Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | নেতাজিকে অপমান দেশের মানুষ মেনে নেবেন?

Fourth Pillar | নেতাজিকে অপমান দেশের মানুষ মেনে নেবেন?

Follow Us :

ছবি এখনও আসেনি বাজারে। এক ছোট্ট টিজারে বলে দেওয়া হল, সাভারকর ছিলেন নেতাজির অনুপ্রেরণা। একই সঙ্গে এক মানুষ নেতাজিকেও অনুপ্রাণিত করছেন, আবার নাথুরাম গডসেকেও অনুপ্রাণিত করছেন, ভাবা যায়? এটা স্বাধীন দেশে দু’ একজন উটকো মানুষ বলছে না, একটা গোটা ছবি হচ্ছে, এবং এই সমস্ত তথ্য বিকৃতি এক ধরনের কৌতূহল তৈরি করছে, ছবি ব্যবসা করছে। ব্যস মিটে গেল। প্রোডিউসারের পকেটে টাকা ঢুকেছে তো? আর কী চাই? অভিনেতারা, ফিল্মের ক্রিউ মেম্বারেরা টাকা পেয়ে গিয়েছেন, ক্যামেরাম্যান, ডিরেক্টরেরা টাকা পেয়ে গিয়েছেন, প্রোডিউসারের পকেটে টাকা ঢুকেছে। কাজেই নেতাজিকে অপমান করা হল কি না, ক্ষুদিরাম বসুর হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে চড়ার পিছনের ইতিহাস বিকৃত হল কি না? ভগৎ সিংয়ের নাম এক বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল কি না তা নিয়ে কার মাথাব্যথা? আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের রাষ্ট্রপতি নিয়ে একটা কটু মন্তব্য করলে জেল হাজতে ঢুকবেন নিশ্চিত, কিন্তু সেই দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা লড়লেন, লাঠি খেলেন, গুলি খেলেন, বছরের পর বছর জেলে কাটালেন, পিছন ফিরেও দেখেননি তাঁদের পরিবারের কী হবে? তাঁর সন্তানের কী হবে? সেই মৃত্যুঞ্জয়ী আত্মত্যাগী মানুষদের যখন খুশি তখন অপমান করাই যায়, অর্থ উপার্জনের জন্য, এক নোংরা রাজনীতিকে তুলে ধরার জন্য। পরের পর এরকম সিনেমা আসছে, আসবেও। ইতিহাসের আদ্যশ্রাদ্ধ করে মানুষকে বোঝাবে কে সুভাষ বোস? কে ক্ষুদিরাম? কে ভগৎ সিং, আসল তো হল তাঁদের অনুপ্রেরণাদাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। যেসব ইতিহাস নাকি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, আজ তাই সামনে আসছে। দেশের বেশিরভাগ স্বাধীনতা সংগ্রামী তো ছিলেন ধান্দাবাজ, ক্ষমতালোভী। তাঁরা খুঁজে বার করেছেন এক স্বতন্ত্র বীরকে। যিনি একটু খুঁজলেই দেখা যাবে নিজেকে নিজেই বীর বলেছিলেন, বেনামে, চিত্রগুপ্ত নামে এক বই লিখে নিজের জীবনী ছাপিয়েছিলেন, যেখানে নিজেকেই বীর উপাধি দিয়েছিলেন। তো সেই ক্ষমাবীর সাভারকর নাকি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের অনুপ্রেরণা ছিলেন। 

লাইফ অফ ব্যারিস্টার সাভারকর নামে এক বই ছাপা হল ১৯২৬-এ লিখলেন কে? চিত্রগুপ্ত। সেই বই আবার রিপ্রিন্ট হল, মানে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হল কবে? ১৯৮৭তে, প্রকাশক রবীন্দ্র রামদাস দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় জানালেন, ওই চিত্রগুপ্ত আর কেউ নন, উনি ছিলেন স্বয়ং বিনায়ক দামোদর সাভারকার, উনি সেই বইয়ে নিজেই লিখছেন, “Savarkar is born hero, he could almost despise those who shirked duty for fear of consequences. If once he rightly or wrongly believed that a certain system of Government was iniquitous, he felt no scruples in devising means to eradicate the evil.” সাভারকর বর্ন হিরো, নায়ক হয়েই জন্মেছিলেন, যিনি কর্তব্যের সামনে ভয় বা পরিণামের কথা ভাবেননি। তিনি ঠিক বা ভুলভাবেও যদি সরকারের কোনও কাজকে, ব্যবস্থাকে অন্যায় বলে মনে করতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। বুঝুন, নিজেই লিখছেন, তিনি হিরো। গোটা পৃথিবীতে এর তুলনা একজনের সঙ্গেই করা যায়, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। এই তথাকথিত বীর সাভারকর আন্দামান জেলে ঢোকার একমাসের মধ্যে ক্ষমা প্রার্থনা জানিয়ে ইংরেজ সরকারকে চিঠি দিতে শুরু করেছিলেন, তিনি নিজেই মোট ৬ খানা চিঠি দিয়েছিলেন, তাঁর পরিবারের লোকজন ইত্যাদির ওই ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি ধরলে মোট ১৫টা চিঠি জমা পড়েছিল। এ তথ্য গতকালই জানিয়েছিলাম। আজ ওনার একটা চিঠির একটু অংশ আপনাদের শোনাই, “if the Government wants a further security from me then I and my brother are perfectly willing to give a pledge of not participating in politics for a definite and reasonable period that the Government would indicate… This or any pledge, e.g., of remaining in a particular province or reporting our movements to the police for a definite period after our release – any such reasonable conditions meant genuinely to ensure the safety of the State would be gladly accepted by me and my brother.” যদি সরকার আমাদের, মানে উনি এবং ওনার ভাইয়ের মুক্তি দেন, তার বদলে একটা নির্দিষ্ট সময়, যা ব্রিটিশরাই ঠিক করবে, ততদিন রাজনীতিই করবেন না। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মোদিজির গুরু সাভারকর দেশপ্রেমিক?     

নেতাজির প্রথম জেলযাত্রা ১৯২৫, তাঁকে মান্দালয় পাঠানো হল, ১৯২৭ এ ছাড়া হল। ততদিনে ওনার শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্ষয় রোগ, টিউবারকুলোসিস। তিনি মুক্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন? ১৯৩০-এ অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই আবার তাঁকে জেলে পাঠানো হল, সেখানে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদার দাবিতে বিক্ষোভের সামনে ছিলেন তিনি, পুলিশ সেই বিক্ষোভে লাঠি চালায়, তাঁর মাথা ফেটে রক্ত ঝরে, কিন্তু তাঁকে জেলেই রাখা হয়েছিল। তিনি মুক্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন? ১৯৪০ এ হলওয়েল মনুমেন্ট, ব্ল্যাক হোল ট্রাজেডির স্মারক, তাকে সরানোর বিরুদ্ধে মিছিলে নেতৃত্ব দেন, আবার তাঁকে জেলে পোরা হয়, জেলে শরীর খারাপ হলে তাঁর বাড়িতেই পুলিশ পাহারায় রেখে দেওয়া হয়। তিনি মুক্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন? না, উল্টে ১৯৪১-এর ১৬ জানুয়ারি ইংরেজদের নজর এড়িয়ে চলে যান কাবুল, সেখান থেকে মস্কো হয়ে বার্লিন। কে কার থেকে অনুপ্রেরণা নেবে? ১৯৪৪-১৯৪৫ সাভারকর হিন্দু যুবকদের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে বলছেন, বিভিন্ন জায়গায় রিক্রুটমেন্ট সেন্টার তৈরি হচ্ছে, নাথুরাম গডসের ভাই গোপাল গডসে ইংরেজ ফৌজে যোগ দিচ্ছ, ওনারই আনা সার্ভিস রিভলভার দিয়ে গান্ধী হত্যার চক্রান্তের শুরু। সাভারকর বলছেন, দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল দিয়ে শত্রু ঢুকতে পারে, বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী– হক সরকার ফরোয়ার্ড ব্লকের যাঁরা নেতাজির নির্দেশে গোপন কাজকর্ম করছেন, তাঁদের ধরিয়ে দিচ্ছে। সেই হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকর নেতাজির প্রেরণা? আইএনএ তৈরি হল, গান্ধী ব্রিগেড, জওহর ব্রিগেড, সুভাষ ব্রিগেডের সৈন্যরা, কী মুসলমান, কী খ্রিস্টান, কী হিন্দু এক জায়গায় বসে খাওয়া দাওয়া করছেন। আজাদ হিন্দের স্লোগান ইত্তেহাদ, ইতমদ, কুর্বানি। ঐক্য, আস্থা, ত্যাগ। হ্যাঁ, উর্দুতেই ছিল শব্দগুলো। সাভারকর লিখছেন উর্দু কখনই ভারতীয় ভাষাই নয়, তিনি ১৯২৩-এ ‘হিন্দুত্ব’ বই লিখছেন, হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা দিচ্ছেন, প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। তিনি ছিলেন নেতাজি সুভাষের প্রেরণা? গান্ধীজিকে ফাদার অফ দ্য নেশন কে বলেছিলেন? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর সৈন্যবাহিনীর প্রথম ব্রিগেডের নাম গান্ধী ব্রিগেড। 

