হঠাৎ যদি ঘুম ভাঙায় কেউ
স্বপ্ন শেষের আগে
মুখখানা তুই এমনি করবি
যেন প্যাঁচা লাগে
নালিশ শেষে ঐ শালাকে
দিবি আমায় তুলে
ঘুম ভাঙানোর অপরাধে
চড়াবো তাকে শূলে
(পরাণের ভাই কুম্ভকর্ণকে নাকি এমনি বলেছিল দাদা রাবণ)
কথায় বলে, রাবণের রাগ। ভাইকে প্রবল ভালবাসতেন। কুচুমুচু করে আদরে ভরিয়ে রাখতেন ভাই কুম্ভকর্ণকে। আর গাবদা পেট, ভক্ষণে সুপটু ব্যাটা কালো কুচকুচে কুম্ভকর্ণও নাকি দাদাকে পেল্লায় ভক্তিচ্ছেদ্দা করত। কথায় কথায় নাকি কাঁদত। নাকি-কান্না। মানে, ওই ন্যাকা কান্না আর কী! চোখের সঙ্গে টসটস করে গড়াত নাকের জলও। সেই জলে নাকি আস্ত একটা সমুদ্রের জন্ম। কারা যে সব এসব ফুক্কুরি কাটে কে জানে! জোকার না জুকের কে একটা লোক আছে না, কী সব বানিয়েছে, সেখানে মুখ আর বুক সব সমান। ফেরেসবুক না কী যেন বলে! বলিহারি ঢং। একটা জুতসই সাবজেক্ট পেলেই হল। মেটায় আদিখ্যেতার বন্যা। নদী উপচে, সাগর উপচে যে বান আসে, তেমনই বান। আদিখ্যেতার বান। আদিঅন্ত কিস্যু নাই। শুধু চ্যাংড়ামো আর ফাজলামো। সেখানেই সব বিদঘুটে পাজি হতচ্ছাড়ারা কুম্ভকর্ণের ঘুম নিয়ে ধ্যাস্টাতে ধ্যাস্টাতে টঙে তুলেছে আঁতলামো। ব্যাটা কুম্ভকর্ণ কোন ছুন্দরীর স্বপ্ন দেখছিল কে জানে। তাকে নাকি ফ্লাইং কিস্সিও দিচ্ছিল। কেন রে বাপু, রাক্ষস বলে কি পেরেম করতেও নেই। তা, সেই স্বপ্ন-পেরেমে নাকি অ্যামন চাটা চেটেছিল ইন্দ্র, কুম্ভকর্ণের ঘুম নাকি ছমাস আগে ভাঙতই না। হেব্বি বীর ছিল সে। রাম-রাবণের যুদ্দে নাকি বেজায় বেগ দিয়েছিল দেবতাদের। পাজি হতচ্ছাড়ার মজা দেকাচ্চি বলে নাকি ভেংচি কেটেছিল লক্ষ্মণ। দেবতাকুলের মাতব্বর ইন্দ্র নাকি প্রবল ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে একসা হয়েছিল। কুম্ভকর্ণের দৈত্যের মতো শক্তি। আর ইন্দ্রের টিংটিঙে শরীর। পাঞ্জায় কী আর এঁটে ওঠা চাড্ডিখানি কথা, বস। ব্যস, অমনি প্যাঁচ কষা স্টার্ট। দেবী সরস্বতীর কাছে হত্তে দিয়ে পড়ল ইন্দ্র। বিদ্যের দেবী সরস্বতীও কুম্ভকর্ণের জিভে এমন মোক্ষম ঠোকা ঠুকল যে, আলটাকরা, দাঁত, মাড়ি সবখানে জিভ আটকে একসা। কথা বলতে গেলেই তোতলানো শুরু। “ই’’-কে বলে “নি’’। দেবতাকুলের তো পোয়া সাড়ে বারো। প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে কুম্ভকর্ণ যখন ইন্দ্রাসন বর চায়, ব্রহ্মা সেটাকে নিদ্রাসন ভেবে বসেন। তারপর থেকে কুম্ভকর্ণ টানা ছমাস ঘুমিয়ে থাকত। অল্প সময়ের জন্য ঘুম ভাঙত। তারপর আবার নিদ্রাদেবীর কোলে সটান শয়ন। এমন বিশাল এক বীর, জীবনভর কাটিয়ে দিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। ভাবা যায়! রামায়ণে নাকি লেকা আছে, রামের সঙ্গে রাবণের কুলিয়ে উঠতে না পারার অন্যতম কারণ কুম্ভকর্ণের ওই দুদ্দাড় ঘুম। কালের পরিক্রমায় বাংলা বাগধারাতেও ঢুকে পড়ে ওই ঘুম। কারও ঘুম ভাঙতে দেরি হলেই বলি, কুম্ভকর্ণের ঘুম। ব্যাটা রাবণের ভাই শুধু ঘুমিয়েই বিখ্যাত হয়ে গেল মাইরি। এ কালের বহু রাবণ আড়ালে-আবডালে অনেক আঁতেলামো মার্কা বুলি কপচায়, কী দারুণ পরিহাস। এমনতরো অজেয় বীর বাগধারায় পরিহাসের পাত্র হয়ে কাটিয়ে দিল আজন্মকাল।
পুরাণ বলে, কুম্ভকর্ণের আক্ষরিক অর্থ কুম্ভ অর্থাৎ কলসির মতো কর্ণ অর্থাৎ কান৷ হিন্দুপুরাণ রামায়ণে কুম্ভকর্ণকে রক্ষকুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাঁর বিরাট দানবাকৃতি চেহারা এবং খাদ্যাভ্যাসের অস্বাভাবিকত্ব সত্ত্বেও তাঁকে সুচরিত্র এবং দক্ষ যোদ্ধা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও তিনি রাম-রাবণ যুদ্ধের এক পর্যায়ে নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য বহু বানরসৈন্যকে হত্যা করেন৷ আলবেনীয় ভাষায় কুম্ভকর্ণ চরিত্রটি জেতুর নামে পরিচিত৷ ভাগবত পুরাণ মতে, কুম্ভকর্ণ ছিলেন বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক বিজয়ের অবতার৷ জয় ও বিজয় শ্রীবিষ্ণুর পবিত্র বৈকুণ্ঠদ্বার রক্ষার সময় চতুর্কুমারের দ্বারা শাপগ্রস্ত হন৷ তাঁরা প্রাথমিকভাবে অমর বরপ্রাপ্ত হলেও বিষ্ণুর সহকারী হিসাবে আত্মসমর্পণের পর তিনিই এই বর স্খালনে সচেষ্ট হন৷ তিনি বিজয়কে বলেন যতদিন না তিনি তাঁদের আসার অনুমতি দিচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত মর্ত্যলোকে তিনবার তিনি বিষ্ণুর অবতারের শত্রুপক্ষের সদস্য হিসাবে জন্মগ্রহণ করবেন৷ তাঁদের তিনটি পূর্ব নির্ধারিত জন্মের দ্বিতীয় জন্মে জয় রাবণ হিসাবে এবং বিজয় তাঁর ভাই কুম্ভকর্ণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন৷
রাম-রাবণের যুদ্ধে এই কুম্ভকর্ণ বানররাজ সুগ্রীবকে অবচেতন করে দেন। এবং বানরকুলের সংহার করতে সক্ষম হন৷ তবে শেষ পর্যন্ত তিনি রামের হাতে নিহত হন৷ যখন রাবণ তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পান, তখন তিনি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং নিজেকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত হিসেবে জাহির করেন৷ কুম্ভকর্ণ ও তাঁর প্রথম পত্নী বজ্রমালার কুম্ভ ও নিকুম্ভ নামে দুই পুত্রসন্তান