তালিবানের রক্তচক্ষু আড়াল করতে কাবুলে গোপনে চলছে মেয়েদের স্কুল। প্রায় ৫০ জন মহিলা সেই গোপন স্কুলে নিয়মিত অঙ্ক, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের ক্লাস করে চলেছে। সেই স্কুলে পড়াশোনা চলছে অত্যন্ত গোপনে, রীতিমতো ফিসফিসিয়ে, যাতে বাইরে কোনও শব্দ না যায়। বাইরে আওয়াজ গেলে পাছে তালিবানদের হাতে ধরা পড়ে যেতে হয়, তাই এত গোপনীয়তা, এত সতর্কতা।
৫০ জন ছাত্রীর ওই স্কুলে দিদিমণি মাত্র একজনই। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক মুরসাল (নাম পরিবর্তিত) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুল চালাচ্ছেন। রেডিও আজাদিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে আমি এই কাজ করছি। জানাজানি হলে আমার এবং এই বাচ্চাদের চরম বিপদ ঘটে যেতে পারে। তালিবান ক্ষমতায় আসার পরই মেয়েদের সাহায্য করার জন্যই আমার এই ছোট্ট উদ্বেগ।’ মাত্র ২০ বছর বয়সি মুরসাল সম্পূর্ণ নিজের খরচে এই স্কুল চালাচ্ছেন। বই, খাতাপত্রের সব খরচই তাঁর নিজের।
মুরসালের এক ছাত্রী সুরাইয়া (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘তালিবানদের ক্ষমতায় ফিরে আসা মানে সারা জীবনের জন্য আমাদের জেলবন্দি হয়ে থাকা। তবু এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে মুক্তির আস্বাদ পাচ্ছি। জানি না, কত দিন এভাবে লুকিয়েচুরিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। আর এক ছাত্রীর কথায়, ‘পড়াশোনা করতে না পেরে অনেক মেয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছে। এই স্কুলে ক্লাস করতে পেরে অবসাদ অনেকটাই কাটাতে পারছি।’ এই গোপন স্কুলের অন্য এক ছাত্রী গুল মিনা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘তালিবান শাসকদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, দয়া করে মেয়েদের পড়াশোনার অধিকার ফিরিয়ে দিন। তা না হলে দেশের মেয়েরা অশিক্ষার অন্ধকারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গর্ভে চলে যাবে।
বেশ কয়েক মাস ধরে কাবুল শহরের একটি বাড়িতে চলছে এই স্কুল। ছাত্রীরা এখানেই থাকেন। গত বছরের অগাস্ট মাসে তালিবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মেয়েদের পড়াশোনা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কট্টর এই ইসলামপন্থীরা প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের পড়াশোনায় অনুমতি দিয়েছে, তাও অনেক শর্ত চাপিয়ে। কিন্তু দেশের ৩৪টি প্রদেশের অনেক জায়গাতেই সেকেন্ডারি স্কুল বা মাধ্যমিক স্তরের স্কুল একেবারে বন্ধ। মুরসালের এই আন্ডারগ্রাউন্ড স্কুলে বিভিন্ন বয়সের মহিলা নিয়মিত পাঠ নিচ্ছেন।
তালিবান শাসকরা যদিও দাবি করেন, মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধের সিদ্ধান্ত সাময়িক। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। কিন্তু সমালোচকরা তালিবান শাসকের এই দাবি মানতে নারাজ। কারণ তাঁদের অতীত অভিজ্ঞতা খুবই করুণ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম তালিবান জমানায় শাসকরা একই আশ্বাস দিয়েছিলেন। ওই ৬ বছরের রাজত্বে পরিস্থিতির কোনও বদল ঘটেনি। ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানের উপর আমেরিকা কর্তৃত্ব কায়েম করার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। আফগানিস্তানের শহুরে মেয়েরা আবার স্কুল কলেজে ফিরতে শুরু করে। তালিবান শিক্ষামন্ত্রকের মুখপাত্র নাজার মহম্মদ ইরফানের দাবি, তারা কখনওই মহিলাদের বেসরকারি এবং ইনফরমাল স্কুলে পড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর নারী সুরক্ষা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর হিদার বার বলেন, তালিবানরা ঠিক কী চাইছে বোঝা যাচ্ছে না। আসলে তারা মন থেকেই চায় না যে, মহিলারা পড়াশোনা করুক।