কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে,
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে–
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।
রবি ঠাকুর মানব সভ্যতার কথা বলেছিলেন, মানুষের কথা বলেছিলেন এবং শেষমেষ ভগবান বলে যদি কেউ থাকে, সেই পরম করুণাময়কে প্রশ্ন করেছিলেন। অন্যায় করেই যাবে, চরমতম অন্যায় করে যাবে, যার প্রতি আমাদের প্রতিদিনের ঘৃণা জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে, যে অন্যায়ের জন্য আমরা সেই অপরাধীর চরমতম শাস্তির কথা বলছি, তাকেও ক্ষমা করতে হবে? তাকেও কি ক্ষমা করা যায়। হে ইশ্বর, পরম করুণাময়, তাকেও কি ভালোবাসা যায়? রবি ঠাকুরের কাছে এ প্রশ্নের জবাব ছিল না, ছিল না বলেই, প্রশ্নতেই শেষ হয়েছে ওই কবিতা।
আজ আমরা সেই প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, যেখানে বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদে তার এক গল্প বলি। যেখানে কনফোড় যোগী আদিত্যনাথের ডেরা, সেখান থেকেই গল্পের শুরুয়াত। গল্পের নায়ক এক ডাক্তার, ডাঃ কাফিল খান। মণিপাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক্তারি পাস করে কিছুদিন সিকিমে অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসার হিসেবে পড়িয়েছেন, শেষে ৮ অগাস্ট ২০১৬ সালে বাবা রাঘব দাস মেডিক্যাল কলেজ, গোরখপুরে লেকচারার হিসেবে কাজ শুরু করলেন। ওই গোরখপুরেই অজানা কারণেই এনকেফেলাইটিস হয়, প্রায় প্রতিবছর, শিশু মৃত্যু হয়। যে বছর ইউপিতে নির্বাচনে যোগীজি মুখ্যমন্ত্রী হলেন, সেই বছরে ২০১৭ অগাস্ট মাসে ৬৩ জন শিশু মারা যায়, ঠিক তার আগে ১০ অগাস্ট হাসপাতালের অক্সিজেন সাপ্লাই কেটে দেওয়া হয়, তিনি নিজে বেরিয়ে পড়েন অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগাড় করতে, নিজে পয়সা দিয়ে কিছু সিলিন্ডার কিনে আনেন, ৬৩ জন শিশু মারা গেলেও বেশ কিছু শিশু অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। খবরের কাগজে এই ঘটনা লেখা হয়। কনফোড় যোগীর নিজের রাজত্বে ঘটনা, তিনি ডাঃ খানকে ডেকে দাবড়ানি দেন। সেটা ছিল মূলত প্রেসের সামনে মুখ খোলার জন্য। খান সেসব মুখ বুজে শোনেন নি, জবাবও দিয়েছেন। তাঁর এই অসাধারণ কাজের জন্য দুদিন পরেই ১৩ অগাস্ট ডাঃ খানকে তাঁর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিনেই তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি চাকরিতে গাফিলতি, সেকশন ৪০৯, অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও মৃত্যুর দায়, সেকশন ৩০৮, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, সেকশন ১২০ বি, জালিয়াতি, সেকশন ৪২০, দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়, তিনি অজামিনযোগ্য অপরাধের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হন। ৯ মাস পরে ২৫ এপ্রিল ডাঃ খানকে বেল দেওয়া হয়, ডাঃ খান বলেন ইউপি সরকার তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এর মধ্যে ডাঃ খানের পরিবারের ব্যবসা বন্ধ হয়, কেউ যোগীকে চটিয়ে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেন দেন করতে রাজি ছিলেন না। ১০ জুন ২০১৮ ডাঃ খানের ভাই গুলিবিদ্ধ হন, অপরাধী ধরা পড়েনি, অভিযোগের তীর বাসগাঁও-এর বিজেপি সাংসদ কমলেশ পাসওয়ান এবং তার দুই সাকরেদের দিকে, তারা কেউই গ্রেপ্তার হন নি। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ডাঃ খানকে আদালত নির্দোষ বলে রায় দেয়।
আরও পড়ুন: কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট (পর্ব-১৮)
ডিসেম্বর মাস, ২০১৯ দেশ উত্তাল, নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি নিয়ে, অমিত শাহের ক্রোনলজি নিয়ে, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে লাঠিচার্জ নিয়ে। প্রতিটা শহরে মিছিল, সংবিধান হাতে করে মিছিল, হাম দেখেঙ্গে, মানুষের প্রতিবাদ। রোজই সরকার মোদি অমিত শাহের ডিগবাজি খাওয়া। এসব চলছে, তারই মধ্যে ১২ ডিসেম্বার ২০১৯ আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির বাইরে সৈয়দ গেটে এক সভায় বক্তৃতা রাখলেন, বললেন নাগরিকত্ব বিল নয়, প্রশ্ন এনআরসি নিয়ে, ক্রোনোলজি নিয়ে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে।
১৩ ডিসেম্বর ইউপি পুলিশের এক টাস্ক ফোর্স মুম্বাই থেকে ডাঃ খানকে গ্রেপ্তার করল। দেশ বিরোধী, উসকানিমুলক ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ মানে দু মাস পরেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও প্রমাণ হাজির করতে না পারায় তাঁকে বেল দেওয়া হল। ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে আবার অ্যারেস্ট করা হলো, এবার জাতীয় সুরক্ষা আইনে। এবং ওই আইন অনুযায়ী তিন মাস আদালতে পেশ না করেও জেলে রাখা হলো, ২৬ জুন ইউনাইটেড নেশনস এর তরফে চিঠি লিখে মানবাধিকারের দাবী জানিয়ে ডাঃ খানের মুক্তি চাওয়া হয়। ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ এলাহাবাদ কোর্ট জানায় তাঁর বিরুদ্ধে আনা প্রত্যেকটা অভিযোগ ভুয়ো, মিথ্যে। ডাঃ কাফিল খান ছাড়া পেলেন। ইতিমধ্যে দু দফায় তাঁর ১৬ মাস কেটে গেছে জেলে। হ্যাঁ তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিকার। আজ সেই ষড়যন্ত্রের শিকার আমাদের সম্পাদক, ২৩৯ দিন জেলেই আছেন। আমরা জামিন চাইছি না, মুক্তি চাইছি না, we demand for justice, justice for Kolkata TV, justice for Kaustuv Roy.
দেখুন ভিডিও: