যে ভক্তকুল দেশ থেকে ইসলামের প্রত্যেক চিহ্নকে মুছে ফেলতে চায়, শুধু হিজ নেম ইজ খান তাই তাকে মেরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতে যাদের হাত কাঁপে না, উগ্র ভিড়ের মধ্যে পোশাক দেখেই যাঁরা জেনে ফেলেন তাঁদের ধর্ম, যা কিছু মুসলমান, যা কিছু ইসলাম, তার উপরেই যাদের রয়েছে তীব্র ঘৃণা, আমাদের দুর্ভাগ্য, তাদের হাতে, তাদের প্রতিনিধিদের হাতেই রয়েছে আমাদের দেশের ভার। কিন্তু সমস্যা তাদেরও কম নয়, হঠাৎ এক শাহরুখ খান এসে হাজির হয়, তার রুপোলি পর্দার ক্যারিশমা দেখতে ভিড় জমায় কোটি কোটি মানুষ। টিকি দাড়ি, পৈতে, ধুতি, লুঙ্গি, হ্যাট কোট সব মিলেমিশেই হাউসফুল জওয়ান চলে, ওদিকে আমিই হিন্দু কঙ্গনা রানাওয়তের তেজস মাটিতে থুবড়ে পড়ে। কী সমস্যা বলুন তো। এই এনারাই আজ অনেকেই অমিত শাহের বক্তৃতার পরে আরসালানের বিরিয়ানি বা সিরাজের চাপ খেয়ে বাড়ি ফিরবেন, সমস্যা কী কম। বিশ্বকাপে দেশের ভরসা মহম্মদ শামি, যিনি উত্তরপ্রদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর উপরে ভর করে ফাইনালের দোরগোড়াতে হাজির দেশ। সব প্রচারের আলো শুষে নিতে হাজির হয়েছিলেন নৌটঙ্কিবাজ, জয় আসেনি, হয়নি, আমাদের দুর্ভাগ্য নয়, এটা ক্রিকেট, এমনটা হতেই পারে। এবং এই পথ ধরেই গতকালের হিরো মুন্না কুরেসি, ১৫ মিটার সুড়ঙ্গ কেটে যে দল এগিয়েছিল আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিকদের উদ্ধার করতে, মুন্না কুরেশিই তাদের সব থেকে আগে ছিলেন। তিনিই প্রথম পাথর সরিয়ে তাঁদের দেখতে পান আর ভেতরে ঢুকেও পড়েন।
আরও অনেকে ছিল, ফিরোজ কুরেশি ছিলেন, দেবেন্দ্রও ছিলেন, প্রবীণ যাদব ছিলেন। ধর্মের সব আগল ভেঙে এই র্যাট হোল মাইনাররা বের করে আনলেন তাঁদের ভাই বন্ধুদের, ৪১ জন শ্রমিককে। র্যাট হোল মাইনার্স কারা? মূলত পরিত্যক্ত খনি থেকে বেআইনিভাবে যারা কয়লা ইত্যাদি তুলে আনে তাদের জন্যই এই টার্মটা ব্যবহার করা হয়। কেন? খানিকটা ইঁদুরের মতোই সামান্য একটা শাবল নিয়ে ৩-৪-৫ মিটার ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে খনির দেওয়াল ফুঁড়ে পেটের দায়ে এনারা খনির মধ্যে ঢুকে পড়েন, তারপর একদল কয়লা কাটতে থাকে, ঝোড়ায় তোলে। দড়িতে বেঁধে সেই কয়লা উপরে তোলা হয়, অন্যদল সেই কয়লা নিয়ে খালি ঝুড়ি আবার ভেতরে ফেরত পাঠায়। এরা মাঝেমধ্যেই বেআইনি বিস্ফোরকও নিয়ে যায়, ছোটখাটো বিস্ফোরণ করে বেশি কয়লা তোলার জন্য। পুলিশ, প্রশাসন আর রাজনৈতিক দাদাদের প্রণামী দিয়েই এঁরা এই কাজ করে, কিন্তু কয়লা জমা করতে হয় স্থানীয় মাফিয়াদের কাছে, খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে, এঁরা সেটা করেন। আর এই কাজ করতে গিয়েই হঠাৎ ধস নামে, বাইরের সঙ্গীরা কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরে চলে যান, কাউকে ডাকার কথা মাথাতেও আনেন না কারণ ওই খনিতে যাওয়াটাই বেআইনি। তখনও বেঁচে থাকা লোকগুলো কিছুদিন পরে মরে যায়, না খেতে পেয়ে, অক্সিজেন আর জলের অভাবে। এদের র্যাট হোল মাইনার্স বলে, মেঘালয়ে বেশ কিছু র্যাট হোল মাইনার্স মরার পরে তাদের এই নাম সামনে আসে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মুসলমান মানুষজনের ভোট ভাগের এক চক্রান্ত চলছে
