যামিনী রায় (Jamini Roy)। ভারতীয় আর্টের গুরু। নবরত্নের অন্যতম রত্ন। পদ্মভূষণে সম্মানিত চিত্রকর। সেই যামিনী রায়ের ছবি নাকি ‘নকল’ হয়েছে। ‘নকল’ ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে ছবির শহর কবিতার শহর কলকাতায়। যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ছত্রপতি দত্ত, প্রণবরঞ্জন রায়, হিরণ মিত্র, মৃণাল ঘোষের মতো ছবি বিশেষজ্ঞ, চিত্রকর এবং যামিনী রায়ের অনুগামীরা। গত মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি অকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এ একজোট হন যামিনী-ভক্তেরা।
পার্ক স্ট্রিট লাগোয়া মিডলটন আর্ট গ্যালারি। গ্যালারির অধিকর্তা কমল পারেখ। কমল পারেখ একজন চিত্রসংগ্রাহক। যামিনী রায়ের ছবির যে প্রদর্শনী নিয়ে বিতর্ক, তার নেপথ্যে শ্রী পারেখ। শহর কলকাতার তাবড় চিত্রকর, ছবি বিশেষজ্ঞ, যামিনী রায়ের অনুগামীদের অভিযোগ, কমল পারেখের সংগ্রহে থাকা ছবিগুলি ‘নকল’। যামিনী রায়ের আঁকা নয়। কলকাতা টিভি’র প্রতিবেদকের কাছে কমল পারেখের পাল্টা দাবি, যামিনী রায়ের পরিবার থেকেই ছবিগুলি তিনি কিনেছেন। তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ, নথি সমস্ত রয়েছে। প্রয়োজনে কমল পারেখ তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
তা হলে ছত্রপতি দত্ত, প্রণবরঞ্জন রায়, হিরণ মিত্র, মৃণাল ঘোষের মত ছবি বিশেষজ্ঞদের কেন মনে হচ্ছে কমল পারেখের প্রদর্শিত যামিনী রায়ের ছবিগুলি নকল? কোন যুক্তিতে বলছেন, ‘প্রদর্শনীর ছবিগুলোর সঙ্গে যামিনী রায় যে ধরনের কাজ করতেন তার কোনও মিল নেই।’ কেন বলছেন, ‘একটা নকল ছবির সামনে দাঁড়ালে সমস্ত শরীরে প্রতিক্রিয়া হয়।’ যামিনী রায়ের সমস্ত ছবি জাতীয় সম্পদ। ১৯৭২ সালে প্রয়াত হন যামিনী রায়। তার চার বছর পর আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, কেন্দ্রের সংস্কৃতি মন্ত্রক যামিনী রায়ের ছবির শৈল্পিক এবং নান্দনিক মূল্যের বিচার করে। ছবিগুলিকে জাতীয় শিল্পসম্পদের মর্যাদা দেয়। তাই এখন যামিনী রায়ের ছবি সংক্রান্ত যাবতীয় বিচারের ভার, চূড়ান্ত মূল্যায়ন করার অধিকার রয়েছে কেন্দ্রের সংস্কৃতি মন্ত্রকের। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার।
আরও পড়ুন: ১০ মার্চ কলকাতা ডার্বি বাতিল!
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে যামিনী রায়ের ছবি নিয়ে চর্চা করছেন ছবি-বিশেষজ্ঞ প্রণবরঞ্জন রায়। তাঁর বক্তব্য, ‘মিডলটন গ্যালারিতে প্রদর্শিত ছবিগুলির অডিট-এর ব্যবস্থা হোক। অডিট করুক আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। যাতে কোনও দর্শক প্রতারিত না হয়।’ চিত্রকর মৃণাল ঘোষের বক্তব্য, তিনি প্রদর্শনী দেখেছেন। ছবিগুলি যামিনী রায়ের নিজের হাতে করা কাজ কি না, তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন মৃণাল ঘোষ। যামিনী রায়ের ছবিতে রেখার যে গতি, সেই গতিকে খুঁজে পাননি তিনি। চিত্রকর মৃণাল ঘোষ সংশয় জানিয়েছেন যামিনী রায়ের করা সই নিয়েও। ‘যে কোনও মানুষেরই সই নকল করা খুব শক্ত কাজ,’ বলছেন মৃণাল ঘোষ। মিডলটন আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত ছবিগুলিতে যামিনী রায়ের সই রয়েছে। ‘অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই সই নকল করার চেষ্টা হয়েছে,’ বলছেন ছবি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দেখে মনে হয়েছে, ‘ছবির সই যামিনী রায়ের নয়। নকল ছবিতে সই থাকবেই। কিন্তু সব সময় যামিনী রায় তাঁর কাজে সই করতেন, তা নয়।’
এই প্রতিবেদন লেখার সময় ছবি-সংগ্রাহক কমল পারেখ কলকাতার বাইরে। পারিবারিক কাজে পুনেতে। কলকাতা টিভি ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। চিত্রকর যামিনী রায়ের ছবি নকলের যাবতীয় অভিযোগ খারিজ করেন কমল পারেখ। তথ্য ও নথিপ্রমাণ দিয়ে পরপর যুক্তি সাজিয়েছেন তিনি। কী কী যুক্তি? কোন কোন নথির কথা বলছেন শ্রী পারেখ? তাঁর দেওয়া নথি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
কমল পারেখ বললেন ছোটবেলা থেকেই তিনি আর্ট-এর ভক্ত। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি নানা রকম স্থাপত্যশিল্প সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ছবিও কিনতে শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে গ্র্যান্ড হোটেলে যামিনী রায়ের নাতনি শ্যামলিকা রায়ের কাছ থেকে তিনি এই ছবিগুলি কেনেন। সেই সব ছবির ক্যাটালগও তাঁর কাছে রয়েছে বলে দাবি করেন কমল পারেখ। যামিনী রায়ের সমস্ত ছবি শিল্পীর পরিবারের থেকেই কিনেছেন, বক্তব্য শ্রী পারেখের। কলকাতা টিভির প্রশ্ন দাবি তো করছেন, নথি কী রয়েছে? কমল পারেখের উত্তর, ‘যামিনী রায়ের নাতনির চিঠি হেফাজতে আছে। বৈধ নথি আছে। আইনি প্রমাণ রয়েছে। যামিনী রায়ের ছবি সংক্রান্ত যাবতীয় এফিডেফিট আছে।’ শ্রী পারেখের দাবি, ‘মিডলটন গ্যালারির প্রদর্শনীতে ৮০০-এর বেশি দর্শক যামিনী রায়ের ছবিগুলি দেখেছেন।’
২৭ ফেব্রুয়ারি অকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এ একজোট হন যামিনী-ভক্তেরা। প্রত্যেকের মনে সংশয়, যামিনী রায়ের এতগুলো কাজ! এতোদিন ধরে অন্তরালে! প্রতিকার চেয়ে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী মীনাক্ষী লেখিকে ই-মেল করেছে তাঁরা। সই করেছেন বাংলার ৪২ জন শিল্পী, ছবি বিশেষজ্ঞ, যামিনী রায় অনুগামীরা। ২৮ ফেব্রুয়ারি শেকসপিয়র থানায় একটি জেনারেল ডায়েরি করেছেন সৌমিক চক্রবর্তী, সপ্তর্ষী ঘোষ, ঋতব্রত জোয়ারদাররা।
দেখুন অন্য খবর: