গতকালই আলোচনায় ছিল যে, যে কোনও রেজিমেন্টেড ক্যাডার বেসড পার্টি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোতে নবীন আর প্রবীণের দন্দ্ব স্বাভাবিক এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই দ্বন্দ্বে ফ্লাইং কালারস নিয়ে বেরিয়ে আসে নবীনের দল। সমস্ত বৃদ্ধদের সরিয়ে সুভাষ, নেহরু হাল ধরেছিলেন কংগ্রেসের, পরবর্তীতে ওল্ড গার্ডদের একরকম পথে বসিয়ে কংগ্রেসের হাল ধরার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইন্দিরা। দেশজুড়েই এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল ওইসব ক্যাডার বেসড পার্টিগুলোর কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে। ধরুন বিপ্লব হবেই কমরেডস, এক সর্বহারার বিপ্লব, পুরনো যা কিছু ভেঙে এক নতুন সমাজ হবে, সাম্য সমাজ। সেই কথা শুনেই প্রাণ বাজি রেখে ছুটেছে কিশোর যুবক, সামনে বিটি রনদিভে না ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, সেসব দেখার দরকার ছিল না। একইভাবে পাগলের মতো মানুষ ছুটেছে করসেবায়, লক্ষ্য এক হিন্দু রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রে সে কোথায়? তার খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের সমাধান কি সে রাষ্ট্রে আছে? জানার দরকারও নেই, সামনে পুলিশ, গুলি চলেছে, করসেবা হয়েছে। তার নেতা কে? আদবানি না জোশি, উমা ভারতী না বেঙ্কাইয়া নাইডু, তা নিয়ে ভাবেনি কেউ। বিজেপিতে এক নেতা, এক চেহরা, এ তো এই সেদিনের ব্যাপার। সে আরেকদিনের আলোচনা। কিন্তু বাকি দলগুলোতে তেমন নয়, সেখানে শুরু থেকেই দেশ কা নেতা ক্যায়সা হো বলে স্লোগান স্বাধীনতার আগেই শুনেছে মানুষ। এক নেতা হাল ধরেছেন, স্বাভাবিকভাবেই পাশে এসেছেন তাঁর সমবয়সিরা। তিনি থেকেছেন যতদিন থাকা সম্ভব, দেহত্যাগ ছাড়া পদত্যাগ নেই। জওহরলাল মারা গেছেন বলেই ইন্দিরা, ইন্দিরা গেছেন বলেই রাজীব, রাজীব গেছেন বলেই সোনিয়া এবং রাহুল, মুলায়ম আর নড়তেও পারছেন না দলের রাশ ধরেছেন অখিলেশ। লালু জেলে এবং অসুস্থ, হাল ধরেছেন তেজস্বী, ৮০ পার ফারুকের জায়গায় ওমর, ৮৪ পার করুণানিধির জায়গায় স্তালিন। এবারে কি তাহলে বাংলার রাজনীতিতে সেই ছবি? সেটাই বিষয় আজকে, বাংলায় কি দলের রাশ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই আসছে?
