চাঁচোল: বাংলায় দুর্গাপুজো (Durga Puja 2023) যে নির্দিষ্ট কোনও সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, আপামর বাঙালি তথা বাংলার বাসিন্দাদের উৎসব, তা নানাসময়েই বলা হয়ে থাকে। চাঁচলের রাজবাড়ির পুজোয় সেটা দেখা যায়। ৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই রাজবাড়ির পুজো। এখানে নেই কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ, নেই কোনও বৈরিতা। বিসর্জনের সময় মহানন্দার সতীঘাটেঘাটে ভিড় করেন লাগোয়া গ্রামগুলির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। মশাল, লণ্ঠন বা প্রদীপ, আধুনিক কালে তাঁর সঙ্গে জুড়েছে টর্চও। এই সব দিয়ে গোটা বিসর্জনের সময় দেবীকে আলো দেখান তাঁরা। এটাই এখানকার প্রথা।
সতেরো শতকের শেষভাগ। সেই সময় উত্তর মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র রায়চৌধুরি। শুধু বাংলা নয়, বিহারের কিছু অংশও তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কিন্তু প্রজাদরদী এবং ধর্মপ্রাণ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব ভারত জুড়ে। কথিত আছে, একবার রাজা স্বপ্নাদেশ পান দেবী চণ্ডীর। সেই স্বপ্নাদেশে মহানন্দার ঘাটে স্নান করতে যান তিনি। সেই সময় তাঁর হাতে চতুর্ভুজা অষ্টধাতুনির্মিত মূর্তি উঠে আসে। দেবী চণ্ডীর অষ্টধাতুর মূর্তি সতীঘাটা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে রাজবাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন চাঁচলের রাজা রামচন্দ্র। সেদিন থেকেই রাজবাড়িতে শুরু হয় দেবীর নিত্যপুজো। তবে প্রথমে মহানন্দানদীর পাড়ে মাটির ঘর ও খড়ের ছাউনি দিয়ে মন্দির তৈরি করে পুজো শুরু করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে তা পরিবর্তন হয়েছে।
আরও পড়ুন: ইছামতীতে নির্বিঘ্নে শেষ হল দুই বাংলার বিসর্জন
পরবর্তীতে এই বংশের অন্যতম রাজা শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরির নির্দেশে তৎকালীন ম্যানেজার সতীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে সেখানে পাকা দুর্গাদালান নির্মিত হয়। ততদিনে জায়গাটির নাম পরিবর্তিত হয়ে পাহাড়পুর হয়েছে। প্রতিবছর এখানেই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। পাকা মন্দির নির্মাণের পর রাজা শরৎচন্দ্র দুর্গাপুজোর জন্য সেই সময় সাত হাজার টাকা বছরে বরাদ্দ করেন। প্রাচীন প্রথা মেনে এখনও সেখানে সপ্তমী তিথিতে রাজবাড়ি থেকে দুর্গাদালানে নিয়ে আসা হয় অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা মা চণ্ডীকে। দশমীতে তিনি ফের রাজবাড়িতে ফিরে যান। ১৭ দিন ধরে চলে এই পুজো। সময় বয়ে গিয়েছে অনেকটাই। এখন সেই রাজাও নেই, রাজ্যপাটও নেই। তবুও প্রথা মেনে পুজো হয় প্রতিবছর। একসময় যা রাজার পুজো ছিল। এখন তা হয়ে উঠেছে স্থানীয়দের পুজো। চাঁচল রাজবাড়িতে এখন স্থাপিত হয়েছে কলেজ, মহকুমা প্রশাসনিক ভবন, আদালত-সহ একাধিক সরকারি দফতর। তবে রাজবাড়ির একাংশে থাকা ঠাকুরবাড়ি এখনও আগের মতোই রয়ে গিয়েছে।
কথিত আছে, একসময় সতীঘাটায়, মহানন্দার পশ্চিম পাড়ে মহামারী দেখা দিয়েছিল। তখন দেবী সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, গোধূলিলগ্নে বিসর্জনের সময় তাঁরা যেন মাকে আলো হাতে পথ দেখান। মাকে আলো দেখানোর পর থেকেই মহামারী দূর হয়। তখন থেকে প্রতিবছরই বিসর্জনের সময় সেখানকার অর্থাৎ মহানন্দার নদীর ওপারে সাহুর্গাছি এলাকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ লণ্ঠন নিয়ে পথ দেখান মাকে। সেই রীতি এখনও প্রচলিত।
রাজবাড়ির ঠাকুরবাড়ির নিত্যপূজারী বলেন, প্রতি বছর সপ্তমীতে মাকে পাহাড়পুর দুর্গাদালানে চারদিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। একই ভাবে দশমীতে ফের মাকে ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। চাঁচল রাজবাড়ির দেবীদুর্গা দশভুজা নন, চতুর্ভুজা। একসময় দেবী দুর্গাকে হাতি-ঘোড়ার শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হত। মাথায় থাকত চাঁদির ছাতা। দুটি চাঁদির পাখা দিয়ে হাওয়া করা হত। এখন হাতি-ঘোড়ার শোভাযাত্রা নেই। পায়ে হেঁটে সেই যুগের চাঁদির ছাতা ও পাখা ব্যবহার করা হয় শোভাযাত্রার সময়। সিঁদুর খেলায় মাতেন মহিলারা। ঢাকির বাজনার তালে মাকে শেষ বিদায়ের আনন্দের মুহূর্ত উপভোগ করেন যুবক যুবতীরা।
দেখুন আরও অন্য খবর: