Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | বদলে যাচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, আমাদেরও বদলাতে হবে?

Fourth Pillar | বদলে যাচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, আমাদেরও বদলাতে হবে?

Follow Us :

ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দটা নিয়ে বিস্তর সমস্যা আছে। প্রথম সমস্যা হল ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দ আর সেকুলার শব্দ কি এক? বিশেষত দক্ষিণপন্থী বা আরও স্পষ্ট করে বললে আরএসএস–জনসঙ্ঘ–হিন্দু মহাসভা–বিজেপি, তাদের শাখা সংগঠন, এই আদর্শে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীরা। উপরে লিবারাল পোশাক পরা কিন্তু আদতে আরএসএস-এর ঘোর প্রচারকেরা বারবার করেই বলেন সেকুলার শব্দ আর ধারণা হল পাশ্চাত্যের, যার সঙ্গে আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতাকে মেলানো যাবে না। তাঁরা প্রথম দিকে মানে যখনও তাঁরা সামাজিক স্বীকৃতি পাননি, রাষ্ট্র চালনায় তেমন সুযোগ পাননি, গায়ে চিপকে রয়েছে ইংরেজদের চাটুকারিতার গন্ধ, লেগে রয়েছে গান্ধী-হত্যার রক্ত, সেই সময়ে তাঁরা ধর্ম নিরপেক্ষতার বদলে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা বলতেন। কেন? কারণ এমন নয় যে তাঁরা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের তত্ত্ব বা ধারণাকে সমর্থন করতেন, কারণ তাঁরা দেশের সনাতন বা অন্য ধারার হিন্দু ধর্ম প্রচারকদের সরাসরি বিরোধিতায় নামতে পারতেন না। খেয়াল করে দেখুন সতেরোশো আঠেরোশো, উনিশশোতে দেশের ধর্ম প্রচারকেরা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথাই বলছেন। সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার আচার সর্বস্ব প্রথা মানুষের কাছে অসহ্য ঠেকছিল, মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, বেদ পাঠ নিষেধ, ছুত অছুত, খাদ্য অখাদ্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে মানুষ তাঁদের নিজেদের ধর্ম তৈরি করে নিচ্ছিলেন, চৈতন্য, নানক, কবীর, রুইদাস, মীরা থেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের ঠাকুরচাঁদের মতো আরও অনেকে। কেবল নিজেদের ধর্মই নয়, তাঁরা একই সঙ্গে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথাও বলছিলেন। পিছু হঠেছিল মনুবাদী ব্রাহ্মণ্য সনাতন ধর্মের গুরুরা। প্রায় সেই সময় থেকেই চার মঠের শঙ্করাচার্যরাও দেশের মূল হিন্দু ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তার সঙ্গেই ছিল মঠের উত্তরাধিকার, অপার সম্পত্তি নিয়ে বহু মামলা, ঝামেলা, মারপিট খুনোখুনিও। সে কথা আরেকদিন, আপাতত মূল আলোচনায় ফেরা যাক।

আসলে এই আরএসএস, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদির নেতারা বুঝেছিলেন এখন টিকে থাকতে হলে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে ওই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের পথ ধরতে হবে। এবং তাতে সাধারণ মানুষের কোনও অসুবিধেও ছিল না। প্রতিটা পাড়ায় মন্দির আছে, কোথাও কোথাও মসজিদ বা চার্চ আছে, বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান আছে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু কেবল নয় বাকি ধর্মের সম্প্রদায়ের নেতা পুরোহিত, বিশ্বাসীরা মেনে নিলেন রামকৃষ্ণের যত মত তত পথের কথা। আমাদের বাংলাতে তো বটেই, ভক্তি আন্দোলন শেষ হতে না হতেই রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ এসে ওই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ভিত্তিকে এতটাই শক্ত করেছেন যে এখনও সেই ভিত্তি ধরে টান দিতে গেলেও দু’বার ভাবতে হচ্ছে সনাতনী হিন্দুদের। এরই মধ্যে এদেশে ঢুকে পড়েছে মার্কস, লেনিন, সমাজতন্ত্রের ধারণা। সে ধারণাকে অনায়াসেই এই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের সঙ্গেই জোড়া যেত, কিন্তু সমাজতন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত জওহরলাল নেহরু বা কমিউনিস্টরা ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দটির ওপর জোর দিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু আগে থেকেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ ওই সমাজতন্ত্রীদের দিকে ঝুঁকে। সামনে লাল রাশিয়ার ছবি, সর পে লাল টুপি রুশি ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি। কোনও বিভেদ ছিল না কিন্তু একটা বিভেদ খাড়া করা হল সর্ব ধর্ম সমন্বয় আর ওই ধর্ম নিরপেক্ষতাকে নিয়ে। সমস্যাটা কোথায় ছিল? আসলে ধর্ম নিরপেক্ষতা হল এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অঙ্গ। রাষ্ট্র হবে ধর্ম নিরপেক্ষ, মানে রাষ্ট্র বিশেষ কোনও ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না, কোনও একটা ধর্মের প্রচারের বা প্রসারের কাজ করবে না, কোনও একটা ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষজনকে তোল্লাই দেবে না। কেন এই ধারণার প্রয়োজন হয়েছিল? কোন সময়ে এই ধারণার প্রয়োজন হয়েছিল?

