বিজেপি ৩০৩, তার আগের জোটের শিবসেনা জোট ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল, বিজেপি শিবসেনাকে ভেঙে তার বিরাট অংশ তাদের দিকে নিয়ে গিয়েছে. মহারাষ্ট্রে নিজেদের আসন ধরে রাখতে এনসিপিকেও ভেঙেছে। দুর্নীতি ইত্যাদির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েই অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবল, প্রফুল্ল প্যাটেল তাদের দিকে। কংগ্রেসের মিলিন্দ দেওরাকেও তারা ভাঙিয়ে নিল। রাজস্থান, ছত্তিশগড় বা মধ্যপ্রদেশে জয় তাদেরকে দু’দিক থেকে স্বস্তি দিয়েছে। প্রথমত তারা রাজ্যগুলোতে জিতেছে, দ্বিতীয়ত সেই রাজ্যগুলোর ওল্ড গার্ড বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া বা শিবরাজ সিং চৌহান বা রমন সিংহ আর কোনও সমস্যাই নয়, দিল্লি থেকেই রাজ্য সামলানো যাবে, কোনও বিরোধী স্বর নেই। অসম তাদের হাতে, কংগ্রেস থেকে যাওয়া হিমন্ত বিশ্বশর্মা এখন আরএসএস, মোদি-শাহের ট্রাস্টেড নাম্বার ওয়ান। উত্তরপ্রদেশে রামমন্দিরের মেগা ইভেন্ট তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মোদির বিরুদ্ধে সমকক্ষ কোনও মুখ বিরোধীদের কাছে নেই, মোদির জনপ্রিয়তা না বাড়লেও, কমেনি। অর্থনীতি যথাপূর্বং তথা পরং আর ভারতবর্ষে অর্থনীতির উপর ভোট হয়নি কোনওদিন, এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না। অর্থনীতিই যদি মাপকাঠি হত তাহলে কবেই এই সরকার আঁস্তাকুড়ে পড়ে থাকার কথা। কিন্তু তবু রাজার ঘুম নেই, রাজার বুকজ্বালা করছে, তবু আরএসএস–বিজেপি নিয়ম মাফিক নয়, সাম দাম দণ্ড ভেদ কোনওটাই বাদ দিতে চায় না ২০২৪-এর নির্বাচনে। কেন? তার দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ হল ফিনিশিং লাইন যত সামনে আসে, তত নার্ভাসনেস বাড়ে, মানুষের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য, রাজনীতিতেও সেটা প্রযোজ্য। সেই ১৯২৫-এ পথচলা শুরু করেছিল আরএসএস, লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র, লক্ষ্য এক অবিভক্ত ভারতবর্ষ, লক্ষ্য এক কড়া কেন্দ্রীয় শাসন, এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদী সরকার। রামমন্দির তো সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর সিঁড়ি।
১৯২৫-এ তা ছিল নাকি আরএসএস-এর এজেন্ডায়? ছিল না। দেশ স্বাধীন হচ্ছে, বাবরি মসজিদ নিয়ে একটাও কথা? ছিল না। বাঞ্চ অফ থটস-এ গোলওয়ালকর দেশের সংবিধান যে এটা হতেই পারে না, তা বলেছেন। বলেছেন তেরঙ্গা অশুভ, তিন অশুভ, বলেছেন ভাগওয়া ঝান্ডার কথা। কোথাও বলেননি রামমন্দিরের কথা। ১৯৪৯ বাবরি মসজিদে ঢুকে রামলালা বসানো হল, আরএসএস-এর একটা বয়ান আছে? নেই। জনসঙ্ঘের একটাও বিবৃতি? নেই। ৮০-র দশকে এসে ক্লান্ত আরএসএস আর নতুন বিজেপির হাতে বাবরি মসজিদ আর রামমন্দিরের ইস্যু তুলে দিলেন রাজীব গান্ধী। ঠিক তখনই আরএসএস বিজেপি বুঝেছিল, এই ইস্যু তাদেরকে এগিয়ে দেবে, কিন্তু সেটা কেবল এক ইস্যুই। রামমন্দির পেলেই হবে না, লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র, আর সরকার হাতে থাকলে আইপিসির বদলে ন্যায়সংহিতা চালু করা যায়, সংবিধানের বদলে মনুসংহিতাও চালু করাই যায়। আরএসএস বিজেপি জানে, ক্ষমতায় থাকলে জাতীয় পতাকা থেকে জাতীয় সঙ্গীত বদলানো যায়, ফ্যাসিস্টরা এটা ক্ষমতায় এসে বার বার করেছে, ইতিহাস তাই বলছে। নাজি বাহিনীর গান হয়ে উঠেছিল জাতীয় সঙ্গীত। কাজেই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের এক্কেবারে কাছে এসে আরএসএস বিজেপি সেই লক্ষ্যকে হাতছাড়া হতে দেবে না বলেই বেশ নার্ভাস, তারা কোনও উপায় বাদ দিতে রাজি নয়। দুই হল অঙ্কের হিসেব, অঙ্ক বলছে বিরোধীরা যদি সেই অর্থে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে বিজেপির পক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অসম্ভব। এই তথ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা জানেন, জানেন বলেই তাঁরা নার্ভাস, সেই নার্ভাসনেস বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন কাজে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | সোনিয়া, মমতা, অখিলেশ রামমন্দির উদ্বোধনে যাচ্ছেন না, এতে কার কতখানি ক্ষতি?
