কংগ্রেস আর সিপিএম যতদিন আছে মোদিজীর কোনও চিন্তাই নেই। এই দুই দল মিলেই বিজেপিকে সরকারে থাকার মত অক্সিজেন জুগিয়েই যাবে। মাত্র কিছুদিন আগেই প্রথমে পাটনা আর বেঙ্গালুরে এবং শেষে মুম্বাই বৈঠকের পরে বিজেপিকে আমরা ব্যাকফুটে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল এক সার্বিক ঐক্যই গড়ে উঠতে চলেছে। সংসদীয় রাজনীতিতে ঐক্য, সার্বিক ঐক্য ত্যাদি কথাগুলো তো আসলে নির্বাচনী ঐক্যেরই কথা বলে, মানে তো একটাই যে একজোট হয়ে ৫৪২ নয় তো কমসে কম ৪৫০/৪৮০ আসনে বিরোধীদের একজন প্রার্থী থাকবে। প্লিজ বলবেন না আসলে জোট হল এক নীতিগত ব্যাপার, বিজেপির বিরুদ্ধে নীটিগত লড়াই, নির্বাচনে জোট না হোক আসলে মাটিতে গড়ে তুলতে হবে বিজেপি বিরোধী আন্দোলন। এসব ভাট কথাবার্তা ঐ সিপিএম আর তাদের মুখপত্রে, তাও আবার এই বাংলার মুখপত্রেই লেখা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে এসবের কোনও সুযোগই নেই। এক চরম সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি জাতীয়তাবাদী, চরম স্বৈরাচারী, অপদার্থ সরকার যারা দেশের অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থেই ভোগে পাঠিয়েই দিয়েছে, দেশের সম্পত্তি কয়েকটা কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দিচ্ছে, যারা দেশের প্রায় প্রত্যেকটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে চুরমার করছে, যাদের হাতে সংবিধানও বিপন্ন, তাদেরকে সরাতে হবে, আর সরাতে হলে এখনও পর্যন্ত বেঁচে থাকা সংসদীয় হাতিয়ার নির্বাচনকে কাজে লাগিয়েই সরাতে হবে, হাতবোমা আর পাইপগান দিয়ে নয়। আর সেটা করতে হলে আপাতত বিজেপির বিরুদ্ধে যারাই আছে তাদের বৃহত্তম জোট দরকার। হঠাৎ দেশের মানুষ বুঝে ফেলবে যে বিজেপি নয় কংগ্রেসই দিতে পারে এক অসাম্প্রদায়িক ভারত, কংগ্রেসই রক্ষা করতে পারে এই ফাসিবাদী আক্রমণ থেকে, তা তো নয়। দেশের প্রত্যেকটা দলকে এক মঞ্চে আসতে হবে, এক ন্যুনতম বোঝাপড়াতে আসতেই হবে না হলে এই দম বন্ধ করা অবস্থার অবসান হবেই না। এই তো এক সহজ সরল সত্যি কথা। কিন্তু কংগ্রেস এবং সিপিএম আর আপাতত কাজকারবার দেখে মনে হচ্ছে যে ওনারা থাকতে এই ঐক্য গড়ে ওঠা অসম্ভব। কংগ্রেস চাপে পড়লে একরকম, চাপ একটু কমলেই তাদের গলার সুর পালটে যায়। এ বরাবরের অভ্যেস। আর সিপিএমের ধারাবাহিকভাবেই ভুল করে যাবার এক জন্মগত প্রবণতা আছে, ৬৪ তে সেই ভুলের সূত্রপাত, আপাতত তা এক বিরাট ভুলভুলৈয়া। শেষ ইন্ডিয়ার বৈঠকে কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল? মুম্বাই বৈঠক শেষ হবার পরে এক কমিটি তৈরি হল, সেই কমিটির প্রথম বৈঠকেই দুটো সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল জানানো হয়েছিল। প্রথমটা হল ইন্ডিয়া জোট ভূপালে তাদের প্রথম জনসভা করবেন, ঐ ভূপাল থেকেই শুরু হবে মোদি বিরোধী অভিযান। দু নম্বর সিদ্ধান্ত ছিল বেশ কিছু গোদী মিডিয়ার আঙ্করকে বয়কট করা হবে কারণ তাঁরা সুপরিকল্পিতভাবেই বিরোধীদের হেনস্থা করার কাজ করে চলেছেন। তো এই দুই সিদ্ধান্তের কী হল? কিছুদিনের অধ্যেই দক্ষিণ থেকে পেরিয়ারের কথা উঠলো, দলিত বিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব হলেন ডি এম কে নেতা স্তালিন ইত্যাদিরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভূপালের বৈঠক বাতিল করে দেওয়া হল। কেন? কারণ কমলনাথ এক প্রচ্ছন্ন হিন্দুত্বের প্রচার নিয়েই নির্বাচনে নেমেছেন, কংগ্রেসও সেই কায়দাই নিয়েছে, রাহুল গান্ধী কেদারনাথে চলে গেলেন, চন্দনচর্চিত মাথায় প্রেসের সঙ্গে কথা বললেন, বোঝানোর চেষ্টা করছেন আমিও হিন্দু, এই কাজ তিনি বেনারসের মন্দিরেও করেছেন, অনভ্যস্থ হাতের পুজো। ভোলা ময়রার পাশে আরও