টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন ইলেকশন মোডে থাকা আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন যাবতীয় ঘোমটা, আড়াল ইত্যাদি ছেড়ে পুরোদস্তুর প্রচারে নেমে পড়েছেন, নির্বাচন ২০২৪, টার্গেট ৩৭০। সে তিনি মুখে যাই বলুন না কেন, আসলে যথেষ্ট টেনশনে আছেন, যত রকম নৌটঙ্কি করা সম্ভব, যত রকমের প্রচার কৌশল নেওয়া সম্ভব সবক’টা নিয়েই মাঠে নেমেছেন। হিমালয়ে গুহাতে ধ্যান করেছেন, বেনারসের গঙ্গায় ডুবকি দিয়েছেন, পুরোদস্তুর সেনা পোশাকে লাদাখে গেছেন, এয়ার ফোর্সের পোশাক পরে রাফালে চড়েছেন, অবশ্য হাত নেড়েছিলেন কার দিকে, সেটা জানা নেই। কাউবয় হ্যাট পরে জঙ্গল সাফারিতে গেছেন, দাড়ি রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ লুক আনার জন্য, নেতাজি হওয়ার জন্য সেই ব্যাঁকা টুপি পরেছেন। সর্বশেষ নৌটঙ্কি হল সমুদ্রের তলায় ময়ূরপুচ্ছ নিয়ে পুজো অর্চনা করা। সেই সাগরতলে কালনাগিনী, মহাকাশে কালনাগিনী, মরুভূমিতে কালনাগিনী, স্বপন কুমারের ডিটেকটিভ বইয়ের মতো। অনেকেই বয়সের কারণে শান্তিগোপালকে দেখেননি, কেবল শুনেছেন, এখন সে অভাব মিটেছে, দিনে তিন চারবার পোশাক পাল্টানো এক অনন্য শান্তিগোপালকে আমাদের দেশের মানুষ রোজ দেখে। তো সেই তাঁর নজর ২০২৪-এর আগে যে বাংলার দিকে থাকবে তা তো জানা কথা। আপাতত বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, এই বাংলায় বিজেপি গতবারের ১৮টা আসনের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে, এদিকে অন্য বেশ কিছু জায়গাতে আসন কমছে, তাহলে বাড়বে কোথায়? তাই বেশ কিছু রাজ্যকে টার্গেট করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলা আছে। লিখে রাখুন বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের এই রাজ্যে ভোট হওয়ার আগে উনি কমসম করে ১৫-১৬ বার আসবেন, এবং এটাও লিখে রাখুন উনি যতবার এই রাজ্যে আসবেন, ততগুলো আসনও বিজেপি পাবে না। উনি বিভিন্ন অঞ্চলে যাবেন, বহু নৌটঙ্কি আমরা দেখব, তার প্রথম এপিসোড আমরা দেখলাম। তিনি আরামবাগ, কৃষ্ণনগর গেলেন।
অনেক কিছু বলেছেন, তার মধ্যে একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তিনি বলেছেন আজকের বাংলার এই অবস্থা দেখে রামমোহন কাঁদছেন, মানে পরপারে বসে রামমোহনের আত্মা আজকের বাংলার অবস্থা দেখে কাঁদছেন। এমনিতে বহু মানুষ বলেন নরেন্দ্র মোদি এক্সটেম্পোর বক্তৃতা দেন, মানে এক সুবক্তা যা মাথায় আসে সেটাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে গুছিয়ে বলতে পারেন। বাস্তব ঘটনা হল, একেবারেই না। ওঁর এক টিম আছে যারা ওঁকে বিভিন্ন তথ্য আর প্রয়োজনীয় প্রেক্ষিতগুলো জুগিয়ে দেয়, উনি তা নিজের মতো করে বলেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বক্তৃতার বড় অংশই লেখা থাকে, উনি টেলিপ্রম্পটার দেখেই বলেন, টেলিপ্রম্পটার আটকে গেলে কী হয়, তাও আমরা দেখেছি, তিনি শব্দও খুঁজে পান না। কাজেই মোদিজি ওরেটর, সুবক্তা কেন এক সুবক্তার ধারে কাছেও যাওয়ার যোগ্যতা ওঁর নেই। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল ওঁর নিজস্ব জ্ঞানভাণ্ডারের সীমাবদ্ধতা এবং এক অর্ধশিক্ষিতের আস্ফালন। যে কারণে বারবার মিথ্যে বলেছেন, ভুল ভাল কথা বলেছেন, অযৌক্তিক কথা বলেছেন, অনেক কিছু জানেন, তা দেখাতে গিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে এক কথায় ধেড়িয়েছেন। আমাদের মনে আছে চোলাই চোলাই বাজবে জোয়ের ভেড়ির কথা। সেই তিনি বাংলাতে এলেন, বাংলার কথা বলতে গিয়ে রামমোহন প্রসঙ্গে গেলেন এবং জানালেন বাংলায় নারীত্বের এই অপমান দেখে পরপারে রামমোহন রায় কাঁদছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পশ্চিমবাংলার সরকার পড়ে যেতে পারে?
