কলকাতা: লখনউ (LSG) ম্যাচের শেষ বল হওয়ার পর ভাবছিলাম, পি.কে ব্যানার্জি কেকেআর কোচ হলে মাঝরাতের ইডেন ড্রেসিংরুমে (Eden Dressing Room) কী জাতীয় অগ্নুৎপাত ঘটতে পারত?
ভেঙ্কি মাইসোর বকলমে টিমের কোচ, মেন্টর, প্রধান কর্তা। নিঃসন্দেহ থাকতে পারেন তিনিই পিকে। তিনিই ধীরেন দে। শুনলাম ১ রানে হারার পর ড্রেসিংরুমে ভেঙ্কি টিমকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “মন খারাপ করার কিছু হয়নি। তোমরা দারুণ খেলেছ। আজ তো জিততেই পারতে। সঙ্গে আর একটা ম্যাচ জিতলে তোমরা প্লে অফে চলে যেতে।” সারমর্ম — চিন আপ। দুঃখে ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি।
শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। অনেক সময় টিমের মনোবল ঠিক রাখার জন্য চড়িয়ে বলতে হয়। টুর্নামেন্ট চলাকালীন প্লেয়ারকে জেনেশুনেও গোঁজামিল দিতে হয়। যাতে সার্বিক ছন্দ নষ্ট না হয়ে যায়। মরশুম শেষে তো সেসবের কোনও কারণ নেই। তাছাড়া আইপিএল প্লেঅফে যেতে না পারাটা প্লেয়ারের ঘাড়ের ওপর জীবন ভেঙ্গে পড়ার মতো ব্যাপার তো নিশ্চয়ই। শুভমন গিল উইনিং স্ট্রোক মারার পরমুহূর্তে ষ্টার স্পোর্টস ক্যামেরা বিরাট কোহলিকে ধরেছিল। কেউ লক্ষ্য করেছেন সেই মুখচোখ? হাতে গ্লাভস বা একটা কিছু ছিল। বছরের পর বছর এতো যুদ্ধের বিজয়ী নায়ক সেটা বেদনায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আরসিবি সমর্থকের এত হতাশার মধ্যেও কী অসীম তৃপ্তির দৃশ্য যে আমার নায়ক আমার চেয়েও আহত।
আর তাই তো হওয়ার কথা। যে কোনও পারফরমারের যদি মর্যাদাবোধ থেকে থাকে গভীর অপমান আর অসম্মানে সুচ ফুটিয়ে ব্লাড নেওয়ার দরকার পড়ে না। তার রক্ত এমনিই ছলকে বাইরে বেরিয়ে আসবে।
আর ইনি কেকেআর-এর কর্ণধার কিনা স্তোক দিচ্ছেন যে তোমরা ভালো খেলেছ! একটু হলে প্লে অফ হয়ে যেত! নাকি ঘুরিয়ে নিজেকে আশ্বস্ত করছেন যে তুমি সিইও ভালো কাজ করেছো? মালিকদের এইভাবে বুঝিয়ে বলারই কি ছক? অথচ সর্বৈব মিথ্যে। ইডেনে লখনউ এবং আরও একটা ম্যাচ জিতলেও কেকেআর-এর প্লে অফে যাওযার গ্যারান্টি ছিল না। পরের দিন তো দেখাই গেল যে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সও ১৬ পয়েন্টে বসে। কেকেআরের সঙ্গে পয়েন্ট এক হলে তখন চুলচেরা বিচার হত নেট রান রেটের। তাছাড়া কোথায় নিশ্চয়তা ছিল দু’ম্যাচ জেতার? মুখে ম্যাচ জেতার কথা বলা আর আগেকার মতো বুক ক্রিকেটে রাজা উজির মারা একই।
সুনীল নারিন। টুর্নামেন্টে চূড়ান্ত ব্যর্থ কেকেআরের প্রাক্তন সুপারস্টার। ১৪ ম্যাচে ১১ উইকেট আর মাত্র ২১ রান। চন্দ্রশেখরের ব্যাটিং মনে করিয়ে দেয়। এবারের আইপিএল তো কোনও ভিন্টেজ গাড়ির প্রদর্শনী হচ্ছিল না যে পুরনো গৌরবজনক সময়কে গার্ড অফ অনার দেওয়া হচ্ছে। আইপিএলে একটা রাক্ষুসে গতিশীল পৃথিবী। সেখানে সুনীল নারিন এখন কোথায়? অথচ টুর্নামেন্টের পর কেকেআর অফিসিয়াল পেজে পোস্ট করা হয়েছে যে শেষ ম্যাচে ২ উইকেটের মতো এমন পারফরম্যান্স দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারছি না। বাংলা কথা, আগামী বছরও নারিন আপনাকে মাঠে দেখার জন্য আমাদের তর সইছে না। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট যতদূর দেখেছি, ক্ষতবিক্ষত মরসুম শেষে এমন পোস্ট সর্বোচ্চ কর্তার সম্মতি ছাড়া হতেই পারে না। প্রশ্ন হল, কাকে বার্তা দেওয়া হল? কোচকে নয় তো? যে আপনি যা-ই মনে করুন, সুনীলকে পরের বছর খেলাতে হবে।
মাঠের কেকেআর স্ট্র্যাটেজি তো টুর্নামেন্ট জুড়ে ধারাবাহিক দুর্বোধ্য। ‘দাদাগিরি’-র গুগলি রাউন্ডের যদি বা জবাব পাবেন, কেকেআরের এগারো ঠিকঠাক আন্দাজ রাজ্য লটারিতে জয়ী হওয়ার চেয়েও কঠিন। শেষ ম্যাচের প্রথম বল যখন হচ্ছে নীতিশ রানার ফিল্ড প্লেসিং দেখে অবাক লাগল। কিপার দাঁড়িয়েছে উইকেটের গজ কুড়ি পেছনে। স্লিপ রয়েছে তেরছা করে প্রায় অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাই স্লিপের মতো। তার মানে নিশ্চয়ই বল আজ দ্রুতগামী হবে। লাফাবে। নইলে কিপার এত পেছনে কেন? কিন্তু কেকেআর যদি ইডেন পিচ তেমনই পড়ে থাকে, তাহলে টিমে একজনও বিদেশী পেসার নেই কেন? কেন তার অধিনায়ক লকি ফার্গুসন আর টিম সাউদিকে রিজার্ভে বসিয়ে রেখেছে? কোনও উত্তর নেই। কিছু পরে লখনউ টপ অর্ডারে ধস নামলো। এইসময় আক্রমণে-আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়ার কথা। নিশ্চয়ই বরুণ এবার আসবেন। সবাইকে অবাক করে এলেন ক্যাপ্টেন নিজে। আসা মাত্র দুটো শর্ট পিচ। ওভারে রান উঠলো মাত্র ৩। কিন্তু চাপ তৈরির ব্যাপারটা এক লহমায় চলে গেল। এটা তো চেঞ্জ বোলারের সময়ই ছিল না।
কেউ কি ময়নাতদন্তে বসে দেখেছে যে ২০১৮-২৩ এই সময়ের মধ্যে টিমটা প্লে অফ গ্যাছে মাত্র একবার? মাত্র একবার ছয় বছরে। চূড়ান্ত ব্যর্থতা শুধু নয়। এক হিসেবে বাংলার মতো এমন আদর্শ সমর্থককূলকে তো ধোঁকাও দেওয়া। কেকেআর কোনও বহুতল নয় যে ইট-চুন-বালি-সিমেন্ট-লোহা মিশিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তৈরি হয়েছে। কেকেআর বলতে পৃথিবীজোড়া যে ইমেজারি তা শাহরুখ খানের নাম, শহরের ঐতিহ্য আর সমর্থকদের দুর্নিবার প্যাশন — এই অজেয় ত্রিভুজের ওপর তৈরি।
প্রথম বছরেই এসআরকে বলেছিলেন তাঁর সংকল্পের কথা যে তিনি নিছক একটা সফল ক্রিকেট টিম গড়তে আসেননি। তাঁর লক্ষ্য এই টিম দিয়ে ম্যান ইউ-য়ের এর মতো ব্র্যান্ড তৈরি। বছরখানেকের মধ্যে কেকেআর বিদেশে ডানা মেলা শুরুও করল। ত্রিনিদাদ। আবুধাবি। দু’দেশেই আজ নাইট রাইডার্স স্বমহিমায় হাজির। জুলাই-তে শুরু হবে লস আঞ্জেলিস অভিযান। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওড়ার কমন রানওয়ে কিন্তু কলকাতা। অরিজিনাল ব্র্যান্ড এবং টাকা সংস্থান দুটোরই। সেই জায়গাটা কী করে এমন তাচ্ছিল্য ভরা ট্রিটমেন্ট দাবি করতে পারে ?