কিন্তু তাদের কাজ বন্ধ হয়নি, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানে র্যাট মাইনাররা কাজ করে, এই বাংলাতেও আসানসোলের কিছু এলাকাতে আছে। সেই তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হল এবার আটকে পড়া শ্রমিকদের বের করে আনার জন্য। হ্যাঁ, সেখানেই ছিলেন মুন্না কুরেশি, যিনি প্রথমে থাকবেন, তাঁর আটকে পড়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি, এটা জেনেও তিনি সামনে ছিলেন, কাউকে তো সামনে থাকতেই হবে। এবার তাঁদের ঘিরে ছিল অজস্র মিডিয়ার ক্যামেরা, ভেতরে যাঁরা আটকে তাঁরা কিন্তু বেশ একটা বড় জায়গায় আছেন আর আড়াই ফুট সুড়ঙ্গ কেটে এই র্যাট মাইনাররা তাঁদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন। ২৭ ডিসেম্বর রাত থেকে তাঁরা গর্ত খোঁড়া শুরু করেন আর পরের দিন দুপুর নাগাদ তাঁদের কাজ প্রায় শেষ। সামনে মুন্না কুরেশি, শাবলের এক আলতো চাপে খুলে এল এক পাথরের চাঙড়, ভেতরে আলো। ৪১ জন শব্দ পাচ্ছিলেন, এবার মুন্না কুরেশিকেও দেখতে পেলেন, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুন্না আর তার দলবল ভেতরে। এবার বের করে নিয়ে আসার কাজ, একইভাবে ঝুঁকির কাজ। রাত ৭.৫৩ নাগাদ প্রথম মানুষটি বেরিয়ে আসছেন, আমরা ক্যামেরাতে দেখেছি। অন্যদিকের ছবিটা কেমন? যাঁরা আটকে পড়লেন তাঁরা কারা? কত লাখ টাকার মাইনেতে কাজ করেন? এ রাজ্যের পুরশুরা বিধানসভার বাসিন্দা জয়দেব পরামানিক, ক্লাস টুয়েলভ পাশ করেছেন, এর আগে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেছেন, তারপর চলে গেছেন ওখানে মাটি কাটতে, মাইনে ১৫ হাজার টাকা। পাশেই কোম্পানির তৈরি ঝুপড়ি, সেখানে খাওয়াদাওয়া বাবদ ৩ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়। কোনও ইন্সিওরেন্স নেই, যতদিন কাজ ততদিন মাইনের বিনিময়ে আপনাকে আরও তাড়াতাড়ি চারধামে পৌঁছনোর জন্য সুড়ঙ্গ কাটছিলেন।
এখন কী চূড়ান্ত ন্যাকামো, বাইরে ৪১টা অ্যাম্বুল্যান্স, যাঁরা বাড়ির আত্মীয় অসুস্থ রোগীদের ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগও পান না, তাঁদের একেকজনের জন্য একেকটা অ্যাম্বুল্যান্স, তাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন। তাঁদের প্লেনে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এবার এ রাজ্য, সে রাজ্য, প্রধানমন্ত্রী তহবিল থেকে কিছু টাকা দেওয়া হবে, তাই নিয়ে আকচা আকচিও হবে। অন্য মজুর যাঁরা দেশের অন্য কোনও প্রান্তে ১০-১২ হাজার টাকার জন্য জীবন বিপন্ন করে এরকমই কোনও কাজ করছেন, তাঁরা তাঁদের সতীর্থদের জন্য এহেন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেখে অবাক। এ দেশে তস্য হাঘরে মানুষ রেল দুর্ঘটনায় মারা গেলে টাকা পায়, বিষ মদ খেয়ে মারা গেলে টাকা পায়, সুড়ঙ্গে আটকে মরে গেলে সম্ভবত ক্ষতিপূরণ পায়। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তার মাইনে ১৫ হাজার থেকে খোরাকির জন্য তিন হাজার কেটে নেওয়ার পরে ১২ হাজার টাকা। দিনে চারশো টাকা। এখন তাঁদের নিয়ে নৌটঙ্কি চলছে, আরও বেশি করেই চলছে কারণ সামনে ভোট আছে। অন্যদিকে আরও হতাশার ছবি, বেআইনি র্যাট মাইনারদের ডেকে হাত দিয়ে শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে বের করা হল ৪১ জন শ্রমিককে। তার আগে সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল ডিক্সকেও মন্দিরে পুজো করতে বসানো হল, শ্রমিকরা বেরিয়ে আসছেন, হর হর মহাদেব ধ্বনি উঠল। একজন লিখলেন ফেসবুকে, ঈশ্বরের কি অপরিসীম করুণা।
