এমনিতে সরকারের ঘুম ভাঙে আঠেরো মাসে, কিন্তু দরকারে সে ঘুমোয় না, বোঝা গেল। ১৪ অক্টোবর একজন একটা অভিযোগ করল, আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচিত একজন সাংসদের সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হল ৮ ডিসেম্বরে, মানে কমবেশি ৬৬ দিনের মাথায়। অভিযোগের তদন্ত, প্রমাণ ইত্যাদি জোগাড় করা, রিপোর্ট জমা দেওয়া এবং সেই সাংসদকে দোষী ঘোষণার পরে সদস্যপদ খারিজ করাও হয়ে গেল, মাত্র ৬৬ দিনে। এবং এই সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া, এইভাবে কেড়ে নেওয়া বহু প্রশ্নের জন্ম দিল, যে প্রশ্ন মানুষের মাথায় ধাঁধা হয়ে ঘুরছিল বহুদিন। আমাদের ছোটবেলা থেকে যে প্রশ্ন বহুবার শুনেছি, যে আলোচনা মাঝেমধ্যেই উঠে এসেছে, যা নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক হয়েছে সেই প্রশ্ন আবার আমাদের সামনে এসে হাজির। তাহলে কি আমাদের সংসদ আমাদের অলক্ষে অন্য কেউ চালায়? আমাদের সংসদ কি কয়েকজন ব্যবসায়ীর নির্দেশে চলে? তাহলে এইসব নির্বাচন ইত্যাদি কেবল এক আইওয়াশ? তাহলে কি আসলে সংসদীয় গণতন্ত্র মুষ্টিমেয় শিল্পপতি বিলিওনিয়ার, ট্রিলিওনিয়ারদের ইশারাতেই চলে? মহুয়া মৈত্রের সাংসদ সদস্যপদ খারিজ এই প্রশ্নগুলোকে আবার সামনে এনে দাঁড় করাল। এবং যাঁরা এই সংসদীয় গণতন্ত্রের অসারতার কথা বহুকাল ধরে বলে আসছেন, তাঁদের হাতে আরও একটা টাটকা অস্ত্র এসে হাজির হল। একবার ক্রোনোলজিটা দেখে নেওয়া যাক।
আমাদের ছোটা মোটা অমিত ভাই বলার পর থেকে ক্রোনোলজি শব্দটা এক অন্য মাত্রা পেয়ে গেছে। কিছু খবর যা ১৪ অক্টোবর জয় অনন্ত দেহাদ্রাই, একজন আইনজীবী, যিনি সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পরে সিবিআই আর লোকসভার স্পিকারকে লিখিত জানিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল, মহুয়া মৈত্র টাকাপয়সার বিনিময়ে সংসদে একজন শিল্পপতির স্বার্থেই কিছু প্রশ্ন করেছেন। ১৫ অক্টোবর এই চিঠির ভিত্তিতেই বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সংসদের স্পিকারকে একই অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিলেন। একজনের সঙ্গে সদ্য সম্পর্ক ভেঙেছে, অন্যজনের সঙ্গে সংসদের মধ্যেই বহুবার মহুয়া মৈত্রের বাগবিতন্ডার কথা আমরা জানি। অর্থাৎ দুজন অভিযোগকারীর সঙ্গেই মহুয়া মৈত্রের বক্তিগত সম্পর্ক খুব খারাপ। এরপর এই বিষয়টি সংসদের এথিকস কমিটির কাছে পাঠানো হয়, এথিকস কমিটি প্রথম সমন পাঠায় ৩১ অক্টোবর। পুজো, বিজয়া ইত্যাদি কারণে মহুয়া মৈত্র সেই দিনে হাজির থাকতে পারবেন না বলে জানান। ২ নভেম্বর মহুয়া মৈত্র এথিকস কমিটির বৈঠকে হাজির হন, কিছুক্ষণের মধ্যেই মহুয়া মৈত্র সমেত বাকি বিরোধী দলের সদস্যরা সেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, এথিকস কমিটির চেয়ারম্যান মহুয়া মৈত্রকে যে প্রশ্ন করছেন তা অবান্তর এবং অশালীন। ১০ নভেম্বর ওই এথিকস কমিটি স্পিকারের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করল। ৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা পাঁচে এই সুপারিশ এবং ৪৯৫ পাতার এক রিপোর্ট পেশ করা হল। বিকেল ৩টে নাগাদ সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সদস্যপদ খারিজ করার সিদ্ধান্ত পাশ হয়ে গেল। এক যুদ্ধকালীন তৎপরতা আমরা দেখলাম।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২০২৪ বিজেপির কাছে কেকওয়াক?
