শুভেন্দু ঘোষ, কলকাতা: পুরস্কারের মোরগ লড়াই শেষ। শেষ বাঙালির সারা বছরের বাঁচার আনন্দের রসদ। বৃষ্টির (Rain Forecast) লালচোখকে অগ্রাহ্য করে ফের কল্লোলের কোলাহলে মেতে উঠল কলকাতা। আজ যে পুজো (Durga Puja 2023) শেষ। নবরাত্রিও উতরে গিয়েছে। তাহলে আর বাঙালিকে ঘরে কে বেঁধে রাখতে পারে? শ্রীভূমি থেকে একডালিয়া, কলেজ স্কোয়ার থেকে বাবুবাগান, কোথাও তিলধারণের জায়গা নেই। কাল যে উমা চলে যাবেন। তাই আলোর রোশনাইয়ে আজ রাতে লেগেছে নববধূর গালের রং। একদিকে খুশি, অন্যদিকে বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা।
শুধু শহর নয়, শহরতলি থেকে গ্রামের মণ্ডপেও আজ যেন ভিড়ের কলস ফেটে পড়ল। কোথাও মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। রাত যত বাড়ছে, ভিড়ের ঘনত্ব ততই ঘনতর হচ্ছে। শরীরে একরাশ ক্লান্তি, চোখে ঘুম জড়িয়ে ধরছে, পা ভারী হয়ে আসছে, তাও সুরুচি কিংবা চেতলা অগ্রণীতে মধ্যরাতেও দেখা গেল লাখো জনতার লাইনে দাঁড়ানোর অসীম ধৈর্য। পৃথিবীর আর কোনও উৎসবে এমন উন্মাদনা হয় কিনা জানা নেই।
মা মেনকার আর্তি সত্ত্বেও কালের নিয়মে হিমালয়-সুতাকে যে কাল কৈলাসে ফিরতেই হবে। তাই নবমীর দিনটা বাঙালির বিষাদের দিন। বুকের ভিতর কেমন যেন আনমনেই বেজে ওঠে বিজয়ার সুর। সকাল থেকেই মহানগরে যেন ভাঙা মেলার ছন্দ। অষ্টমীর হোল নাইটের ক্লান্তি জড়ানো চোখেমুখে তাও সাতসকালে মাংসের দোকানে পড়ল লম্বা লাইন। সকালে রাস্তায় বেরিয়ে দেখা গেল, কোথাও তেমন আর যুদ্ধং দেহি উত্তেজনা নেই। ঠাকুর দেখা প্রায় শেষ। তাও নবমী মানে নবরাত্রির শেষ। তাই এইদিনে ভিড় আর শিকল দিয়ে আটকে রাখা যায় না। সারারাত ভূতের মতো খেটে যাওয়া খাবারের স্টল ও রেস্তরাঁগুলিতেও মাছি ভনভন করছে। কেউ কোত্থাও নেই। গুটিকয়েক বড় প্যান্ডেলে ফাঁকায় ফাঁকায় ঠাকুর দেখবেন বলে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করলেন। দুপুরে বৃষ্টির সঙ্গে ইমনকল্যাণ রাগের মতো কচি পাঁঠার ট্যালটেলে ঝোলের সঙ্গে চাড্ডি ভাত মেরেই সামান্য দিবানিদ্রা দিয়েই মাঠে নামার পালা। টেনিস বলের মতো এ প্যান্ডেল থেকে ও প্যান্ডেলে লাফিয়ে বেড়ানো।
আরও পড়ুন: পুজো কার্নিভালে মিলবে বাড়তি মেট্রো পরিষেবা, জানুন সময়সূচি
যে প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল মহালয়ার ভোরে, আজ রাতের তারাদের সঙ্গে সেই দীপ নিভে আসার পালা। দর্পণে ফুটে উঠবে মায়ের মুখচ্ছবি। তাই আজ রাতে সকলের বুকের ভিতরে যেন বাজছে শাক্তকবির সেই সুর— ‘ওরে নবমীর রাত্রি না হইওরে অবসান।’ বিজয়া দশমীর বিষাদধ্বনি বেজে ওঠার আগেই তাই কবির একান্ত আকুতি গোটা বঙ্গদেশের হৃদয়ে বেজে ওঠে,
‘যেও না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!
…নয়নের মণি মোর, নয়ন হারাবে!’
তাই নবমী হল আনন্দ ও বিষাদের এক ভরা সন্ধিক্ষণ। কাল সকালেই নীলকণ্ঠ পাখি রওনা দেবে কৈলাসের উদ্দেশে। হরের ঘরণী ফিরবেন স্বামীর ঘরে। মা উমার বিজয়ার নিরঞ্জনে বাংলার ঘরে ঘরে এক এক করে নিভে যাবে দেউটি। নবমীর দিনে তাই বাঙালি কেন, দেবীরূপী প্রতিমার চোখও যেন ছলছলিয়ে ওঠে। এই এত আলো, এত উচ্ছ্বাস, এত সুর, এত আনন্দের পরিপূর্ণ কলস আজ নড়ে উঠবে। দর্পণে ফুটে উঠবে মাতৃমুখ। সন্ধ্যারতির ঢাকও বুজে ওঠা গলায় অবিরাম বলে চলেছে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। কপালে ঠেকানো কোটি কোটি হাতের একটাই আর্তি ‘আবার এসো মা।’
আরও অন্য খবর দেখুন