চারধামের মসৃণ রাস্তা তৈরির মতো পবিত্র কাজে বাধা পড়ল কেন? কার করুণায়? সে প্রশ্নের উত্তর নেই, কিন্তু উদ্ধার যে বাবার কৃপায় হয়েছে তাতেই মশগুল দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ। পাশেই গড়ে উঠছে নতুন মন্দির, ৪১ জনকে যিনি উদ্ধার করলেন সেই বাবা বৈখনাগের মন্দির। এর পরের গ্রীষ্মে বেড়াতে গেলে নতুন স্পট বাবা বৈখনাগের মন্দির দেখে আসবেন। এ গেল একদিকের কথা, অন্যদিকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষজনের আরেক বিভ্রান্তি, তাঁরা চিৎকার করছেন জন হেনরির জয়, লিখছেন কায়িক শ্রমের কোনও বিকল্পই নেই, এখনও যন্ত্র শক্তির অনেক উপরে কায়িক শ্রম। ষাটের দশকে এই এঁরাই ব্যাঙ্কে কম্পিউটার বসানোর বিরোধিতা করেছিলেন, আজ অবৈজ্ঞানিক র্যাট হোল মাইনারদের মাথায় চড়িয়ে নাচছেন। দেখেছ, যন্ত্র যেখানে হেরে গেল যেখানে এই মানুষেরা সফল। হ্যাঁ, ওঁরা জীবন বিপন্ন করে ৪১ জনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, হ্যাঁ, ওঁরা এক দারুণ কাজ করেছেন। কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞানের উপরে, মানুষের মেধায় তৈরি যন্ত্রের উপরে এক অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে মাথায় তুলে নাচা? এ আবার কোন ধরনের মানসিকতা? মানুষের মেধায় তৈরি যন্ত্র নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, আবহাওয়া থেকে মেডিক্যাল ডায়গনিস্টিক প্রিসিশন, নিখুঁত বিচার কি মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল? কম্পিউটারের কাজ কি মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? ভুল দিশায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে উন্নয়নকে। পাহাড় তার পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে, তার ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা, সুড়ঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই জন্য। যন্ত্রও ছিল না, তাকে ব্যবহার করার মতো ব্যবস্থাও ছিল না, যন্ত্র ভেঙেছে, ভাঙতেও পারে, সেক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করা গেছে এটা ঠিক কিন্তু তার জন্য মানুষ যন্ত্রের বিকল্প হয়ে যাবে তাও তো নয়। একধারে অন্ধবিশ্বাস অন্য ধারে বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যার মধ্যে সত্য হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সেই সত্যকেই ধরে এগোতে হবে, আগামী দিন মানুষেরই মেধায় তৈরি এক আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার দিন, সেখানে মানুষের কায়িক শ্রম কমবে, মানুষের কাজের সময় কমবে, মানুষ আরও সৃষ্টিশীল কাজে নিজেদেরকে নিয়োগ করবে, এটাই তো আগামীর ছবি।