ছিল। দুজনেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন৷ পুরাণ মতে, কুম্ভকর্ণ সহ্যাদ্রির ডাকিন্যা অঞ্চলের (বর্তমান ওড়িশা) রাজকুমারী কর্কটীকেও বিয়ে করেন। তাঁদের ভীমাসুর নামে একটি পুত্রসন্তান হয়৷ স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে কর্কটী রামের প্রতি প্রতিশোধ না নিয়ে বরং ভীমাসুরকে আদেশ দেন যেন সে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করেন এবং অমরত্ব লাভ করেন৷ তবে তাঁর আশা পূরণ হয়নি। তপস্যা অসমাপ্ত অবস্থায় ভগবান শিবের হাতে ভীমাসুর নিহত হন৷
সেই মহাবীর কুম্ভকর্ণের কেলোর কীর্তি ঘুম নিয়ে সামাজিক মাধ্যেমে যতই অসামাজিক আলোচনা তেড়েফুঁড়ে উঠুক, ঘুমের প্রয়োজন নিয়ে কিন্তু বিস্তর খিল্লি সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে। পেঁচিয়ে পাঁচতারা করে কুম্ভকর্ণের ঘুমের যদি ব্যাখ্যা-বুলি আর ইংলিশ ঝাড়া যায়, তাহলে দাঁড়ায় সাউন্ড স্লিপ। এমন ঘুম, যার বিরতি নেই। গভীর ঘুম। প্রশান্তির ঘুম। দেহ-মন ঝরঝরে করে দেওয়া ঘুম। নিরবচ্ছিন্ন ঘুম। না-হলে দেহ-মনের ঘ্যাঁচাং ফু। বসন্তের যে সময়ে দিন-রাত সমান হয়ে যায়, তার ঠিক আগের শুক্কুরবার ঘুম দে-র জন্য নির্ধারিত। কী আদখেলেপনা রে বাবা। হাগ দে, জাপটে দে, কড়কে দে, কিস দে। এখন আবার ঘুম দে। মানে, এই দিনটা ঘুমোও আর বাকি ৩৬৪ দিন জেগে শত্তুরের শাপশাপান্ত করো।
তবে, তা যে হচ্চে, তা ভাবাটা স্রেফ কল্পনা-বিলাস। কারণ, ইশকুলেই শুনেছি পণ্ডিতমশাইয়ের নাসিকা গর্জন। এ কালের শিক্ষকরাও অবশ্য সময় পেলেই ঘুমিয়ে পড়েন ক্লাসরুমে। আমার প্রাইমারি স্কুলের বৃন্দাবন স্যরকেও নাক ডাকতে দেখেছি। তাতে অবশ্য বিদ্যা আহরণে খুব একটা ঝক্কি হয়নি। দুটো তেলমাখানো আস্ত বেত রাখা থাকত টেবিলে। ঘুমন্ত বৃন্দাবন স্যরের বদলে ওই দুখানা বেত্রশলাকা আমাদের পাহারায় রাখত। এ দেশের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা প্রজাতন্ত্রের গরিব কর্মচারী। লবণ আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ফলে, স্কুলে পাঠদানের বাইরেও রোজগারের ফন্দি-ফিকির করতে হয়। তার মধ্যে সকালের হালকর্ষণ থেকে শুরু করে রাতভর ধান মাড়াই পর্যন্ত রয়েছে। সুতরাং ক্লাসরুমে তাঁদের একটু আধটু ঝিম ধরে যায়। কিন্তু দেশের কোনও কোনও জনপ্রতিনিধি যখন সংসদের কক্ষদ্বয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং সশব্দ নাসিকা গর্জনে নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণ দেন, তখন একটু নড়ে বসতে হয় বইকি!