সোজা কথাটা সোজাভাবেই বলে ফেলি। যদি এটাই প্রশ্ন হয় যে তৃণমূলের দলের রাশ অভিষেকের কাছেই আসছে কি না তাহলে তার উত্তর ১০০ শতাংশ হ্যাঁ। অন্য কে নেবে ভাই? মমতার পরে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর কোনওদিনও বাংলার রাজনীতিতে আসতে পারবেন না। মুকুল রায় গুরুতর অসুস্থ, এরপর রয়েছে এক ওই বক্সি দা, সুব্রত বক্সি। কিন্তু তিনি মমতার ছায়ার বাইরে একটা কুটোও নাড়েননি কোনওদিন। এরপরে যাঁরা আছেন তাঁরা নিজের জোরে নিজের এলাকা থেকে জিতে এলেই অনেক।
আরও পড়ুন: Aajke | তৃণমূল আদি, তৃণমূল নব এবং তাদের বিভিন্ন গল্পগাছা
তাহলে রইল বাকি কে? অবশ্যই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং দলে তাঁর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই দলের তরুণ নেতৃত্ব সে ছাত্র হোক, যুব হোক বা অন্য গণ সংগঠনের, তার বিলি বন্দোবস্ত অভিষেকের দফতর থেকেই হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণা আর দাদার নেতৃত্ব, এটাই তাঁদের মাথায় ঢুকে গেছে। বাকি প্রবীণ নেতাদের, সৌগত রায় ইত্যাদির ঘামাচি চুলকুনি হতেই পারে কিন্তু সে চুলকুনি থামানোর জন্য পাউডারই যথেষ্ট, নেতৃত্ব নামক জায়গা থেকে তাঁরা বহু বহু দূরে। আপাতত মান সম্মান নিয়ে রাজনীতির জন্য মমতাই থাক এটাই তাঁদের একটু সান্ত্বনা, এই যা। কাজেই দলের মধ্যে নবীন প্রবীণের ধুন্ধুমার লড়াই চলছে আর এই লড়াইয়ের মধ্যে শুভেন্দু কুচুক করে একটি পাকা ডাল টেনে নিজের পাল্লা ভারি করবেন এমনটা হওয়ার নয়। দলের রাশ মমতার হাতে, বকলমে অভিষেকের হাতেই আছে, মমতার তাতে সায়ও আছে, সায় না থাকলে শুরুয়াতই হত না। তাহলে এই হা হা হু হু কেন? কারণ যুবরাজের সিংহাসনে বসার প্রক্রিয়াতে বাধাগুলো মমতা এবং অভিষেক দুজনেই বুঝে নিতে চান, এইসময় বেচাল দেখলে বাচাল চিহ্নিত করা খুব সোজা, খুব মসৃণভাবেই এই প্রক্রিয়াকে সর্বমান্য করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, প্রায় সফলও বলাই যায়। এক আলোড়ন হচ্ছে এমন এক আবহের মধ্যেই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে থাকে, এখানেও তাই হচ্ছে। তাহলে মমতা অবসর নিচ্ছেন? না তেমনও না, ২৪-এ অঘটন ঘটলে, মানে মোদি সাম্রাজ্যের পতন হলে দিল্লি রাজনীতিতে মমতা, রাজ্যে অভিষেক। না ঘটলে দল অভিষেকের, সরকার মমতার হাতেই থাকবে। আগামী দিনে সেটাই কোনওরকম প্রশ্ন আলোচনা ছাড়াই পূর্ণ নেতৃত্বে আনবে অভিষেককে। আমরা সেইজন্যই আমাদের দর্শকদের এই প্রশ্ন করিনি যে মমতার পরে কে? ইট ইজ ডিসাইডেড। আমরা প্রশ্ন করেছিলাম মমতার পরে অভিষেক দলের হাল ধরার জন্য কি যথেষ্ট উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
এখন এলোমেলো চলার জমানা শেষ, সবকিছুর পেছনে নিক্তি মাপা অঙ্ক কাজ করে। দুর্গাপুজো কমিটি এখন এক বছর আগেই থিম বেছে নেন এবং পাশের ক্লাব ১১ মাসের আগে তা টেরই পায় না। প্রতিদ্বন্দ্বী কর্পোরেট হাউস টেরই পায় না তার মার্কেট সেগমেন্ট-এ একজন ঢুকে পড়ার তাল ঠুকছে গত তিন বছর ধরে। ৬-৭ বছর বয়স থেকে কুস্তি কিংবা ক্রিকেটের প্রস্তুতি চলে। কাজেই রাজনৈতিক দল তার ব্যতিক্রম হবে এটা ভাবাটা বোকামি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। নির্বাচন আসছে, যে ভাবে হোক প্রচারের সবটুকু আলো শুষে নাও, খারাপ বা ভালো, সংবাদমাধ্যম জুড়ে থাকতে হবে নেতাকে, নেতা প্রসঙ্গে কত জল্পনা কল্পনা চলবে, হ্যাঁ এসবই ওই গ্র্যান্ড প্ল্যানের অঙ্গ। তৃণমূলের এই নবীন প্রবীণের লড়াইয়ের খবর তারই ছোট্ট অংশ। দেখুন না আমরাই তো দু’ দুটো আজকে লিখে ফেললাম এই একই বিষয় নিয়ে।