১৯৫২ থেকে আমাদের দেশে নির্বাচন হচ্ছে, স্বীকৃত জাতীয় দল, স্বীকৃত রাজ্যের দল, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গিনতি প্রায় হাজার খানেক। এদের বহু দল উবে গেছে, ভ্যানিশ হয়ে গেছে। একসময়ে যে দল রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল, তারা আর নেই, ধরুন স্বতন্ত্র পার্টি, চতুর্থ লোকসভায়, মানে ৬৭-র নির্বাচনে ৪৪টা আসন পেয়েছিল। এখন আর নেই। জনসঙ্ঘ, শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে তৈরি হয়, সে দল আর নেই। সারা দেশের রাজনৈতিক আলোচনাতে এই দল ছিল, কিন্তু তেমন নির্বাচনী সাফল্য জোটেনি। ২০২২-এ নির্বাচন কমিশন ১১১টা এরকম দলকে তালিকা থেকেই মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল, যাদের বাস্তবে আর কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বহুবার ভেঙেছে, ঠিক এই মুহূর্তে দেশে জাতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি হওয়া একগুচ্ছ রাজনৈতিক দল আছে, রাজ্যের ক্ষমতায় আছে ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস। কমিউনিস্ট পার্টিও বহুবার ভেঙেছে, এতবার ভেঙেছে যে তার হিসেব রাখাও কঠিন। এবং এইসব রাজনৈতিক দলগুলোর ৯৯ শতাংশ নির্বাচনে লড়েছে, জিতেছে, হেরেছে। কিন্তু কোনও দল কখনও নির্বাচনের আগে তাদের দলের মধ্যেই কিছু নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে বলেনি যে যান, আপনারা বিরোধী দলের নেতাদের ভাঙিয়ে আনুন। আরও অনেক রেকর্ডের মতোই এও এক বিরাট চমকপ্রদ ব্যাপার। ২০২৪-এর আগে বিজেপি দলের এক বড় অংশের নেতাদের বসিয়ে আলোচনা করেছে, একটা টিম তৈরি হয়েছে, বিরোধী দলনেতাদের ভাঙিয়ে আনো। না, কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, লোকসভায় নিশ্চিতভাবে জিতবে, নিজের দমেই জিতবে এমন নেতাদের লিস্ট তৈরি করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, তাঁদেরকে ভাঙিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে, অন্তত পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ভাবা যায়? সে যে দলই করুক না কেন? তার আদর্শ যাই হোক না কেন, সে এর আগে মোদি, শাহ, আরএসএস–বিজেপি নিয়ে যাই বলে থাকুক না কেন, সে যদি বিজেপির টিকিটে লড়তে রাজি থাকে, তাহলে তাকে ভাঙিয়ে আনো। এটা দেশের শাসকদল, যারা আগামী ৫০ বছর দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকবেন এরকম দাবি করে, সেই দলের সিদ্ধান্ত। সেটাই বিষয় আজকে, তৃণমূল কি আবার ভাঙবে?
লোকসভায় ৫৪৩টা আসন, ১০০টা এমন আসন আছে যাতে বিজেপি জিতবে না, কোনওভাবেই না, টাকার বন্যা বইয়ে, দাঙ্গা লাগিয়ে, যা ইচ্ছে করার করেও সেখানে জিতবে না। মুখোমুখি লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে ২০০টার মতো আসনে, এই আসনে আর কেউ ফ্যাক্টর নয়। এখানে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, বিজেপি এখানে রাহুল দ্রাবিড় বা এম এস ধোনি, স্ট্রাইকরেট ৯০ শতাংশ, মানে কমবেশি ১৮০ তো পাবেই। বাকি ২৪৩টা আসনে অকংগ্রেসি দলের সঙ্গে বিজেপির লড়াই, এবং এখানেই সমস্যা, এগুলোতেই সমস্যা, লড়াই জোরদার।
আরও পড়ুন: Aajke | মমতা, অধীর, সেলিম এক মঞ্চে আসা সম্ভব?
ওই সবকা সাথ সবকা বিশ্বাস, মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে, ঘুসকে মারেঙ্গে, লড়কে লেঙ্গে, উনকা সংখ্যা বড় রহা হ্যায় গোছের হাজার বাওয়ালের পরেও এই ২৪৩-এ লড়াই জমজমাট। ২০১৪-তে মোদির ফেভারে দারুণ হাওয়া ছিল, ২০১৯-এ পুলওয়ামা, ২০২৪-এ রামমন্দির আছে কিন্তু বিজেপিরই তেমন ভরসা নেই। দেখুন না এই বাংলাতেই অমিত শাহ বলে গেলেন ৩৫টা আসন চাই, শাহি টার্গেট। পরের দিন দিলীপ ঘোষ বললেন ২৫টার জন্য লড়ছি। টার্গেট ১০টা কমে গেছে, সামনের তিন মাসে আরও কমবে, মানে ভরসা নেই, আর নেই বলেই দল ভাঙাও। সারাদেশে টিম তৈরি হয়েছে, এ রাজ্যেও হয়েছে। তারা লিস্ট তৈরি করেছে, সেই লিস্ট ধরে ধরে অ্যাপ্রোচও করা হচ্ছে। সমস্যা দুটো, প্রথম হল তালিকাতে একদল এমন আছেন যাঁরা নিজেদের জোরে একটা কাউন্সিলর নির্বাচনেও জিতে আসতে পারবেন না, তাঁরা জেতেন মমতার ভরসায়, এলাকাতে মমতার ছায়া, তৃণমূল কর্মীদের জান দিয়ে লড়ে যাওয়ার পরে তাঁরা নায়কোচিত হাসি দিয়ে নির্বাচিত সাংসদের সার্টিফিকেট হাতে নেন। তাঁদের কাউকে কাউকে দেখার জন্য ভিড় হয় বটে কিন্তু তাঁরা জেতেন ওই মমতার অন্যই, ঘাসফুল চিহ্নটা চলে গেলে তাঁরা নাথবতী অনাথবৎ হয়ে পড়ে থাকবেন। কাজেই তাঁদের কাছে অ্যাপ্রোচ করে কিচ্ছু হবে না। মমতা আর তৃণমূলের ভোটের উপরে তাঁদের মুখ দেখে কিছু ভোট আসে, কিন্তু তা ল্যাজ, সব্বাই জানে কুত্তা ল্যাজকে নাড়ায়, ল্যাজ কুকুরকে নাড়ায় না। অন্য তালিকাতে যাঁরা আছেন তাঁরা সেই জায়গা থেকে নির্বাচিত হন যেখানে কোথাও ২৮-৩০-৩২ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট আছে, সেখানকার সাংসদেরা জানেন ঘাসফুল চিহ্ন চলে গেলে দিল্লির টিকিট কাটা যাবে। তবুও এই লিস্টে কানাঘুসোতে দু’ তিন জনের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁরা জিতবেন? না, জিতবেন না কিন্তু নির্ঘাত জেলে যাওয়া থেকে বেঁচে যাবেন, এটাই অঙ্ক। সে যাই হোক রাজ্য বিজেপির নির্বাচনে জেতার অন্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে দল ভাঙানোর টিমও তৈরি হয়ে গেছে, প্রশ্ন হল আবার কি তৃণমূলের কিছু মাথা ভাঙিয়ে আনা যাবে? আবার কি এক আধটা শুভেন্দু অধিকারী পেতে পারে বিজেপি? এই প্রশ্নই করা হয়েছিল আমাদের দর্শকদের, শুনুন তাঁরা কী উত্তর দিয়েছেন।
ভারতের কেন সারা বিশ্বের নির্বাচনী ইতিহাসে এমন নির্লজ্জ স্ট্রাটেজি এর আগে শোনা যায়নি, একটা রাজনৈতিক দলের এতবড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার চলেছে, হাতে রামমন্দিরের মতো ইস্যু আছে, বিরোধী তেমন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী মুখও নেই, অথচ সেই দলের টার্গেট বিরোধী দলের নেতাদের জেলে পোরো, বিরোধী দলের নেতাদের ভাঙিয়ে আনো। মহারাষ্ট্রের মিলিন্দ দেওরা সেই তালিকাতেই নবতম সংযোজন। সেই টিম এখন এই বাংলার ৪২টা আসনের দিকে তাকিয়ে জল মাপছে, বা বলা যায় বহু উঁচু থেকেই শকুনের তীক্ষ্ণ নজর মাঠে চরতে থাকা সেই ভেড়াদের উপর যাদের ভয় দেখানো যায়, যাদের ভাঙানো যায়।