আমরা নড়ে বসি। আমাদের দৌড় ওই ওইটুকুই। আমরা শুধু ভাবতে পারি, আহা, রাজনীতিক! আহা আমাদের অভিভাবক, দেশের মাঝিমাল্লা। দেশের কথা, জনগণের কথা ভাবতে ভাবতে বেচারারা শুদ্ধ ঘুমের সময়টুকু পান না। জনসমক্ষে ঝিমিয়ে পড়েন। এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কতই না ভাগ্যবান। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে রাজার নীতি নির্ধারকরা ঘুমোবেন, নাক ডাকবেন, কানে তেল দিয়ে প্রজাদের অভাব-অভিযোগ ফুত্কারে ওড়াবেন, এ আর এমন কথা কী! ফেলো কড়ি, মাখো তেল, তুমি কি আমার পর, এই নীতিতে বিশ্বাসী রাজনীতির কুশীলবরা যখন হাত পেতেই থাকেন, না হলে বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে খুল্লামখুল্লা লেনদেনে লিপ্ত হন, তখন আম নাগরিককে তো জাগতেই হয়। আড়ংধোলাই-ই আসল ওষুধ। কিন্তু মুশকিল হল, আম নাগরিকও কি জাগছে, নাকি রাজনীতিকদের কৌশলী চালে তারাও এ কালের কুম্ভকর্ণ হয়ে মড়ার ঘুম ঘুমাচ্চে। আর জনপ্রতিনিধিরা মটকা মেড়ে পড়ে থাকছে। তবে ঘুম দিবস পালনে বাকি সক্কলকে তেড়ে গোল দিয়েছে বেঙ্গালুরুর একটা কোম্পানি। ঘুম দিবসে কর্মীদের সারপ্রাইজ ছুটি। নাকে-কানে তেল দিয়ে ঘুমোন, আসতে হবে না অফিসে। কর্মীদের কড়া নির্দেশ। পেশাদারদের সোশ্য়াল মিডিয়া লিঙ্কডইনে একটা বেমক্কা পোস্ট। 17 মার্চ সব কর্মচারী ছুটি নিতে পারেন। ওয়েকফিট নামের সংস্থাটি জানায়, এই দিনটি কর্মীদের শুধু ঘুমের জন্যই ছুটি দেওয়া হচ্ছে। হাজার একটা কাজের মাঝেও ঘুম বেশ জরুরি। তাই একটি দিন শুধু ঘুমের দিন! ওয়েকফিট সলিউশন একটি ডি২সি (অর্থাৎ সরাসরি ক্রেতাদের পরিষেবা প্রদানকারী) সংস্থা। বাড়ির আসবাবপত্র বিক্রি করে। বেশ জনপ্রিয়। ১৫ মার্চ ওয়েকফিট কর্মীদের একটি মেইল পাঠায়। সেখানেই জানায়, বিশ্ব নিদ্রা দিবস উপলক্ষে বিশ্রামের জন্য ওয়েকফিটের সব কর্মীকে ২০২৩-এর 17 মার্চ ছুটি দেওয়া হল। মেইলে লেখা হয়, এই দিনটিকে একটি বিকল্প ছুটির দিন হিসেবে ধরা হচ্ছে। অন্যান্য ছুটির দিনের মতোই এই দিনটির ছুটি পেতে এইচআর পোর্টালে আবেদন করা যাবে। অর্থাত্ শুক্কুরবার ছুটি নেওয়া মানে লম্বা ছুটি। কিন্তু ঘুমের জন্য আপিস ছুটি, ব্যাপারটা মন্দ নয়।
দশটা-পাঁচটার কেরানি-সকল, ছুটি নিয়ে ঘুমোন, কোম্পানি ব্যবস্থা করে দিয়েছে, কিন্তু আপনাদের সামাজিক রক্ষাকর্তারা জেগে আছে তো, না হলে ঘেঁটি ধরে তুলে দিন আর বলুন, হে বীরপুঙ্গব, এ কালের কুম্ভকর্ণসকল, জেগে ঘুমোবেন না। গনগনে আগুনেমার্কা ইস্যুগুলো ঝালিয়ে নিন। শুধু বাক্সপ্যাঁটরাভর্কি ভোট পেলেই তো হবে না। বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীফন্ত্রী হলেই তো হবে না। আমাদের দুঃখুদুদ্দশার করুণ কাহিনি তো আপনাদেরই শুনতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও শোনাবই। আমি কৃষক, আমি কুলি, আমি শ্রমিক, আমি মুচি, আমি মেথর, আমাদের নিশ্চিত ঘুমের দায়িত্ব তো আপনাদেরই নিতে হবে। দরকারে আপনাদের ঘুম কমান। আমরা ঘুমোচ্চি কি না, খোঁজ নিন। অনেক হয়েছে ঘুম, এবার জাগুন। না হলে পরের ভোটে লে ছক্কা!
[ বি. দ্র : কুম্ভকর্ণ সংক্রান্ত অংশ নেহাতই কল্পনা-বিলাস, হাস্যরসের জন্য বানানে কিছু রদবদল তাই ইচ্ছাকৃত ]