এমন নয় যে এথিকস কমিটির কাছে অন্য অভিযোগ পড়ে নেই, আছে, কিন্তু সেগুলো আপাতত ঠান্ডা বস্তায়। তাহলে এই ক্ষেত্রে এই তৎপরতা কেন? কার নির্দেশে? এসব নিয়ে আলোচনার আগে দেখে নেওয়া যাক মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কী? প্রথম অভিযোগ হল, মহুয়া মৈত্র ওয়েবসাইটে তাঁর সংসদের যে পোর্টাল লগ ইন আইডি, পাসওয়ার্ড অন্য কাউকে দিয়েছিলেন, যিনি দেশ থেকে বিদেশ থেকে অন্তত ৪৭ বার এই পোর্টালে লগ ইন করেছেন। মজার ব্যাপার হল, গত ১৫ নভেম্বর সংসদের সচিবালয় থেকে জানানো হয়েছে যে এখন থেকে সাংসদ তাঁর অ্যাকাউন্টের লগ ইন আইডি আর পাসওয়ার্ড কাউকে দিতে পারবেন না। তো এর আগে কী ছিল? বলা ছিল কি যে সাংসদ বা তাঁর অথরাইজড পারসন অর্থাৎ তাঁর হয়ে কেউ এই লগ ইন আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারবে। না তাও ছিল না, আসলে এই নিয়ে কোনও রুলিং ছিলই না। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরেই সাংসদদের লগ ইন পাসওয়ার্ড নিয়ে দল, দলের কর্মী, আপ্ত সহায়ক, টাইপিস্টরা সংসদে তোলার জন্য প্রশ্ন পোস্ট করেছেন, সাংসদের টিএ, ডিএ বিল আপলোড করেছেন। দীর্ঘকাল ধরেই এটাই ছিল রীতি, মাত্র ১৫ নভেম্বর সেই নতুন রুল জারি করা হয়েছে। এবারে বলা হল, লগ ইন আইডি আর পাসওয়ার্ড অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না। সাংসদরা ফাঁপরে পড়বেন নিশ্চিত, এবার থেকে তাঁদেরই টিএ ডিএ থেকে বিভিন্ন হিসেব, ট্রেন প্লেনের টিকিট ইত্যাদি, বাংলোর বিষয়ে কমিউনিকেশন সবই নিজেদের করতে হবে, অন্তত আপলোড তো নিজেদেরই করতে হবে। কিন্তু এতদিন সে নিয়ম তো ছিল না, তাহলে ১৪ অক্টোবরের অভিযোগের ভিত্তিতে মহুয়া মৈত্রর সদস্যতা কেড়ে নেওয়া হল কেন? তিনি তাঁর লগ ইন পাসওয়ার্ড কাউকে দিতে পারেন না এমন কোনও নিয়ম থাকলে এবং তা অগ্রাহ্য হয়ে থাকলে, উল্লঙ্ঘন করা হয়ে থাকলে তো শাস্তি পাওয়াই উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই রুলিং এল গত ১৫ নভেম্বরে। তাহলে তার আগে লগ ইন বা পাসওয়ার্ড শেয়ার করাটা অপরাধ হল কী ভাবে? আচ্ছা টেকনিক্যালিটির কথা বাদই দিলাম, বলা হল পয়সার বিনিময়ে মহুয়া মৈত্র তাঁর ব্যবসায়ী বন্ধুর স্বার্থ সম্বন্ধিত প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন সংসদে। এই অভিযোগের সপক্ষে কী প্রমাণ লোকসভাতে পেশ করা হল? জয় অনন্ত দেহাদ্রাই বা নিশিকান্ত দুবে তো কেবল অভিযোগ করেছেন। তাহলে?