ওনারা খুব ভালো করে জানেন যে কংগ্রেস আর আপ একজোটে নামলে চণ্ডীগড়ের মেয়র পোস্ট তাঁদের হাত থেকে চলে যাবে, সাধারণ অঙ্কের হিসেবেই যাবে। মেয়র হতে দরকার ১৮ জন কাউন্সিলরের সমর্থন, কংগ্রেস আপ-এর মিলিত সংখ্যা ২০। তার মানে ২০২৪-এর আগেই বিজেপির হাত থকে দিল্লি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের একটি কর্পোরেশনের মেয়র আর ডেপুটি মেয়র পদ চলে যাচ্ছে। কতটা মরিয়া একে আটকাতে? একজন আপ নেতা বলছেন ১০ কোটি টাকা অফার এসেছে, চারজনকে বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে না, কেবল ভোট না দিলেই চলবে, যেখানে বলবে সেখানে চলে যাবে ১০ কোটি করে মোট ৪০ কোটি টাকা। হ্যাঁ, এটাই নার্ভাসনেস। কারণ এতদিন জানা ছিল আর যাই হোক আপ আর কংগ্রেসের জোট হবে না, এখন দেখা যাচ্ছে সে জোট হচ্ছে। হরিয়ানা তার ট্রেলার, পুরা পিকচার অভি বাকি হ্যায়। দিল্লি, পঞ্জাব, গুজরাতেও আপ কংগ্রেস জোট হচ্ছে। দিল্লির সাতে সাত হবে নাকি? হবে না। কংগ্রেস আপ জোট হলে সাতে তিন পেতেও ঘাম ঝরাতে হবে বিজেপিকে। পঞ্জাবের কথা ছেড়েই দিলাম, ওখানে বিজেপির কিছুই ছিল না, বিরাট কিছু হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, কিন্তু গুজরাতে? সেখানেও আপ কংগ্রেস জোট আবার বিজেপিকে সমস্যায় ফেলবে, কেকওয়াক হবে না। একইভাবে নীতীশ, লালু, কং, বাম জোট বিহারে কেমন করবে? যেখানে গত নির্বাচনে বিজেপির ভোট ছিল ১৯ শতাংশের একটু বেশি। এই ভোট বাড়বে? বাড়তে পারে। কিছু ছোট দলের সমর্থন পাবে বিজেপি? হ্যাঁ পাবে, কিন্তু কতটা বাড়বে তাতে? ৩-৪টে আসন পাবে? অধীরবাবুকে যদি কেবল এইটুকু বোঝানো যায় যে আপনার আসন সুরক্ষিত, মানে সিঁড়িতে চড়িয়ে মই কেড়ে নেবে না তৃণমূল, তাহলেই বাংলায় কংগ্রেস তৃণমূল কংগ্রেস জোট হবে, আর সেটা হলেই বিজেপি ক’টা আসনে জিতবে নয়, ক’টা আসনে লড়াইয়ের জায়গায় থাকবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। কং-তৃণমূল জোট হলে ৪ কি ৫টা আসনের বাইরে জিতে আসতে পারবে বিজেপি?
তেলঙ্গানাতে গতবার ৪ জন সাংসদকে জিতিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছিল, এবারে একজনও জিতবে? কর্নাটকে ২৮টা আসনে বিজেপির ছিল ২৬টা, এবারে ১২টা আসনে জিতলেও বিরাট কথা হবে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে সব আসন পেলেও উত্তরপ্রদেশে আসন কমবে, বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল তাই বলছে। এবং এইরকম একটা আবহে ভারতীয় জনতা পার্টি তার তূণীর থেকে সব অস্ত্র বের করেই মাঠে নামবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই তূণীর থেকেই বেরিয়েছে রামমন্দির, রামকে নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ওনাদের নেই, হিন্দু ধর্ম নিয়েও নয়। ঠিক এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া জোট, ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সকে ঠেকাতে মোদি-শাহের সবথেকে বড় ইভেন্ট অযোধ্যায় রামমন্দির। সারা দেশ মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের আবেগে ভাসবে। হ্যাঁ, সামনের মুখ নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি আর আদিত্যনাথ যোগী। দেশ তো হিন্দুদের, তাহলে কেন হিন্দুরাষ্ট্র হবে না? আপনার পাড়াতেই বসে শুনবেন। এরসঙ্গে তাদের তূণীরের পরের অস্ত্র জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। আবার হামলা করতে দেওয়া হবে, সব জানার পর কিছু বোড়ের মৃত্যু, এবং সেই মৃত্যুকে ঘিরে আবার পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান, ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে, একটা ছোটখাটো যুদ্ধ, ইদানিং যাকে বলা হয় লো ইনটেন্সিটি ওয়ার, হতেই পারে। আমরা তো জানি, যখনই প্রশ্ন ওঠে বস্ত্র কি খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য। বেকারত্ব গত ৪০ বছরের রেকর্ড সীমায়, চলে যাবে