিচারশূন্য এ বুকে একুশের জুনে...

শূন্য এ বুকে একুশের জুনে…

Follow Us :

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার দশক আগের কথা। ১৯৭৭ সালের একুশে জুন। বাংলায় প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত সরকারের পত্তন হয়। পাঁচটি মার্ক্সবাদী দল মিলিত ভাবে একটি অঙ্গ রাজ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার ভার পায়।  গত ২০১১ সালে সেই বাম জমানার অবসান হয়। কিন্তু এই একুশ সালে এসে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের বর্ষপূর্তি  হচ্ছে, যখন বাংলার বিধানসভায় তাদের একজনও প্রতিনিধি নেই।  বামফ্রন্ট সরকার গঠনের ঠিক এক দশক আগে ১৯৬৭ সালে উত্তরবঙ্গের তরাইয়ে নকশালবাড়িতে সমাজ বদলের ডাক দিয়েছিলেন একদল বামপন্থী। সেই থেকে ভারতীয় মার্কসবাদীরা মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। একদল সংসদীয় পথে বিপ্লবের রাস্তা খোঁজে, অন্যদল সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন লালন করে চলেছে।

১৯৬৪ সালে অভিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি তখন আনুষ্ঠানিক ভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়নি। তার একটি অংশের পক্ষে নতুন পার্টি গঠনের লক্ষ্যে ওই বছরের এপ্রিলে  বাসবপুননাইয়ার ভূমিকা সম্বলিত একটি খসড়া কর্মসূচি প্রকাশিত হয়। শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কমিউনিস্টদের ইচ্ছার কথা বলা হয় তাতে।  কিন্তু শাসক শ্রেণি যে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না, বা দেয় না ,এমন কথাও জোর দিয়ে বলা হয়েছিল। যার সুবাদে সংসদীয় এবং সংসদ বহির্ভূত সংগ্রামের সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের নিদান দেওয়া হয়। সেই খসরাতে ভোটের মাধ্যমে কেন্দ্রে বা কোনো অঙ্গরাজ্যে ক্ষমতায় বসে সমাজ বিপ্লব এগিয়ে নেওয়া যাবে এমনটা বলা হয়নি। পরে ওই বছরের নভেম্বরে কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচির ১১২ নম্বর ধারায় পার্টি যদি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যে জনগণের আশু সমস্যাবলী প্রশমনের এক বিনম্র কর্মসূচিতে অঙ্গীকারবদ্ধ কোনো সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে,তাহলে সে নিশ্চই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। ওই ‘বিনম্র কর্মসূচির’ ঘোষণা থেকেই পরবর্তী কালে শুরু হয় মার্কসবাদীদর মতাদর্শগত তুমুল বিতর্ক। যার জেরে বাংলার তথা গোটা দেশের মার্ক্সবাদীরা অসংখ্য গোষ্ঠীতে বিভাজিত। বিভাজনের সেই ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত। তবে সংসদীয় রাজনীতির পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিয়োজিত বামপন্থীরা এখনও সংখ্যায় এবং জনপ্রভাবে অনেক বেশি ভারী।

আরও পড়ুন: পিএসি’র চেয়ারম্যান মুকুল

দেশে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনার শতবর্ষ অতিক্রান্ত প্রায়(জন্ম সাল নিয়ে মতান্তর উহ্য)। সংসদীয় পন্থীদের সৌজন্যে বামপন্থার যেটুকু অবশেষ ছিল বাংলায় তা পরিষদীয় পরিসরে অপসৃত। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ইতিহাসে স্বাধীনতা উত্তরকালে এই প্রথম মার্কসবাদীরা শূন্য। প্রায় সাড়ে চার দশক রাজ্যের রাজনীতি ও সামাজিক স্তরেও যাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য অটুট ছিল। ক্ষমতাচ্যুতির এক দশকের মধ্যে বিধানসভা আসনের নিরিখে সংসদীয় মার্ক্সবাদীরা নিশ্চিহ্ন।