সেই ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির একটা এফিডেভিট করা বয়ান আমাদের সামনে এল যেখানে দর্শন হীরানন্দানি বলছেন, আমি মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি কারণ তাঁর বিনিময়ে উনি আমার হয়ে সংসদে কিছু প্রশ্ন করেছেন। ওনার সঙ্গে রাহুল গান্ধী বা শশী থারুরের মতো নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল যা আমার পক্ষে জরুরি ছিল এবং এই যোগাযোগ রাখার জন্যই আমি মহুয়া মৈত্রকে বিভিন্ন দামি গিফট, সুবিধে দিতে বাধ্য হয়েছি। সেই দর্শন হিরানন্দানিকে কি এই এথিকস কমিটিতে ডাকা হয়েছিল? মহুয়া মৈত্রের মুখোমুখি বসানো হয়েছিল? এই দর্শন হীরানন্দানির নির্দেশে কোন কোন প্রশ্ন সংসদে মহুয়া মৈত্র তুলেছিলেন, তা কি জানা গেছে? এই দুবাইতে বসবাসকারী ব্যবসায়ী মহুয়া মৈত্রকে যে টাকা দিয়েছেন মানে প্রশ্ন করার জন্য টাকা পেয়েছেন, সেই টাকার কি কোনও হদিশ পাওয়া গেছে? কোনও প্রমাণ পাওয়া গেছে? সবকটা প্রশ্নের উত্তর এন ও নো, একটা বড় না। তার মানে যে কোনও সাংসদের বিরুদ্ধে একজন সিবিআই বা ভিজিলেন্স এজেন্সিকে ফোন করবেন, তারপর সংসদে একজন সেই অভিযোগ তুলবেন তারপর বিদেশে বসে থাকা যে কোনও ব্যবসায়ী সেই বিষয়ে একটা এফিডেভিট করে পাঠিয়ে দেবেন এবং সাংসদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে? যে সাংসদ সংসদে বেয়াড়া প্রশ্ন করবেন, সংসদে সরকার দলের কাছে ভীতিপ্রদ বা বিরক্তিকর হয়ে উঠবেন, তাঁকে সরকারি দল যে কোনও সময়ে যদি সংসদ থেকে বার করে দিতে পারে, তার সদস্যপদ খারিজ করে দিতে পারে তাহলে এই নির্বাচন, গণতন্ত্র ইত্যাদি কি অর্থহীন হয়ে পড়বে না? সেই মানুষজনের কথাই কি সত্যি হয়ে দাঁড়াবে না যে আসলে এই সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ চালায় কিছু শিল্পপতি, তাঁদের নির্দেশেই এই সংসদ চলে, তাঁদের বিরোধিতা করে এই সংসদে টিকে থাকা যাবে না?
এরপরেও আরও কিছু কথা আছে, এর আগে ২০০৫-এ এই টাকা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগে ১১ জনের সদস্যপদ চলে গিয়েছিল, আসুন সেই বিষয়টাও আলোচনা করে নিই। কোবরা পোস্ট একটা স্টিং অপারেশন চালিয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল অন্তত ১১ জন সাংসদ ক্যামেরার সামনেই টাকা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করতে রাজি হয়েছিলেন। অনিরুদ্ধ বহেল কোবরা পোস্টের হয়ে এই স্টিং অপারেশন করেছিলেন। ১১ জনের মধ্যে ছ’জন ছিল বিজেপির, তিনজন বিএসপি, ১ জন কংগ্রেস আর একজন আর জেডির। এরমধ্যে ১০ জন ছিলেন লোকসভার, একজন রাজ্যসভার। লোকসভায় কংগ্রেস নেতা পবন কুমার বনসলের নেতৃত্বে এক কমিটি তৈরি হয়, আর রাজ্যসভায় বিষয়টি এথিকস কমিটির কাছে পাঠানো হয়। যেহেতু এক্ষেত্রে ক্যামেরার সামনেই টাকা নেওয়ার বিষয়টা পরিষ্কার ছিল সেই জন্য ফুটেজের ফরেনসিক পরীক্ষার পরেই এই ১১ জনকেই বহিষ্কার করা হয়। তখন লোকসভার স্পিকার ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধায়। সেই সময় বিজেপি দলের পক্ষে এক বয়ান দেওয়া হয়েছিল যাতে এই সদস্যতা পদ খারিজকে গণতন্ত্রের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় বলা হয় এবং বলা হয় এই বিচার এক ক্যাঙ্গারু কোর্টের মতোই চটজলদি এবং যথেষ্ট প্রমাণ ইত্যাদি না থাকার পরেও করা হয়েছে। লালকৃষ্ণ আদবানি বলেন, সদস্যতা পদ কেড়ে নেওয়া ফাঁসির রায়, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট, এটা আশা করিনি, এই ঘটনা আপাত দৃষ্টিতে করাপশন, কিন্তু আসলে এক ধরনের মূর্খতা। অন্যদিকে রাজ্যসভায় বিজেপি দলের নেতা অরুণ জেটলি বলেন এটা আইনি নয়, বিষয়টা এথিকস কমিটির দায়রার মধ্যেই পড়ে না, এটা আসলে প্রিভিলেজ কমিটির কাছে যাওয়া উচিত ছিল, এই রায় খারিজ করা হোক। এখন বিজেপি সেই সবক’টাই করে দেখাল। হ্যাঁ ২০০৫-এর বিজেপি বিলকুল পাল্টে গেছে, নাকি এটাই দস্তুর যেই থাকবে ক্ষমতায় সেই হবে স্বৈরাচারী। চলবে অন্যের নির্দেশে, সংসদীয় গণতন্ত্রকে যাঁরা আদতে স্বৈরতন্ত্রই বলেন, তাঁদের যুক্তিই কি তাহলে সামনে এসে দাঁড়াল না?