আর বিনায়ক দামোদর সাভারকর চিরটাকাল গান্ধীর তীব্র বিরোধীই কেবল নয়, তিনি ছিলেন গান্ধীহত্যা ষড়যন্ত্রের মাথা। প্রমাণের অভাবে তিনি ছাড়া পেয়েছেন বটে কিন্তু কাপুর কমিশন তৈরি হল ১৯৬৬তে, গান্ধী হত্যার পরে যে তথ্য বিচারকদের সামনে আসেনি, সেসব তথ্য আনা হল এই কমিশনে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হল, “All these facts taken together were destructive of any theory other than the conspiracy to murder by Savarkar and his group.” এইসমস্ত নতুন পাওয়া তথ্য অন্য সব সম্ভাবনাকে বাতিল করে পরিষ্কার জানায় যে গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল সাভারকার এবং তাঁর গোষ্ঠী। সেই গান্ধী হত্যাকারীদের নেতা ছিলেন সুভাষ বসুর প্রেরণা? কী তথ্য এসেছিল কাপুর কমিশনের সামনে? স্বাধীনতার ক’দিন আগেই ৮ আগস্ট ১৯৪৭, এডিএন–৪৩৮ বম্বে–দিল্লি ফ্লাইটে তিন যাত্রী যাচ্ছেন, টিকিট নম্বর বিডিবি ৩৭৫০৯, বিডিবি ৩৪৮৯০, বিডিবি ৩৭৫১০। ১১ আগস্ট এই তীন যাত্রীই একই প্লেনে চেপে ফিরে আসেন বম্বেতে, এখনকার মুম্বইতে। সেই তিনজন যাত্রী হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে। দুজন গান্ধীহত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলেছে, অন্যজন প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়েছে। আজকের দিনে এই প্রমাণ থাকলে এই বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে ফাঁসিতে চড়ানো হত বা আজীবন জেলেই রেখে দেওয়া হত। সেই সাভারকর নেতাজির অনুপ্রেরণা? ২০ জানুয়ারি বিড়লা হাউসে সান্ধ্য প্রার্থনায় সবে বসেছেন গান্ধীজি, একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল, গ্রেফতার হলেন মদনলাল পাওয়াহা। তাঁর কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেল তা একটু ছানবিন করলেই বেরিয়ে আসত নাথুরাম বা নারায়ণ আপ্তের নাম। করা হল না। সেদিন এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরে দিল্লি থেকে পালিয়েছিলেন নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে। পালিয়ে গেলেন কোথায়? গিয়েছিলেন সাভারকরের বাড়িতে, সাভারকরের দেহরক্ষী এবং মারাঠা ছবির এক অভিনেত্রী এই তথ্যের সমর্থনে সাক্ষী দেন। আরও ভালো অস্ত্র চাই, সম্ভবত এসব নিয়েই আলোচনার পরে গডসে আপ্তে গেলেন গোয়ালিয়রে, সাভারকরের পরিচিত এক হোমিওপাথি ডাক্তার দত্তাত্রেয় পরচুরের কাছ থেকে ওই ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল জোগাড় করেন। এরপর দুজনে দিল্লি যান, এবার গান্ধীহত্যা নিজের হাতেই করবেন গডসে, করেনও। নারায়ণ আপ্তে পালিয়ে যান, ধরা পড়েন বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মুম্বইয়ের চার্চগেট স্টেশনে, যার নাম শিন্ডে-বিজেপি সরকার পাল্টে দিয়েছে, নতুন নাম সাভারকর স্টেশন। এবং আরও মজার তথ্য হল, গান্ধীহত্যার কদিন পরেই সাভারকরকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের সময় গডসে, আপ্তে, পরচুরে, কারকারে মদনলাল পাওয়াহা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেন, হাসিঠাট্টাও করতেন, কিন্তু সাভারকর এক কোণে বসে থাকতেন চুপ করে, যেন তিনি এঁদের চেনেন না। কারণ তিনি ততদিনে দেশের সরকারের কাছে এক মাফিনামা, ক্ষমাযাচিকা পাঠিয়ে বলেছেন, তাঁকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি আর কোনওদিনও রাজনীতিই করবেন না। সেই ক্ষমাবীর কাপুরুষ সাভারকর সুভাষচন্দ্র বসুর প্রেরণা, শুনলে বমি পাচ্ছে না?

RELATED ARTICLES

Most Popular