আরও পড়ুন: বিরোধী দলগুলো নির্বাচনী জোট তৈরি করতে পারলে বিজেপিকে হারানো যাবে?

তখন সবে মানুষ থিতু হয়েছে, আগেই শিখেছিল আগুনের ব্যবহার, তারপরে চাষবাস, এবার লাঠির জোরে জমি দখলের পরে ভূস্বামী এবং ক্রমে রাজা, রাজাধিরাজ হওয়ার সময়, পাশে পেয়েছেন ব্রাহ্মণকে, যিনি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজকর দেওয়া চাই, যিনি বলেছেন রাজা হল ঈশ্বরের প্রতিনিধি। কাজেই সেই পুরোহিতের জন্য বরাদ্দ থাকত দান দক্ষিণা, আর তার ধর্মের জন্য যাবতীয় সুবিধে। সেই পুরোহিতের ধর্মই হত রাজধর্ম, সে হিন্দু শাক্ত হলে শাক্ত, শৈব হলে শৈব, বৈষ্ণব হলে বৈষ্ণব, জৈন হলে জৈন, বৌদ্ধ হলে বৌদ্ধ, ইসলাম হলে ইসলাম, খ্রিস্টান হলে খ্রিস্টান এবং প্রজাদের ওপর সরাসরিই আদেশ থাকত সেই ধর্ম পালনের। রাজারাই বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের পাঠাতেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিদেশেও। কিন্তু পুঁজির উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই এর আর কোনও প্রয়োজনীয়তাই থাকল না, কাজেই রাষ্ট্র হয়ে উঠল ধর্ম নিরপেক্ষ, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনও লেনাদেনা নেই। আনুষ্ঠানিকতা উঠে গেল? না তাও থেকে গেছে কিন্তু সেটাও টিকটিকির ল্যাজের মতোই। কিন্তু এটা তো হল পাশ্চাত্যে, ইউরোপে, আমেরিকায়। প্রাচ্যে পুঁজির তেমন বিকাশ হল না, পুঁজিও এল, সামন্তরাও টিকে থাকল, এক বকচ্ছপ রাষ্ট্র যে ধর্ম নিরপেক্ষ অথচ ধর্ম নিরপেক্ষ নয়। সেখানেই ওই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে? মানে হল ধর্ম নিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের ব্যবস্থা, এক মানুষ, ব্যক্তি মানুষ, যিনি কোনও এক বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী বা নাস্তিক তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ হবেন কীভাবে? মানুষ নয় ধর্ম নিরপেক্ষ হতে পারে রাষ্ট্র, এক ব্যবস্থা। আপনি হিন্দু, আপনি মুসলমান কিন্তু আপনি ধর্ম নিরপেক্ষ, তা আবার হয় নাকি। কিন্তু কিছু আইন কানুন, সংবিধান ইত্যাদির বলে এক রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষ হতে পারে, হয়।

এবং এইখানে এসেই আরএসএস-বিজেপি দাবার চাল দিয়েছে, রাষ্ট্রকে হিন্দু রাষ্ট্র হতে হবে, সেই রাষ্ট্র নাকি বাকি সমস্ত ধর্মের সঙ্গে ন্যায় করবে, এটাই ধর্ম নিরপেক্ষতা। কেন হিন্দু রাষ্ট্র? কারণ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু। আপনি যতবার খুশি ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলুন আদতে তো তা এক রাষ্ট্রের ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সরকারে যারা আছে তারা সেটাকে তাদের মতো ব্যবহার করবেই। একই আছে সংবিধান, ঠিক একই নয়, আদতে সংবিধানের প্রতিটি ছত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতা থাকলেও তখনও আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনাতে ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দটা নেই। সেই তখনই রাষ্ট্রের মাথায় বসে থাকা কংগ্রেস দল, দেশের প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্র মন্দির নির্মাণ করবে না, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও মন্দির নির্মাণে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা নেই আর আজ সেই একই সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই আছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। কিন্তু সাধুসন্তদের নিয়ে নতুন সংসদ ভবনে ধর্মদণ্ড প্রতিষ্ঠা করা হল, অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধন এক রাষ্ট্রের ইভেন্ট করে তোলা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ সরকার তার সরকারে ধর্ম সম্বন্ধীয় দফতরও খুলেছে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বলছেন, হনুমানের নাম করে ইভিএম-এর বোতাম চিপুন, নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ। কেন? কারণ ধর্ম নিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের এক ব্যবস্থা যা সরকারে আসীন ক্ষমতাসীন দল নিজেদের মতো করেই ব্যবহার করতে পারে, করছে। রাষ্ট্রের প্রতিটা ছোট বড় যন্ত্র এই রামমন্দির উদ্বোধনকে এক জাতীয় ইভেন্ট হিসেবে তৈরি করার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে, তারা যা যা করার তাই করছে। অনুগত সেবাদাস হিসেবে মিডিয়া এই ঘটনাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে প্রচার করছে। এই অবস্থায় আপনি কী করবেন? আপনার কাছে কী আছে যা দিয়ে আপনি একে রুখবেন? কোন অস্ত্র দিয়ে এই চক্রান্তের জাল কাটা যাবে?

আপনি বলবেন ধর্ম নিরপেক্ষতা, কিন্তু তা তো এক দলের কবজায়, সরকার তাদের, ব্যবস্থা তাদের। তাহলে আপনার হাতে বেঁচে রয়েছে সর্ব ধর্ম সমন্বয়। সমস্ত ধর্ম আদতে এক, তা মানুষকে শান্তি, সত্য আর সহাবস্থানের বাণী শোনায়, আসুন আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে থাকি। এই কথাগুলো বলা ছাড়া আপনার হাতে আর কীই বা আছে? মার্কসবাদ বোঝাবেন? লেনিনবাদ বোঝাবেন? আপনার কাছে আছে নানক, কবীর, রুইদাস, চৈতন্য, বিবেকানন্দ। ওঁরাই আপনার হাতিয়ার, ওঁদের কথাই বলতে হবে জনে জনে। বলতে হবে যত মত তত পথের কথা, নিয়ে যেতে হবে দক্ষিণেশ্বরে সেই জায়গাতে যেখানে রামকৃষ্ণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বলেছিলেন সেই একই ঈশ্বরকে দেখতে পাচ্ছি। নিয়ে যেতে হবে পিরের দরগায়, ব্যান্ডেল চার্চে, বলতে হবে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা, সহাবস্থানের কথা। এই কথাগুলো বলছি কেন? বলছি কারণ ২২ তারিখ রামমন্দির উদ্বোধন, এখন থেকেই তার প্রচার শুরু হয়েছে, আরএসএস–বিজেপি তো সেটাই চায়, সেটাই করছে। বিরোধীরা কী করবে? এক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই, সেটা তো বলবেই, কিন্তু তার সঙ্গে জরুরি সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা। বিজু পট্টনায়কের পুত্র এই সময়েই বেছে নিয়েছেন জগন্নাথ মন্দির করিডোর উদ্বোধনের জন্য, তিনি রামমন্দির যাবেন? যাবেন না? কিছুই বলেননি, তিনি জানেন ওড়িশায় রাম নয় জগন্নাথের আশীর্বাদ দরকার। দক্ষিণে হিন্দু ধর্মের এই ইভেন্ট কোনও দাগই কাটবে না। বিহারে সম্মিলিত বিরোধী দল বলেছে ওটা বিজেপির অনুষ্ঠান, নরেন্দ্র মোদি রামকে নিয়ে রাজনীতি করছেন করুন, আমাদের হৃদয়ে রামলালা আছে, আমরা ঘরে বসেই পুজো করব। উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস সমাজবাদী নেতাদের এক অংশ গতকালই সরযূ নদীতে চান করে রামলালার অগ্রিম দর্শন সেরে এসেছেন। অখিলেশ যাদব বলেছেন, সব চুকে গেলে শান্তিতে রামলালার দর্শন করব। বাবরি মসজিদ ভাঙার অন্যতম কারিগর শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরে যাবেন ২২ তারিখে আরতি করার জন্য, রাষ্ট্রপতিকেও আমন্ত্রণ করেছেন। কেন? কারণ রাষ্ট্রপতি অযোধ্যায় উদ্বোধনে আমন্ত্রিত নন। আর বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই দিন কালীঘাটে যাবেন, পুজো দেবেন, তারপর মিছিল করে বিভিন্ন মসজিদ আর চার্চ ঘুরে যাবেন পার্ক সার্কাসে। হ্যাঁ, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা বলতে, এই সময়ে যা বেশি জরুরি। আমি হিন্দু, কিন্তু আমি সমন্বয়ের কথা বলছি, আমি মুসলমান কিন্তু আমি সমন্বয়ের কথা বলছি এই সম্প্রীতির কথা যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই একমাত্র বিজেপির এই সর্বগ্রাসী হিন্দুত্বের প্রচারের হাত থেকে বাঁচা যাবে। আমরা রবি ঠাকুরের কথা বলব, মানবিকতার কথা বলব, আমরা চৈতন্য, কবীর, নানক, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের কথা বলব, বিজেপির বিষাক্ত প্রচারের বিরুদ্ধে সেটাই হতে পারে সঠিক জবাব।

RELATED ARTICLES

Most Popular