‘এখনও জাস্টিস’ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন তিনি পদত্যাগ করছেন, ৬ তারিখ খোলসা করবেন তাঁর আগামী ভবিষ্যতের রূপরেখা এবং তিনি রাজনীতিতেই আসছেন। এমনিতে শিক্ষিত সভ্য ভদ্র মানুষজন রাজনীতিতে এলে তা আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশকে নিশ্চিতভাবেই এক উচ্চ মান দেবে, এটাই স্বাভাবিক। মধ্য পঞ্চাশে তৃতীয়বার বিয়ের আইবুড়ো অনুষ্ঠানে তাধিন তাধিন নেচে বা গঙ্গাবক্ষে বান্ধবীদের সঙ্গে নৌকাবিহারের ছবি দিয়ে নিজেকে ভাঁড় বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না। কিন্তু সব পেশা থেকেই এমন রাজনীতিতে নেমে পড়াকে কি সমর্থন করা যাবে? ধরুন এই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আগে কি খুব নাম ডাক শুনেছিলেন নাকি? অন্যদের থেকে বেশ দেরিতেই বিচারক হয়েছেন। নাম ডাক হল কবে? তিনি শিক্ষা দুর্নীতির বা চাকরি দুর্নীতির বিচারে বসলেন, সেই তখন থেকে। আচ্ছা এমন কি যে শিক্ষা বা চাকরি দুর্নীতির ক্ষেত্রে বিচার শেষ? অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে? সমস্ত অপরাধীরা জেলে গেছেন? বিচারক তাঁর সুচিন্তিত রায়ে অপরাধীদের চিহ্নিত করেছেন, শাস্তিবিধান করেছেন? এর একটাও হয়নি, উল্টে যে যে তদন্ত ইত্যাদির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তার এক বড় অংশই সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়েছে। উনি বিচার করতে বসে প্রচুর বাজে বকেছেন, সেসব সর্বোচ্চ আদালতের নজরে আসায় তাঁকে সেই দায়িত্বগুলো থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই চুটকুলাগুলো বলার পরে, এক অংশের কাছে উত্তেজনা জোগানোর মতো নানান মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন, দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেছেন, মিডিয়াতে বেশ একটা নামডাক হয়েছে। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কাজের থেকে অকাজ অনেক বেশি করেছেন যাতে ওঁর ইমেজ তৈরি হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনই আসল মুদ্দা ক্রমশ পিছনে সরেছে এবং আপাতত তা খবরের কাগজে সাতের পাতাতেও জায়গা পাচ্ছে না। সেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি ৬ তারিখ সূর্য সেনের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নতুন কর্মসূচির কথা জানাবেন, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন, তিনি রাজনীতিতে নামছেন এ খবর অবশ্য তিনিই দিয়ে দিয়েছেন। সেটাই বিষয় আজকে, অভিজিৎ গাঙ্গুলির পদত্যাগ, পিছনের কারণ আর রহস্য।
উনি রাজনীতিতে নামছেন, নির্বাচনে প্রার্থী হবেন, উনি ৬ তারিখে সূর্য সেনের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ওঁর আগামী পরিকল্পনার কথা বলবেন কেবল কি এই কথাই বললেন? না, তার সঙ্গে বললেন কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তিনি জানালেন যে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের কথা পড়েছেন আর আপাতত চৌর্য সাম্রাজ্য দেখছেন, আর তাই ওনার মনে হয়েছে এবার তো কিছু একটা করতে হয়। এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে উনি চৌর্য সাম্রাজ্য দেখছেন, মানে আপাতত যাঁরা সরকারে আছেন তাঁরা চোর, এটাই বললেন। তাহলে উনি ওঁর বিচারপতির পদ ছেড়ে নিশ্চিতভাবেই তৃণমূলে যাচ্ছেন না।
আরও পড়ুন: Aajke | সন্দেশখালির শাহজাহানের পিছনে কে?