তিনি বেশ বুঝেছেন এই বাংলাতে ওই রাম দিয়ে চিঁড়ে ভিজছে না, তাই রামমোহনে গেলেন। সমস্যা হল উনি মনে করছেন রামমোহন পরপার থেকে কেবল বাংলাই দেখতে পাচ্ছেন। সারা দেশের ছবি ওই মানুষটি দেখতে পাচ্ছেন না বা দেখে কী করছেন সেটা আমাদের মোদিজি জানেন না। হ্যাঁ, রামমোহন বাংলা রেনেসাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ, হ্যাঁ তিনি এই বাংলায় সতীদাহ প্রথা বাতিলের জন্য লড়েছিলেন, একধারে হিন্দুশাস্ত্রে সনাতনীদের সমস্ত দাবি নাকচ করে তিনি দেখিয়েছিলেন ওই সনাতনপন্থীরা আসলে মূর্খ, আসলে এই সতীদাহ প্রথার পিছনে আছে ওই ব্রাহ্মণ সনাতনীদের নিজস্ব ধান্দাবাজি। একধারে বেদ শাস্ত্র উপনিষদ থেকে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছিলেন, অন্যদিকে ব্রিটিশদের কাছে আইনত এই সতীদাহকে বন্ধ করার আবেদনও করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন দিল্লির মুঘল বাদশাহ আকবর শাহ দ্বিতীয়র আইনি পরামর্শদাতা, তিনি বিদেশে গিয়েছিলেন ওই সম্রাটের ভাতা বৃদ্ধির দাবি নিয়ে, এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে বিরাট টাকা আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে তার এক অংশ আমাদের দেশের মানুষের জন্য খরচ করা হোক এই দাবি নিয়ে সম্রাট আকবর শাহ দ্বিতীয়র দূত হয়ে তিনি ব্রিটেনে গিয়েছিলেন। তাহলে আদতে কী দাঁড়াল? রামমোহন রায় আমাদের দেশের মুঘল বাদশাহের দূত ছিলেন, দুই, তিনি সনাতন প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তিনি ব্রিটিশদের কাছে দেশের মানুষের জন্য বেশ কিছু দাবি রেখেছিলেন। এদিকে নরেন্দ্র মোদি, তাঁর সাধের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সনাতন হিন্দু ধর্মের কথা বলে, বিজেপি আজ সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা এবং এই আরএসএস এবং বিজেপি মঘল শাসনকালকে বিদেশি শাসন হিসেবেই গণ্য করে। তারা দেশসুদ্ধু বিভিন্ন জায়গাতে মুঘল সম্রাটদের নাম ইত্যাদি মুছে দিয়ে এক অন্য ইতিহাস খাড়া করতে চায়। কিন্তু ওই যে, নৌটঙ্কির জন্য এই রাজ্যে এসে রামমোহনের কথা বললেন আমাদের শান্তিগোপাল, থুড়ি প্রধানমন্ত্রী। এবং বললেন কোন প্রসঙ্গে? সন্দেশখালিতে নারীদের উপর অত্যাচার হয়েছে, সেখানে তৃণমূলের কিছু মাতব্বরেরা সমান্তরাল সরকার চালাত, তারা প্রশাসনের মদত নিয়েই মানুষের উপর অত্যাচার চালাত, এই কথাগুলোই দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এবং তা বলতে গিয়ে রামমোহনের প্রসঙ্গও এসেছে।
সন্দেশখালি নিয়ে যে ছবি আপাতভাবেও উঠে আসছে তা ভয়ঙ্কর, নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগজনক। খানিক স্বস্তিকর এটাই যে মূল অভিযুক্তরা কমবেশি হাজতে, এলাকাতে পুলিশ প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে, মন্ত্রীসান্ত্রীরা যাচ্ছেন এবং ওই গ্রেফতারির পরে এলাকার মহিলারা যে রংয়ের আবিরই মাখুন না কেন, মেখেছেন, অর্থাৎ তাঁরা কিছুটা হলেও ভরসা পেয়েছেন। যদিও সেখানে বিরোধী দলের নেতাদের না যেতে দেওয়া, আটকানো ইত্যাদি ঘটনাগুলোকে গণতান্ত্রিক তো বলা যায় না। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ঘটনা উদ্বেগজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক এবং তিনি সেই কথাই বলেছেন, ভুল তো বলেননি। কিন্তু এই কথাগুলো যখন তিনি বলছেন তখন তিনি ভুলেই গেছেন যে তিনি মণিপুরেরও প্রধানমন্ত্রী, তিনি হাথরসে যাঁরা থাকেন, যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হল তাঁরও প্রধানমন্ত্রী, তিনি ভুলেই গেছেন যে বিলকিস বানো বা তার পরিবারের মানুষজনেরা তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই জানেন। সন্দেশখালির ঘটনা উদ্বেগজনক, জঘন্য, কিন্তু মণিপুরের ঘটনার সঙ্গে তুলনাও করা যায়? গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালানো হচ্ছে, নারীদের গণধর্ষণের পরে নগ্ন করে প্যারেড করানো হচ্ছে, রামমোহন কাঁদেননি সেখানে? উন্নাও, হাথরসে ধর্ষকদের সপক্ষে মিছিল করছেন বিজেপির নেতা সমর্থকেরা, রামমোহন কাঁদেননি সেখানে? বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সংস্কারী