লোকসভা ভোটের আগে ‘অসমাপ্ত’ রামমন্দিরের উদ্বোধন ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা যদি হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা হয়, তাহলে নরেন্দ্র মোদি সরকারের অ্যানুয়াল পরীক্ষা ছিল নির্মলা সীতারামনের অন্তর্বর্তী বাজেট। দক্ষিণ ভারতকে বাদ রেখে গোটা হিন্দি বলয় এবং উত্তর-পূর্ব ভারত বিজেপি বগলদাবা করে রেখেছে। যার অধিকাংশই কৃষিজীবী। অযোধ্যার সাফল্য বা রামধুন গেয়ে যে আমজনতার হাঁড়ির চাল ফুটবে না, তা সহজেই অনুমেয়। ফলে বাজেটে রামরাজত্বের বাসিন্দাদের আর্থিক স্বস্তি দেওয়াই ছিল সীতার অগ্নিপরীক্ষা। নিঃসন্দেহ, করকাঠামো অপরিবর্তিত রেখে মধ্যবিত্তকে হাড়িকাঠে বসিয়ে ভোটের বছরে বিরাট চ্যালেঞ্জ নিল মোদি সরকার।
সবথেকে বড় হতাশ হয়েছে মধ্যবিত্ত তথা চাকরিজীবী শ্রেণি। অনেকেই ভেবেছিলেন ভোটের বছর বলে আয়করে ছাড় অথবা ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়তে পারে। ঠিক সেই জায়গাতেই সীতারামন বলেন, ভোটের বছর বলেই কর কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই করকাঠামোই এক থাকছে। সম্ভবত বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে মোদি সরকার এই পথে হাঁটলেও এতে বিরূপ হয়েছে আমজনতা।
আরও পড়ুন: আগামিদিনে আরও সস্তা হবে বিমান যাত্রা, বাজেটে দাবি নির্মলার
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২৪ সালের ভোট বৈতরণী পার করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যার একটি ছিল রামমন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় গাণ্ডীব তিনি ধরে রেখেছিলেন নির্মলার বাজেট। মোদির সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তৃতাতেই বোঝা গিয়েছিল, ভোটারদের মন গলাতে তেমন কোনও কঠিন সংস্কারের পথে হাঁটবে না সরকার। এদিন সেই ঘটনাই ঘটল। নির্মলা সীতারামনের সংক্ষিপ্ততম বাজেট ভাষণে তিনি উপর উপর উন্নয়নের জপতপ ছাড়া বিশেষ কিছু মালমশলা আমদানি করতে পারেননি। অনেকটা ছেলেভুলানো কাঠি আইসক্রিমের মতো। চুষে শেষ করার পর হাতে রইল শুধু কাঠিটুকু।
কৃষি ও শিল্পের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাজেট তৈরি করাই চ্যালেঞ্জ সীতারামনের কাছে। বিজেপি এবং তার চালিকাশক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘও জানত দেশের বৃহত্তর অংশ, সর্বোপরি মহিলা ভোটারদের হাঁড়ি-হেঁসেলে হাসি ফোটাতে না পারলে নতুন ক্লাসে ওঠা কঠিন হয়ে যাবে।
অযোধ্যা, বারাণসী, প্রয়াগরাজ, মথুরা, কামাখ্যা, বৈষ্ণোদেবী, কেদারনাথসহ চারধাম, অমরনাথ, পুরী, ত্রিপুরেশ্বরী, তিরুপতি, কাঞ্চি, রামেশ্বরম সহ দেশের তীর্থস্থানগুলিতে ধর্মীয় পর্যটন শিল্পে জোর দিতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে মুসলিম তীর্থস্থানগুলির ক্ষেত্রেও বিশেষ নজর দেবে সীতারামনের বাজেট। তিনি বলেন, স্থানীয় শিল্প-বাণিজ্যের জন্য ধর্মীয় পর্যটন শিল্পের প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলির সর্বাত্মক উন্নয়নে রাজ্যগুলিকে উৎসাহিত করা হবে। শুধু তাই নয় ধর্মস্থানগুলি নিয়ে প্রচার ও পর্যটনে উৎসাহ দিতে কেন্দ্র সহযোগিতা করবে। দেশে নয়, বিদেশি পর্যটক টানতে ধর্মকে বাজারিকরণের প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাতেও বিপুল টাকা ঢালতে চলেছে সরকার। ২০১৫ সালের জুনে চালু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সকলের জন্য বাড়ি প্রকল্পের লক্ষ্যপূরণ না হওয়ায় তার মেয়াদ বাড়ানোর পথে হেঁটে আরও ২ কোটি গ্রামীণ গৃহনির্মাণের ঘোষণা করেন নির্মলা।
সীতারামনের কঠিন পরীক্ষা ছিল মূলধনী ব্যয়, আর্থিক ঘাটতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ, নতুন পদসৃষ্টি ও নিয়োগ, পরিবহণ ও পরিকাঠামো ক্ষেত্র থেকে আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। এছাড়াও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দের প্রস্তাবে দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদের গরিমা গড়ে তোলার চেষ্টা রয়েছে। চীন ও পাকিস্তানের বিপদকে শিখণ্ডী করে বিজেপির অর্থমন্ত্রী সীমান্ত অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে বিরাট বরাদ্দ প্রস্তাব এনেছেন প্রতিরক্ষা খাতে। অর্থমন্ত্রী শুরুতেই বলেছেন, বৃদ্ধি ঘটাতে আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটবে এই বাজেট। বিরোধীরা এই বাজেটকে ইতিমধ্যেই গরিব বিরোধী, ধনীদের বাজেট বলে সমালোচনায় মুখর হয়েছে। অনেকেই একে ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহার বলে বর্ণনা করেছেন। সে কারণেই প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাবিত পরিমাণ ৬.১ লক্ষ কোটি টাকা। যা কৃষি ও কৃষক উন্নয়ন খাত, সার ও রসায়ন মন্ত্রক এবং গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের মোট বরাদ্দের থেকেও বেশি। এই তিন মন্ত্রকের মিলিত বরাদ্দের পরিমাণ ৪.৭২ লক্ষ কোটি টাকা।
কোথায় কত বরাদ্দ (লক্ষ কোটি টাকায়)
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক: ৬.১
সড়ক পরিবহণ ও হাইওয়ে: ২.৭৮
রেলমন্ত্রক: ২.৫৫
উপভোক্তা বিষয়ক, খাদ্য এবং গণবণ্টন: ২.১৩
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক: ২.০৩
গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক: ১.৭৭
সার ও রসায়ন মন্ত্রক: ১.৬৮
যোগাযোগ মন্ত্রক: ১.৩৭
কৃষি ও কৃষক কল্যাণ: ১.২৭
এছাড়াও শিক্ষা, শিশু ও নারী স্বাস্থ্যে জোর দিয়েছেন নির্মলা। কারণ ১৪০ কোটির ভারতে এই ক্ষেত্রে ভোটার সংখ্যা সবথেকে বেশি। বিশেষত নতুন ভোটারদের শতকরা ৮০ ভাগই পড়ুয়া। তাই তাদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন সীতারামন। সুস্থ সন্তানই গড়ে তুলতে পারে মজবুত ভারত কিংবা নারীই দেশের মূল শক্তি— এ ধরনের কোনও স্লোগানে বিশাল স্বপ্নের ফানুস ফোলানো হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। সব মিলিয়ে লোকসভা ভোটের বছরে ‘নির্মল’ পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের মুখে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গোছের ললিপপ ঠুসে দিয়েছেন সীতারামন।
অন্য খবর দেখুন