Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeBig newsমৃত্যু তুচ্ছ, মানবজমিনে রশিদের কণ্ঠ অমর

মৃত্যু তুচ্ছ, মানবজমিনে রশিদের কণ্ঠ অমর

১ জুলাই ১৯৬৮- ৯ জানুয়ারি ২০২৪

Follow Us :

‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী…’। চোখ বুজে তাঁর গান শুনলে মনে হবে যেন কোনও পর্বতের নির্জন গুহায় বসে কেউ ঈশ্বরকে গান শোনাচ্ছেন। আর তিনি অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছেন। কারণ সুরসাধক রশিদ খানের ঘরানার বিশেষত্ব হচ্ছে মাঝারি-ধীর গতি, গম্ভীর-উদাত্ত কণ্ঠ। তাই তিনি যখন মঞ্চে গাইতেন, মনে হতো কোন সুদূরের বাণী কানে এসে বাজছে।

রশিদ খান। ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই জন্ম। কলকাতা থেকে বহু দূর উত্তরপ্রদেশের বরেলির কাছে বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার শাকিল বদায়ুঁর নামে রয়েছে বদায়ুঁ নামে একটি গ্রাম। এই গ্রামেই রশিদ খান জন্ম নেন। তাঁর পিতা হামিজ রেজা খান ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ আর মা শাখরি বেগম ছিলেন গৃহিণী। ভালো করে চোখ খোলার আগে ভোররাত থেকে যাঁর কানে ভেসে আসত রাগ-রাগিণীর ঠাট। প্রথমে বাবা হামিজ রেজা খানের কাছে এবং পরবর্তীতে দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবের কাছে তাঁর প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা সম্পন্ন হয়।

আরও পড়ুন: প্রয়াত বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী রশিদ খান

তাঁদের পরিবারের নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানা ছিল। রামপুর-সহসওয়ান নামের এই বিখ্যাত ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আরেক বরেণ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ এনায়েত হুসেন খান। রশিদ খানের কাকা উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খানও সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন।

ছোটবেলাতে রশিদ ছিলেন খুব চঞ্চল আর দুরন্ত। গানের নিয়মিত চর্চার চেয়ে ফুটবল খেলাতেই ছিল তাঁর বেশি মনোযোগ। কিন্তু তাঁর দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কঠোর নিয়মকানুন আর অনুশাসনে নিয়মিত গান শিখতে হতো। রশিদ বলেছেন, ওই ছোট বয়সে সবসময় গানবাজনা ভালো লাগত না। মন পড়ে থাকত ফুটবল, ক্রিকেটে। বর্ষায় কাদা মেখে ফুটবল খেলে এসে রেওয়াজে বসে পড়তাম। রেওয়াজে বসতে দেরি করলেই বকাবকি অবধারিত। রামপুর সহসওয়ান সঙ্গীত ঘরানাটা বেশ কঠিন। একটা তান নিয়ে সারা দিন ধরে রেওয়াজ করে চলেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যতক্ষণ সুরটা ঠিক জায়গায় না লাগছে, ততক্ষণ চলত রেওয়াজ। সেটা হতে পারে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত।

মাত্র ১১ বছর বয়সে রশিদ খান মঞ্চে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি দাদুর হাত ধরে কলকাতা আইটিসি সঙ্গীত অকাদেমিতে আসেন এবং এখানেই তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে তিনি পরিপূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। পণ্ডিত ভীমসেন জোশি তাঁকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছেন। তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি বলেছেন, পণ্ডিতজির সঙ্গে আমার এক মঞ্চে অনুষ্ঠানের সুযোগ আসে। উনি আমাকে প্রচুর উৎসাহ ও আশীর্বাদ দেন। পণ্ডিত ভীমসেন জোশিও আমায় ভীষণ স্নেহ করতেন এবং একসঙ্গে অনুষ্ঠান করার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার।

তিনি ইন্দোর ঘরানার প্রবাদপুরুষ উস্তাদ আমির খান ও পণ্ডিত ভীমসেন জোশির গায়কীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর গায়কীতে এই দুই মহারথীর প্রভাবও সুস্পষ্ট। ভাবগাম্ভীর্যময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে অন্যান্য লঘু সঙ্গীত ধারার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি বেশ কিছু চমৎকার গবেষণাধর্মী সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। আমির খুসরোর “নায়না পিয়া সে” গানটিকে তিনি সুফি ঢঙে গেয়েছেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের এক নতুন ধারার সৃষ্টি করতে লুই ব্যাংকসের সঙ্গে যুগলবন্দি করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মানুষ হলেও তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। নচিকেতার সঙ্গে গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ কিছু যুগলবন্দি।