ব্রাহ্মণ বলে সাজা কমিয়ে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। রামমোহন কাঁদেননি সেখানে? প্রধানমন্ত্রী মৌনিবাবা হয়ে বসে আছেন? একটা কথাও বলেছেন তিনি হাথরসের ধর্ষিতার পক্ষে? একটা কথা ওই বিলকিস বানোর পক্ষে? সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারে ওই সাজা মকুব করে দেওয়া জানোয়ারের দল আবার জেলে ঢুকেছে, তাই নিয়ে কোনও কথা? রামমোহন কাঁদেননি সেখানে? প্রশ্ন করা হয়েছিল গুজরাত দাঙ্গার পরে, এতজন মানুষ সংখ্যালঘু মানুষ মারা গেলেন, আপনার প্রতিক্রিয়া? খানিক চুপ থেকে বলেছিলেন গাড়ির তলাতে কুকুর চাপা পড়লেও মানুষ দুঃখ পায়, এরা তো মানুষ, আমি নিশ্চয়ই দুঃখিত। কতটা অসংবেদনশীল হলে মৃত মানুষের সঙ্গে গাড়ির চাকার তলাতে চাপা পড়া কুকুরের সঙ্গে তুলনা করা যায়? এই হলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আজ নির্বাচনের আগে নতুন পাঁয়তাড়া নিয়ে নেমেছেন, তাঁর মনে পড়েছে রামমোহনের কথা।
আন্দোলনরত কৃষকদের রাস্তায় লোহার গজাল বসিয়ে, তাদের উপর গুলি, লাঠি, টিয়ার গ্যাস চালানো এক সরকারের মাথা বাংলায় এসে মানবাধিকারের কথা বলছেন, ১০০ জনের বেশি অন্নদাতার মৃত্যুর জন্য দায়ী এক মানুষ মানবিকতার কথা বলছেন? বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও? সারা দেশে বিজেপিশাসিত রাজ্যে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, ওই রাজ্যগুলোতে মহিলাদের শিক্ষার হার এখনও সবথেকে কম, জন্মহারে এখনও মহিলাদের ওনেক উপরে পুরুষ সন্তান, সেই দল মহিলাদের সম্মান নিয়ে কথা বলছে? কী বলেছেন তিনি? এখানে অপরাধীরা ঠিক করে তারা জেলে যাবে না বাইরে থাকবে? গুজরাতে কী হয়? একটা সেতু ভেঙে ৪০ জনের বেশি মানুষ মারা গেলেন, ক’জন জেলে? মণিপুরে আজ অবধি ৮০০-র বেশি মানুষ মারা গেছে, ক’জন জেলে? মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করুন বলার ক্ষমতাও যে প্রধানমন্ত্রীর নেই, তিনি এসে খালিপিলি জ্ঞান দিয়ে চলে যাবেন? বলবেন রামমোহনের কথা? যে রামমোহন সারাটা জীবন ব্রাহ্মণ্যবাদ, সনাতনপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন, সেই রামমোহনকে নিয়ে একটা কথা বলা তো দূরস্থান, তাঁর নাম উচ্চারণের অধিকারও কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আছে? নারী অপমান? কাকে দাঁড় করিয়েছেন আসানসোল থেকে? কী বলেছে সে বাঙালি মহিলাদের নিয়ে? কতগুলো গার্হস্থ্য মামলাতে জড়িয়ে আছেন তিনি? এইসব পবন সিংরাই বিজেপির আসল মুখ, ছিছিক্কার ওঠার পরে তাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে শো ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন করুন, রামমোহনের নাম মুখেও আনবেন না। ঈশোপনিষদের ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি লিখছেন, “Many learned Brahmins are perfectly aware of the absurdity of idolatry and are well informed of the nature of purer mode of divine worship. But as in the rites, ceremonies and festivals of idolatry they find the source of their comfort and fortune, they not only never fail to protect idol worship
from all attacks but even advance and encourage it to the utmost of their power, keeping the knowledge of their scriptures concealed from the rest of the people.
নিজেদের সুখ আর বিলাসকে বজায় রাখতে ব্রাহ্মণরা, সনাতনীরা মূর্তিপুজোকে বড় আকার দেওয়ার চেষ্টা করেন, মূর্তিপুজোকে প্রশ্রয় দেন, ধর্মীয় রীতির অঙ্গ করে তোলার চেষ্টা করেন, ধর্মের মূল উদ্দেশ্যটাকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখতে চান। মাত্র কিছুদিন আগে রামলালার মূর্তি নিয়ে প্রদক্ষিণ করা আমাদের প্রধানমন্ত্রী রামমোহন পড়েছেন একথা কেউ কল্পনাতেও আনেন না, কিন্তু অন্তত তাঁর মাইনে করা লোকজনদের জানা উচিত যে সনাতনবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করা এক আধুনিক মানুষের নাম মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা নিয়ে চলা এক সংগঠন, এক দলের নেতাকে মানায় না।