বাংলার প্লেয়ার নেওয়ার ব্যাপারে কী অসহ্য একগুঁয়েমি। রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন কোচ নেব কিন্তু তিনবছরে দু’বারের ফাইনালিস্ট টিম থেকে কোনও প্লেয়ার নয়। নেট বোলার যে ক’জনকে এনেছে তারা বাংলার বাইরের। তারাও পাঁচ তারায় খেলদেল। ঘুরলো। তাহলে কি বিশ্বাস করতে হবে বাংলা এমন ক্রিকেটপোড়া রাজ্য যে তার নেট বোলারও নেই? কিছুতেই তারা নিলামে কোনও বড় মুখ নেবে না। সুপারস্টারদের জন্য ছুটবে না। কোনওদিন দেখেছেন কেকেআর যুবরাজের পেছনে ছুটেছে ? কী বেন স্টোকসকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে? অশ্বিন ফ্রি জেনেও বিড করছে? বা কেএল রাহুলকে চাইছে? কখনও না। শুভমন গিল একটু থিতু হচ্ছেন। ভারতীয় দলে কড়া নাড়ছেন। তাঁকে নিয়ে কথা হচ্ছে। কেকেআর বোধহয় ঘাবড়ে গেল যে আরে এ তো ষ্টার হয়ে যাচ্ছে। তাঁকে রিটেন করল না। শার্দুলকে কিনল সাত কোটি টাকা দিয়ে। কিন্তু বাটলার কী রাবাডার জন্য গেল না। কী আশ্চর্য বৈপরীত্য। টিমটার মালিক এক মহাতারকা। অথচ তারাই কিনছে কম খ্যাতদের। যেন ওটিটি সিরিজ বানাবে ভাবছে যে ষ্টার চাই না। অভিনেতাতে মেরে দেব তারকাকে।
অভিষেক নায়ার নামক মুম্বইয়ের এক ক্রিকেট মুখ এখন কেকেআরে প্রচন্ড গুরুত্ব পান। দীনেশ কার্তিকের সময় থেকে অভিষেক গুরুত্ব পেতে শুরু করেছেন এবং আপাতত আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত প্রথম বছরে কী করবেন? আগাছার জামায়েত এবং নিজের অসহায়তা বুঝতে বুঝতেই তো তাঁর গোটা সিজন চলে গেল। এসব দেখতে দেখতে মনে হয় কোনটা স্বপ্ন? আগে যা দেখেছিলাম সেই ফ্রেমগুলো? নাকি ইদানিং যা কেকেআর দেখি?
এখানে মানতে হবে যে ভেঙ্কি যখন প্রথম ২০১২-তে সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেন, তাঁর পারফর্মেন্স গৌতম গম্ভীরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ২০১২-১৪ টিমটার বেস্ট সময়। যখন তারা দুবার খেতাব জেতে। কিন্তু গম্ভীর বিদায়ের পর থেকেই ভেঙ্কি হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। তখন থেকেই ফ্রেঞ্চাইজ তারকাবিহীন। বাংলার ক্রিকেটার বিহীন। আর তাতে কারণ কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই.কারণ অর্থনৈতিকভাবে মডেল তো দাঁড়িয়ে গিয়েছে। যে শাহরুখ যেটা ছাড়া জীবনে কিছু বোঝেন না। যিনি আমায় ইন্টারভিউতে বলেছিলেন রুপো জেতা মানে সোনাটা তুমি হারিয়ে এসেছ। তিনি হঠাৎ করে যেন বাকিদের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে ক্রিকেট সংসারের দূরে চলে গেলেন। আর সেটায় নো নেটওয়ার্ক হয়ে গেল টিমের অভ্যন্তরীণ সিস্টেম। ভাবলে উত্তেজিত তো লাগেই। তার চেয়ে বেশি বিস্মিত এবং ব্যথিত।
কেকেআরের জন্মলগ্ন থেকে সাংবাদিক হিসেবে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয়েছে। কর্মজীবনে আমার প্রথম মিডিয়া হাউস ছিল কেকেআরের মিডিয়া পার্টনার। আর আমি তাদের ক্রিকেট প্রতিনিধি। তাই অনেক কিছু ক্লোজ রেঞ্জে দেখার সুযোগ ছিল। করবো লড়বো জিতবো-রে গানটা বাজারে আসার আগে শাহরুখ আরবসাগর ছুঁই ছুঁই তাঁর ম্যানসনে বসে শুনিয়েছিলেন। প্রথম শুনে যে দারুণ লেগেছিল এমন নয়। মুখে কিছু বলিনি।
যেমন ‘করবো ‘কথাটা। করবো বলতে কী বলা হচ্ছে পরিষ্কার নয়। আশঙ্কা হয়েছিল বাঙ্গালিয়ানার সঙ্গে যাবে তো? কিন্তু গানটা যে-ই মাঠে হাজার হাজার সমর্থকের উত্তেজনার মধ্যে বাজা শুরু হল, একটা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। এড্রেনালিনকে যেন অন্য পর্যায়ে তুলে নিয়ে গেল। এমন পর্যায়ে উন্নীত ছিল কেকেআর আবেগ যে সময় সময় মনে হত ইন্ডিয়ান টিমের জনপ্রিয়তার সমান্তরালভাবে কীভাবে এই পর্যায়ে উঠে গেল?
আজ মোহনবাগান জার্সি পরে মাঠে ঢোকা নিয়ে এমবুশ মার্কেটিং জাতীয় অভিযোগ তুলছে কেকেআর। সত্যি যদি টিমের ফ্যান থাকে তাহলে জার্সিতে কী বিভক্ত করা যায়? গেলে কতটা যায়? সৌরভ যখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা নিয়ে ২০১২- তে পুনের হয়ে খেলতে এলেন, ইডেন তখন বিভক্ত হয়ে গেছিল ৫০-৫০। আজকের কেকেআর হলে বোধহয় ৯০-১০ হয়ে যেত। কেকেআর মহাকর্তা বুঝতে পারছেন না শরীর যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন যে কোনও সংক্রমণই কাবু করে। সে ধোনি হোক। কী কোহলি। কী লখনউ।
রিঙ্কু সিংহের প্রাণপণ লড়াই দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল তিনি তো কেকেআরের সোনার সময় দেখলেনই না। যখন সত্যি ঝলমল করত কেকেআরের কেল্লা।
রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী ‘মনে পড়ে।
ভূমির পরে জানু পাতি
তুলি ধনুশ্বর
একা কুম্ভ রক্ষা করে
নকল বুঁদিগড়।
রানার সেনা ঘিরি তারে
মুন্ড কাটে তরবারে।
আজকের কেকেআর সাবেকি ঝলমলে কেল্লা কোথায়? এ তো নকল বুঁদির গড়। কুম্ভর জায়গায় শুধু রিঙ্কুকে বসিয়ে নিন।