সংসদপন্থী মার্ক্সবাদীদের নিয়ে যুক্তফ্রন্টের আমল। সংসদ সর্বস্ব পথ ছেড়ে সশস্ত্র কৃষক বিপ্লবের ডাক দিয়ে তৎকালীন শাসক ফ্রন্টের অংশীদার মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন। রাষ্ট্র শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের দুঃসহসিক অভিযান। যার রক্ত ঝরা যাত্রা শুরু ১৯৬৭ সালে নকশাল বাড়িতে।  ষাটের দশকেই অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানেও ঠাঁই পেয়ে গিয়েছিল ‘নকশাল’। শুধু বঙ্গে নয়, দক্ষিণাত্য সহ দেশময় মার্কসবাদীরা বিভক্ত হতে শুরু করে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে। সংবাদ মাধ্যমের লব্জ ,বাম এবং অতিবাম। আধুনিক সময়ে ‘অতিবাম সন্ত্রাসবাদ’- (এল ডব্লিউ ই) ,শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয় সরকারি নথিতে।

আজ বাংলায় বিধানসভা যেমন বাম প্রতিনিধি শূন্য,তেমনই নকশালবাড়িতে বাম বা মধ্যপন্থী তো দূরস্ত, অতি দক্ষিণপন্থীর দাপট।  ঘটনাচক্রে নকশালপন্থার জনক চারু মজুমদারের  সদ্য  শতবর্ষের পেরোনো কালে ফাঁসীদেওয়া নকশাল বাড়ির জনগণ  সংসদীয় পথে তাঁদের প্রতিনিধি বেছে নিয়েছেন হিন্দুত্ববাদী  দলের সদস্যকে। অর্থাৎ সংসদীয় পথ অথবা সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক, সবই এখন বাংলায় অতীত। অন্তত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বামেরা তা সে যে কিসিমের হোক না কেন, পায়ের তলায় জমি হারিয়েছে। সংসদীয় পথ আঁকরালেও ক্ষমতায় টিকে থাকার অনিশ্চয়তা কখনোই উড়িয়ে দিতে পারেনি তারা।

আরও পড়ুন:মোদীর রাজ্য থেকে এগিয়ে দিদির বাংলা

ভারতে প্রথম মার্কসবাদীরা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যে ক্ষমতায় বসে কেরলে, ই এমএস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে। সেটা অভিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির যুগ। সেকথা বিস্মৃত না হয়েও বলা যায় সংসদীয় রাজনীতির ফলিত প্রয়োগে দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য জ্যোতি বসু। জরুরি অবস্থার পৃষ্ঠভূমিতে দাঁড়িয়ে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট বাংলায়  প্রথম সংখ্যগরিষ্ঠ বাম সরকার গঠন করে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সেই সরকার তিরিশ বছর একটানা টিকে থাকার পর জ্যোতি বাবুর উপলব্ধি, ‘আমরা যে কখনো সরকার গঠন করতে পারব, আর সেই সরকার যে এত দিন টিঁকবে, তা আগে কখনো ভাবতেও পারিনি! ১৯৫৭ সালে কেরালায় যখন প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হলো তখনও আমাদের সামনে অতটা পরিষ্কার ধারণা ছিল না যে এই পুঁজিবাদী সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে একটি অঙ্গরাজ্য কমিউনিস্টরা সরকার গঠন করলে কি করা সম্ভব, কতখানি করা সম্ভব। সেসব আমরা পরে ভেবেছি! ১৯৬৪ সালে সিপিআই(এম) যখন গঠিত হল, তখন পার্টি কর্মসূচিতে আমরা বললাম, এরকম সরকারে গেলে সমাজব্যবস্থার খুব বড় কিছু অদল-বদল হয়তো আমরা করতে পারবো না। কিন্তু এই সংবিধানের যে অধিকার দেওয়া আছে তাকে কাজে লাগাতে হবে। মানুষের স্বার্থে এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার আমাদের করতে হবে। মানুষকে কিছু রিলিফ আমরা নিশ্চয়ই দিতে পারবো এইসব সরকারকে ব্যবহার করে। পার্টি কর্মসূচি সময়োপযোগী করে আমরা বলেছি, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সরকার গুলি বিকল্প নীতি তুলে ধরবে ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে।’

 

