কিছু প্রেম চিরকালীন। প্রেমে জোয়ারভাটা থাকে। রোমান্টিকতার ঢেউ থাকে। অভিমানের অভিঘাত থাকে। কিন্তু বাঁধনটা ছেড়ে না। আর সেটা যদি ছোটবেলার প্রেম হয় তবে তো পুরো জমে ক্ষীর। দু’জন দু’জনের মুখ দেখলেই বুঝে যান কে কী চাইছেন। কোনটা রাগ আর কোনটা অভিমান সেটা বোধহয় কথায় প্রকাশ করার দরকারই পড়ে না। অনুরাগ বা প্রেমের প্রকাশভঙ্গি পাল্টে যায় সময়ের সঙ্গে। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এবং আঁকড়ে থাকার আকুতি বুঝি একই রকম থাকে।
সেই প্রেম শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় আগে। এক কিশোর তার পাশের বাড়ির কিশোরীকে ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। পায়ে ঘুঙুর, মুখে বোল, হাতে নাচের মুদ্রা। সেভাবেই কিশোর তার জীবনসঙ্গীকে প্রথম দেখেছিল। আর কিশোরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল প্রতিবেশী দুরন্ত কিশোর মত্ত ফুটবল বা ক্রিকেট নিয়ে। অথবা শরীরচর্চা। দুই বাড়ির মধ্যে একসময় যোগসূত্র থাকলেও তখন তা বৈষয়িক কারণে ফিকে হয়ে আসছে। অন্যদিকে গভীর হচ্ছে তুই কিশোর-কিশোরীর পারস্পরিক টান। অনুরাগের সেই অঙ্কুরকে আলো-জল দিয়ে বাড়তে সাহায্য করেছিল বাড়িতে রাখা কালো রঙের ডায়াল-সহ একটা টেলিফোন।
এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেক অনেক জল বয়ে গেছে। জীবন থেকে চলে গেছে ল্যান্ডলাইন। জীবনে এসেছে পাশের বাড়ির সেই মেয়েটা– ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়, সেদিনের কিশোরের পত্নী হিসেবে। গাঙ্গুলি পরিবারের সবথেকে আদরের ছোটবৌ। আর সেদিনের সেই কিশোর জীবনে পেয়েছেন সব কিছু — হ্যাঁ, যা যা চেয়েছিলেন সবকিছু। ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য, অধিনায়ক এবং সবথেকে বড়ো কথা, ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছেন একেবারে প্রথম সারিতে। রেকর্ডের কথা নাই বা শোনা গেলো। ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েও ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আসীন তিনি।
আর এই পথে সৌরভ পাশে পেয়েছেন ডোনাকে। চিরদিন। সবসময়ের জন্য। আগলে রেখেছেন যেমন, তেমনি চ্যাপেল অধ্যায়ে জুগিয়েছেন সাহস, আস্থা। মাসের পর মাস বিলেতে থাকার সময়ে নিজে রান্না করে খাইয়েছেন। এই সেদিনও শরীর খারাপ নিয়ে মহারাজ হাসপাতালে ভর্তি হলে রাত জেগেছেন কেবিনে। আসলে আজীবন পাশে থাকার ভরসাটা যে কৈশোরেই ডোনা দিয়ে দিয়েছিলেন টেলিফোনে কথোপকথনের সময়ে।
আজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। কোনওদিনই নিজের কোনও অনুষ্ঠানে আড়ম্বর পছন্দ করেন না মহারাজ। অতএব সানার আবদারে কেকে ছুরি চালানো, এক টুকরো মুখে দেওয়া। আর দুপুরে রোজকার নিয়ম মেনেই মাছভাত। একসময় পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব যাঁর ছিল প্রিয় খাবার, সেই মহারাজ এখন মাংস ছুঁয়েও দেখেন না। আপ্রাণ চেষ্টা করেন সুস্থ থাকতে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো ব্যক্তিগত জীবন কাটাতে।
কিন্তু এ-সব দিনেই বুঝি মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। স্মৃতি বুঝি অতীতের পাতাগুলোকে একবার চোখের সামনে তুলে ধরে। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় কলেজ জীবনের জন্মদিনের কথা। বন্ধুবান্ধব, হইচই, পার্টির মাঝেও একটা ফোনের অপেক্ষা। হয়তো মামুলি দু চারটে কথা। কিন্তু সেই রেশ আজও যেন মনের মণিকোঠায় দাগ ফেলে যায়।
কেক কাটার পর স্বাভাবিক গাম্ভীর্য বজায় রেখেই ডোনা সৌরভকে একটি ফোন উপহার দেন। শুধুই কি একটা উপহার মাত্র? শুধুই কি একটা ফোন? নাকি স্মৃতিবিস্মৃতিকে টান মেরে জন্মদিনে সামনে নিয়ে আসার একটা অনুরাগী প্রয়াস? একটা উপহার যেন গন্ধ নিয়ে আসে সেই ৩৩ বছরে আগের ল্যান্ডফোনের। কত স্মৃতি, কত জীবনকাহিনি। প্রথম সবকিছু। ফোন হাতে পেয়ে সৌরভের প্রশ্ন ‘প্রথম ফোনটা কাকে করব’?