পিছনে, কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না, উবে যাবে এ দাবি, শ্রমিকদের মাইনে বাড়ছে না, কেউ শুনবে না। অবাধ লুঠ চলছে আম্বানি আদানি কর্পোরেটদের, এ কথা নিয়ে কোনও আলোচনাই হবে না। দেশ তখন শত্রুকে চিনে ফেলেছে। ১৯৩৩ থেকে জার্মানির মানুষ যেমনটা বুঝেছিলেন, দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার জন্য দায়ী ওই ইহুদিরা, তারাই নাকি উই পোকার মতো সব শেষ করে দিচ্ছে, অতএব ইহুদি হাটাও। আজ আমাদের দেশে সে আঙুল দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে। এটাই বিজেপির অস্ত্র। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধী শিবিরের মুখগুলোর সঙ্গে দুর্নীতির মাখামাখি চেহারা, সেও এক কদর্য ছবি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, গয়না আর সম্পত্তির দলিল বলে দিচ্ছে দুর্নীতির কালো শেকড়ের গল্প। যেদিকে তাকান, এক লুঠ, কাটমানি, দুর্নীতির ছবি। বিজেপি কেবল টর্চ মেরে আলো ফেলে কেবল বিজেপি বিরোধীদের দুর্নীতি সামনে আনছে, বিজেপির সঙ্গে থাকলে, বিজেপিতে যোগ দিলে সে দুর্নীতির গায়ে মোটা আবরণ, তাকে দেখা যাচ্ছে না। এটা সত্যি, কিন্তু বিরোধী ওই নেতাদের দুর্নীতিটাও তো সত্যিই, আর মানুষ সেটা দেখছে, মাত্র ১০ বছরের মন্ত্রিত্ব পেয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে কত সম্পদ জমেছিল। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সম্পদের পরিমাণ কত? এই হাতিয়ার সামনে রেখেই বিজেপির প্রচার, সব দুর্নীতিবাজেরা মোদিজির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মোদিজি আঙুল তুলে বলবেন, মিত্রোঁ করাপটেড মেন আর ইউনাইটেড। মানুষের অবিশ্বাস করার কারণটা বলুন? এইখানেই অ্যাডভানটেজ বিজেপি।
গত ৯ বছরে মোদি সরকার দেশের মানুষের কোনও সমস্যার সুরাহা করতে পারেনি, তথ্য বলছে, মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে সেই কথা। কিন্তু তাদের প্রচারে তারা এগিয়ে, ক্ষমতার প্রতিটা বিন্দুকে কাজে লাগিয়ে তারা দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান নিজেদের দখলে আনতে পেরেছে। অবাস্তব, অনৈতিহাসিক, অবৈজ্ঞানিক তথ্য মানুষের সামনে পৌঁছে দিতে পেরেছে, এইখানেই অ্যাডভানটেজ বিজেপি। তাহলে? আপনি ভাবতেই পারেন, তাহলে করবটা কী? হ্যাঁ লড়াই শক্ত, বিরোধীদের লড়াই আরও শক্ত। আর লড়াই যখন শক্ত হয়, তখন একটাই উত্তর, পথে নামুন, মানুষের কাছে যান, সত্যি কথাটা বলুন, বলতে থাকুন। আপাত হিন্দুত্ব আবেগে ভাসছে দেশ, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের আবেগে ভাসছে দেশ। কিন্তু মানুষের পেট মানুষের মাথাকে চালনা করে, কেবল আবেগে পেট ভরে না, সেই আবেগের উপরেও থাকে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই। সে প্রশ্ন সামনে আসতে বাধ্য, আজ নয়তো কাল, মানুষ বলবেই, অন্ন দাও, বস্ত্র দাও, মাথার উপর ছাদ চাই, বেকার যুবকের চাকরি চাই, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা চাই। আর এই দাবির পিছনেই ঢাকা পড়বে যাবতীয় আবেগ। মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম থাকবেন বাড়িতে, বাড়ির বাইরে লড়াই হবে ভাতের। স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিস্টরা এই লড়াইতেই হেরেছে বার বার, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। সেই ইস্যুগুলো নিয়ে একসঙ্গে দেশের বিরোধী নেতারা রাস্তায় নামুন। সিট অ্যাডজাস্টমেন্ট, আসন সমঝোতা নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু তার সঙ্গেই দরকার মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ইস্যুগুলোকে নিয়ে মানুষের পাশে থাকা। এক ঐক্যবদ্ধ বিরোধী জোট যদি এই ইস্যু নিয়ে মানুষের পাশে হাজির হয়, তাহলে গোটা ছবিটাই উল্টে যেতে পারে, লক্ষ্যের সবথেকে কাছে এসেও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে নাগপুরের গ্র্যান্ড প্ল্যান।