আম ভারতীয়র সঙ্গে রশিদ খানের ফিল্মি গানের পরিচয় ঘটে ‘জব উই মেট’ সিনেমার ‘আওগে জব তুম ও সজনা’ গানটি দিয়ে। ২০০৭ সালে এই গানটি হিট করার পর সাধারণ মানুষের বুকে বেদনার মতো তরঙ্গ তোলে এর সুর ও গায়কী। এক সাক্ষাৎকারে ছবির সঙ্গীত পরিচালক সন্দেশ শাণ্ডিল্য জানিয়েছিলেন, এই ছবির জন্য লেখাই হয়নি এই গান। এই গান ছবি তৈরির বহু বছর আগেই জন্ম নিয়েছিল। এই গানের সুর হঠাৎই এসেছিল মনে। আমি রেকর্ড করে রেখেছিলাম। বহু বছর পরে আমি যখন তাঁর কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেলাম, তিনি প্রচুর টাকা চেয়ে বসলেন। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, এটা আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। একই সঙ্গে বলেছিলাম, আপনি এই গানটি ফেরাতে পারবেন না। আপনি মানা করতে পারবেন না, কারণ আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। তখন উনি খুশি হয়ে বলেছিলেন, ঠিক আছে, চলে এসো, আমি রেকর্ড করব।

গত ২ ডিসেম্বর ছিল রশিদ খান ও তাঁর স্ত্রী সোমা খানের ৩২-তম বিবাহবার্ষিকী। ৩০-তম বিবাহবার্ষিকীতেও খুব আনন্দ-হইহুল্লোড় হয়েছিল। একটি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একসঙ্গে ৩০টা বছর কাটিয়ে ফেলেছি আমি ও সোমা। দিনটা উদযাপন করতে অনেকেই এসেছিলেন আমার বাড়িতে। সকলেই খুব গুণী শিল্পী। অনেক গানবাজনা হয়েছে। মজা করেছি। খাওয়াদাওয়া হয়েছে। অনেক তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিয়েছিলাম আমরা। ২২-২৩ বছর বয়স ছিল তখন। আমাদের অ্যারেঞ্জ-লাভ ম্যারেজ ছিল। ওকে একটাই কথা বলতে চাই, কাটিয়ে দিলাম ভালো করে। নিমন্ত্রিতদের একজন বিখ্যাত কবি শ্রীজাত একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘গানের মেজাজ ধার করি আর ভালবাসাও শিখি…আড্ডা চলুক, আজ দু’জনের বিবাহবার্ষিকী।’

এক অর্থে অজাতশত্রু ছিলেন রশিদ খান। তিনি যে আর নেই তা যেন মানতে পারছেন না বর্ষীয়ান শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। একটি সংবাদ মাধ্যমে বললেন, আমি কিছু বলার অবস্থায় নেই। রশিদ আমার ভাই ছিল। ভাইফোঁটা দিতাম ওকে। শেষবার দেখাটুকুও হল না।

রশিদ খানের পদ্মভূষণ পাওয়ার সুসংবাদে উস্তাদ আমজাদ আলি খান বলেছিলেন, আজ আমার খুশির সীমা-পরিসীমা নেই। কত ছোটবেলা থেকে ওকে দেখছি, ওর গান শুনছি। রশিদ আমাকে চাচা বলে ডাকে। আবার ওর যে গুরু ছিলেন, সেই উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাব আমার বাবাকে চাচা বলে ডাকতেন! এইভাবে আমাদের সম্পর্ক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।

রশিদ খানকে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় কণ্ঠশিল্পীর মুকুট পরিয়েছিলেন খোদ আমজাদ। বলেছিলেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে ওর উপরে। মা সরস্বতী যেন সাক্ষাৎ ওর গলায় ভর করে রয়েছেন! ওর কণ্ঠে বড়ই আকর্ষণ, আবেগ এবং আবেদন। তা সে খেয়াল, ঠুমরি, ভজন যাই গাক না কেন।

আজ রশিদ খান নেই এটা ধ্রুবসত্য। হয়তো অকালে তাঁকে ঈশ্বর নিয়ে চলে গেলেন তাঁর জলসায় গান গাওয়াবেন বলে। কিন্তু, মানবজমিনে তাঁর সুর অনুরণিত হতে থাকবে চিরকাল। কারণ ইসলামিক অর্থে রশিদ মানে জ্ঞানী বা বিজ্ঞ। হিন্দুস্তানি সঙ্গীতে তাঁর যে সাগরসমান জ্ঞান তা আজীবন দুলিয়ে রাখবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শ্রোতাদের।

অন্য খবর দেখুন

RELATED ARTICLES

Most Popular