তাহলে বাকি রইল বাম, কংগ্রেস আর অন্য অপশন বিজেপি। ওদিকে কাঁথির খোকাবাবুর পিতাশ্রী মুখ ফসকে হলেও বলেই ফেলেছেন যে তমলুকে দাঁড়াচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মানে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ওদিকে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন উনি যদি বিজেপিতে যোগ দেন তাহলে তা হতাশাজনক হবে। কার কাছে হতাশার? যাঁরা ওই অভিজিৎবাবুর মধ্যে চে গ্যেভারাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা তো সত্যিই হতাশ হবেন। যাঁরা মনে করছিলেন এক বামপন্থী নেতার বামপন্থী ভক্ত এই বিচারক আদতে বাম, তাঁরা হতাশ হবেন। বহরমপুর কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী অবশ্য বলেছেন অভিজিৎবাবু তাঁদের দলে এলে তিনি স্বাগত জানাবেন। তো উনি কোন দলে যোগ দিচ্ছেন তা এখনও উনি নিজে না বললেও এটা খুব পরিষ্কার যে উনি আর যাই হোক তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন না। কিন্তু বাকি যে দলেই যোগ দিন, সেই সিদ্ধান্ত তো একদিনে হয়নি, উনি বিচারকের চাকরি ছাড়ছেন, রাজনীতিতে নামছেন এবং নেমেই লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন, এটা তো একদিনেই ঠিক হয়ে যায়নি। বহু আলোচনা হয়েছে, বহু প্লাস মাইনাস পয়েন্ট নিয়ে অন্যরাও ভেবেছেন, উনিও ভেবেছেন। আচ্ছা সেই সময়ে তো তিনি বিচারপতিই ছিলেন, রাজ্যের বিভিন্ন মামলা তাঁর এজলাসে ছিল, সেখানে সরকার পক্ষের দল, বিরোধী দলের মানুষজন আসামি বা ফরিয়াদি ছিলেন, তিনি কি তাঁর নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন? ধরুন ২০ মে যখন বলছেন “সুযোগ হলে গান্ধী পরিবারের সম্পত্তির হিসেবও চাইতে পারি” তখন তিনি কোন গুজবকে উসকে দেওয়ার জন্য ওই কথা বলেছিলেন? শিক্ষকদের এই অবস্থা? স্কুল না চালাতে পারলে আদানিকে বেচে দিন, বলেছিলেন ৩১ জুলাই ২০২৩-এ, কাদের হয়ে বলেছিলেন? কাদের বিরুদ্ধে বলেছিলেন? দরকার পড়লে যোগী আদিত্যনাথের কাছ থেকে বুলডোজার ভাড়া করুন, এই কথাও বলেছিলেন ২৮ জুলাই, ২০২৩-এ, মানে ওই বুলডোজার চালাতে হবে এই বাংলাতেও, বলছেন একজন বিচারপতি। বলেছিলেন ঘটসুদ্ধু বিসর্জন দেব। কার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন? এবং সেই সব বলা, সেই সব রায় বা অবজার্ভেশন যে এক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই দেওয়া হয়েছিল, এই অভিযোগ তো উঠতে শুরু করেছে। তমলুকে বিজেপির হয়ে নির্বাচনে নামার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হওয়ার পরে তো সেটা আরও সজোরে বলবে শাসকদল, তাই না? নিরপেক্ষতা বড় কঠিন, আর সেই নিরপেক্ষতা প্রচার সর্বস্ব এক মেগালোম্যানিয়াকের কাছ থেকে আশাই করা যায় না। তাই লাল জ্যাকেট পরে নিজেকে বিকাশ ভট্টাচার্যের শিষ্য বলে জাহির করা এই বিচারকের আদত চেহারা এসে পড়ার পরে অনেকে অবাক হয়েছেন, অনেকেই বলেছেন এটা প্রত্যাশিতই ছিল। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, লাগাতার রাজ্য সরকার, তৃণমূল দল ও নেতাদের সম্পর্কে কটু কথা বলতে থাকা বিচারক অভিজিৎ গাঙ্গুলি রাজনীতিতে নামছেন, শোনা যাচ্ছে তিনি তমলুকে বিজেপির প্রার্থীও হচ্ছেন। এই ঘটনা কি আদতে বিচার ব্যবস্থা আর বিচারপতিদের ভাবমূর্তিকে অনেকটাই ম্লান করল না? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যে কোনও মানুষ যে কোনও রাজনীতি করতেই পারেন, নির্বাচনে যে কোনও দলের হয়ে দাঁড়াতেই পারেন, কিন্তু রাত পোহালেই একজন বিচারক যদি এক নির্দিষ্ট দলে যোগ দেন, এক পুলিশ অফিসার যদি এক নির্দিষ্ট দলের হয়ে নির্বাচনে নামেন, তাহলে মানুষের আইন প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থার ওপর ভরসা হারায়। আমরা রামমন্দিরের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেওয়ার পরে অবসর নেওয়া চিফ জাস্টিস রঞ্জন গগৈকে বিজেপির সাহায্যেই রাজ্যসভা সদস্য হতে দেখেছি, এবার সেই তালিকাতে আরও একজন। এটা আবার এমনও নয় যে বিচারক অভিজিৎ গাঙ্গুলির কাছ থেকে এমনটা কেউ আশা করেননি। সসস্যা হল বহু মানুষ শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু হওয়ার আশায় বসে থাকেন, একজন সৎ মানুষকে দেখতে চান, একজন সৎ মানুষকে অনুসরণ করতে চান, সেই মানুষেরা আজ আশাহত হবেন।