ভালো মিষ্টি নিয়ে বসে থাকা বিজন ময়রার খদ্দের জোটে না, জোটার কথাও নয়। ৩৯ টা ক্যামেরা লাগিয়ে গংগায় ডুব দিয়ে শিবের মাথায় কলসি ভরা দুধ ঢেলে নিয়েই আরতির প্রদীপ হাতে নিলেন মোদিজী, রাহুল সেখানে স্কুল পড়ুয়ার ভূমিকায়, মোদিজী সে স্কুলের হেড স্যর। কিন্তু না, কংগ্রেসের মনে হয়েছে মধ্যপ্রদেশ জিততে হলে ইন্ডিয়া জোট ভূপালে গেলে ঐ দলিত আর ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রসঙ্গ উঠবে কাজেই ভূপালে সভা বন্ধ। বেশ অন্য কোথাও হোক। সেদিকেও বিষয়টা এগোয় নি কারণ ঐ কংগ্রেসের অনীহা, ভোটের আগে থাকনা, বিশেষ করে এই রাজস্থান, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা বা মিজোরামের নির্বাচনে বিরোধীদের তো বিশেষ কোনও ভূমিকাই নেই, অতএব আপাতত ইন্ডিয়া জোটের প্রোগ্রাম শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে, কমলনাথ এক স্বাধ্বীকে টিকিট দিয়েছেন, তিনি প্রবচন শুনিয়ে বেড়ান, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মহাকাল মন্দিরে যাচ্ছেন, রাজস্থানে এক স্বাধ্বী কংগ্রেস জয়েন করেছেন, কমলনাথ তাঁর ভাষণে বলছেন অযোধ্যায় রামলালা মন্দিরের গেটে তালা ঝুলছিল, সে তালা তো রাজীব গান্ধীই খুলেছেন। অর্থাৎ সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ভুলকে আজ সত্যি বলেই জানাচ্ছে কংগ্রেস, সেদিন শাহ বানো মামলার রায় বের হবার পরে হিন্দুত্বের যে তাস খেলেছিল কংগ্রেস, যে প্যান্ডোরার বাক্স খোলার পরে বিজেপির এই বাড় বাড়ন্ত, সেটাকেই কংগ্রেস আজ গর্ব করে তাদের অ্যাচিভমেন্ট বলে দাবি করছে।কেবল সেটা করতে গিয়েই তাদেরকে ইন্ডিয়া জোট আর তার কাজ ইত্যাদিকে আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছে। বয়কটের লিস্টে থাকা ১২ জন গোদি ইডিয়ার অ্যাঙ্করদের তালিকায় থাকা নভিকা কুমারের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচার সারলেন কমল নাথ। যদি পাঁচ রাজ্যেও বিজেপি হারে তাহলেও ২০২৪ এ তারা ঐ অযোধ্যা নিয়ে যে প্রবল হিন্দুত্বের আবেগ নিয়ে হাজির হবে তা সামাল দিতে পারবে কংগ্রেস? ইন্ডিয়া জোট না থাকলে মুসলমান ভোট আবার চলে যাবে রিজিওনাল দলগুলোর কাছে, কংগ্রেস আবার নিজের জায়গাতেই ফেরত যাবে, এবং এইবারে নরেন্দ্র মোদী যদি আবার বিরাট মেজরিটি নিয়ে ফেরত আসে তাহলে দেশের রাজনৈতিক চেহারার যে আমূল পরিবর্তন হবে সেটা এক শিশুও জানে। রাজস্থানে বি এসপির ভোট আছে, সেখানে আপ প্রার্থী দিয়েছে, বামেদের কিছু পকেটে ভোট আছে, বামেরা প্রার্থী দিয়েছে, মধ্য প্রদেশে এস পির, বি এস পির ভোট আছে, এস পির এম এল এও ছিল, গতবারে নির্বাচনের পর সেই এম এল এ র সমর্থনও নিয়েছে কমলনাথের সরকার। তেলেঙ্গানাতে বামেদের প্রায় কিছুই নেই, গতবারের আগের বারে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল, সি পি আই আর সি পি এম এর একটা করে আসনও ছিল, ২০১৮ তে তেলেঙ্গানার নির্বাচনে সিপিএম সিপি আই এর ঐ দুটো আসনও গেছে .৫% ভোট ও জোটেনি, একমাত্র ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা কোরুকান্তি চন্দর জিতেছিলেন, তিনি ঐ তেলেঙ্গানা পৃথক রাজ্যের দাবিতে ৪৫ দিন জেলে ছিলেন, সেই লড়াই এর ফলেই তিনি জিতে ছিলেন। এবারে কংগ্রেস কোনও আলোচনাই করেনি বামেদের সঙ্গে, সি পি আই এখনও আশা ছাড়েনি, সি পিএম তেলেঙ্গানায়, রাজস্থানে বেশ কিছু প্রার্থী দিয়েছে। কমলনাথ বা কংগ্রেস এস পি র সঙ্গে গেহেলত আপ এর সঙ্গে কোনও কথাই বলেন নি, অতএব তাঁরা তাঁদের মত কেবল প্রার্থীই দেয় নি, তাঁরা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। বাম, এস পি, আপ, বি এস পি বিজেপির বিরুদ্ধে বলছে, নিশ্চই বলছে, কিন্তু কিছু কথাতো কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও বলছে, দু টো কি তিনটে আসনও তো এই ভোট কাটাকাটিতে যেতে পারে। কেবল আসন যাওয়াই নয়, বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই এর তো দফারফা হয়েই গ্যালো। যে ইন্ডিয়ার জন্ম বিজেপি কে আচমকাই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল, সেই ইন্ডিয়া জোটের এ হেন ছিন্ন ভিন্ন অবস্থা কাদের অক্সিজেন যোগাচ্ছে? অখিলেশ প্রকাশ্যেই মুখ খুলেছেন, বিরক্ত নীতিশ বলেছেন কংগ্রেস জোট নিয়ে সিরিয়াস নয়, সব মিলিয়ে আমরা আগেও বলেছিলাম, এখনও বলছি ইন্ডিয়া জোটের যে সামান্য পজিটিভ এফেক্ট পড়া শুরু হয়েছিল তা কর্পুরের মতই উবে গেছে। ওদিকে সি পি এম, এক কৌশলী পার্টি, সে কী যে করবে তা এখনও মানুষের বোধের বাইরে, ধরুন কেরালা, সেখানে তার লড়াই তীব্রভাবেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, মূখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন কেরালার কংগ্রেস যে আসলে বিজেপিকেই বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে, বা কেরালা কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির তলায় তলায় বোঝাপড়া রয়েছে তা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। যে কেরালা কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির গোপন বোঝাপড়া সেই কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলায় জোট বাঁধো তৈরি হও, এখানে গোপন বোঝাপড়া বিজেপি আর তৃণমূলের। তেলেঙ্গানাতে সেই কংগ্রেস তাঁদের সঙ্গে আসন সমঝোতার কোনও আলোচনাই করতে রাজি হয় নি, কাজেই ১৭ টা আসনে সিপিএম একলাই লড়বে, তার বাইরের আসনগুলোতে বিজেপিকে হারানোর ডাক দিয়েছে। রাজস্থান সিপিএম আবার শুরু থেকেই কংগ্রেস বিরোধী, হান্নান মোল্লার হাতে গড়া কংগ্রেস বিরোধী আন্দোলন করেই সিপিএম সেখানে এক টা দুটো আসন পায়, এবারেও ২৮ টা আসনে প্রার্থী দিয়েছে, তার বাইরে জনগণকে বিজেপিকে হারানোর ডাক দিয়েছে। ছত্তিশগড়েও একলাই লড়ছে দুই বাম। মধ্যপ্রদেশের কথা জানাই যাচ্ছে না। ওদিকে কেরালাতে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে আছে জে ডি এস, যারা ঘোষণা করেই বিজেপির সঙ্গে এন ডি এ তে যোগ দিয়েছে, জে ডি এস কেবল আছে নয়, তাদের মন্ত্রীও রয়েছে, তারা দল ভেঙে আলাদা হবার কোনও ঘোষণাও করে নি, মানে এন ডি এর শরিক দল বাম গণতান্ত্রিক জোটে আছেন, মন্ত্রীত্বেও আছেন। সবমিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। ওদিকে আপ ইডি আর সি বি আই এর হানায় নাজেহাল, কদিনের মধ্যে কেজরিওয়ালকেই না জেলে যেতে হয়, আদালতের রায়ে পরিস্কার যে ২০২৪ এর ভোটের আগে মণীষ শিশোদিয়া জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না, কাজেই তাদের গলায় আপাতত জোট ভাঙার কথা শোনা যাচ্ছে না। সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব ভোট এলেই মধ্যপ্রদেশের বদলা নিয়ে নেবেন নিশ্চিত, রায়বেরিলিতেও না প্রার্থী ঘোষণা করে দেন। স্তালিন চুপ করে গেছেন। আর এ বাংলায় বার বার কমরেড ইয়েচুরি আসছেন, কেবল এটা বোঝাতে যে উনি কেন সেই ইন্ডিয়া জোটে আছেন, যেখানে মমতা অভিষেকের সঙ্গে তাঁকে একসারিতে বসে ছবি তোলাতে হয়, কমরেড সেলিম সেই মমতা অভিষেককে জেলে পাঠানোর জন্য বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলেই খবর। সব মিলিয়ে ইন্ডিয়া জোট না ইন্ডিয়ান সার্কাস চলছে বোঝা যাচ্ছে না। আমার তো মনে হচ্ছে কংগ্রেস আর সিপিএম থাকতে মোদিবাবুর অক্সিজেন জোগানোর ব্যবস্থায় কোনও অসুবিধেই হবে না।
Fourth Pillar | কংগ্রেস আর সিপিএম যতদিন আছে মোদিজি’র কোনও চিন্তাই নেই
Follow Us :
RELATED ARTICLES