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতিবাবু ২০০৭ সালে যখন সকারের অনিশ্চয়তার কথা বলছেন,তখন কি কেউ জানতেন, বামফ্রন্ট সরকারের আয়ু আর বছর চারেক ? শুধু কি তাই ২০২১ সালে বামফ্রন্টের বর্ষপূর্তির সময় বাংলার বিধানসভায় একজন বামপন্থী জনপ্রতিনিধি থাকবে না, তা বামেদের অতি বড় শত্রুরও  দিবাস্বপ্নের অতীত ছিল। কিন্তু  জনগণকে ‘বিনম্র’,কর্মসূচির মাধ্যমে রিলিফ দেওয়ার রাজনীতি সিপিএমের মতে সরকারের তথা বর্তমান সমাজে কাঠামোর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলবে। মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে মানুষের বিশ্বাস তৈরি হবে।

কালক্রমে ‘মৌলিক পরিবর্তন’ এর লক্ষ্যে ওই রণকৌশল, দলের রণনীতিতে পর্যবসিত হয়েছিল। তাই পুঁজিবাদী কাঠামোটাকে ঘষে মেজে গ্রহণযোগ্য করে তোলাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল তারা। বাম শক্তির বিকাশের নামে ‘চোখের মনির’  মতো ফ্রন্ট সরকার টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়। ফলে সংসদীয় পথই হয়ে ওঠে সিপিএমসহ বামফ্রন্ট ভুক্ত দলের মোক্ষ। জ্যোতি বসু নিজেও বলতেন, পার্লামেন্টারি পথ পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা সিপিএমের নেই। ‘এই পথে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসতে পারে কি না তা দেখবার জন্য আমরা একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছি। নয়ের দশকের পর থেকে এসব প্রসঙ্গ সিপিএম নেতারা বিশেষ আলোচনা করতেন না। কেননা ততদিনে সরকার টিকিয়ে রাখাতে তারা মরিয়া। অন্যান্য অবাম দলগুলির সঙ্গে সিপিএম বা ফ্রন্টের আচরণগত বা দৃষ্টিভঙ্গিগত  ফারাক পার্টির দলিলের বাইরে সম্পূর্ণ মুছে  গিয়েছিল। নির্বাচনী ময়দানের লড়াইতে ক্রমে পিছু হাটতে হাটতে বর্তমানে নিশ্চিহ্ন।

মানুষকে ‘রিলিফ’ দেওয়ার কাজে বামেদের পিছনে ফেলে অনেক এগিয়ে গিয়েছে তৃণমূল সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তাঁর দশ বছরের কার্যকালে রাজ্যবাসীর জন্য যেসব আর্থ-সামাজিক প্রকল্প চালু করেছেন, তা গোটা দেশেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিক্ষেত্রে সরকারের বিবিধ আর্থিক সহযোগিতামূলক প্রকল্প চালু করেছেন মমতা। যার সুবাদে এক দশক ক্ষমতায় থাকার পরেও তাঁর সরকারের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা জনমানসে দাগ ফেলতে পারেনি। বামেরা এই প্রশ্নে রাস্তায় নেমেও জনতার মন জয় করতে পারেনি। বামেদের সেই দুর্বলতার জেরে রাজ্যের বিরোধী পরিসরে মূলত ধর্মীয় বিভাজনের পথ ধরে অতি দক্ষিণপন্থা জায়গা করে নিয়েছে। এই মেরুকরণ বাম শক্তিকে আরও অপাংক্তেয় করে তুলেছে। বিকল্প নীতির কথা বললেও মানুষের কাছে তা নিয়ে পৌঁছতে পারেনি বামেরা। তার দায় কার, এনিয়ে এখন চর্চা শুরু হলেও বিশেষ দিশা দিতে পারেনি ফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিএম। তৃণমূল বিরোধিতায় প্রথমে কংগ্রেস ও পরে আনকোরা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আই এস এফ) এর সঙ্গে জোট বাঁধলেও সংকট বেড়েছে বৈ কমেনি। দলের অভূতপূর্ব ভরাডুবির ময়না তদন্ত করতে গিয়ে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের জেরেই রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাব কাটিয়ে উঠে নির্বাচনী সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। অতএব জনগণকে ‘রিলিফ’ দেওয়া  যদি বামপন্থীদের একমাত্র এজেন্ডা হয় ,তাহলে তারা  অদূর ভবিষ্যতেও মমতার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কি?

RELATED ARTICLES

Most Popular