১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক্সের কথা মনে আছে? ব্রোঞ্জ জয়ী লিয়েন্ডার পেজ (Leander Paes) পিঠে তিরঙ্গা নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত মনে মনে আওড়াচ্ছেন। যতজন ভারতীয় সেইসময় আটলান্টা টেনিস কোর্টে হাজির ছিলেন তাঁরাও একই সুরে তাল মেলাচ্ছিলেন- ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা…’। বলা বাহুল্য, ভারতীয় টেনিস ইতিহাসের ভীষণ তাৎপর্য বহন করছে এই দৃশ্য। কারণ এই দৃশ্যই অনুপ্রাণিত করেছিল সেইসময়ের খুদে টেনিস প্রতিভাদের। তাঁরই মধ্যে একজন হায়দরাবাদের সানিয়া মির্জা (Sania Mirza)। মুম্বইতে জন্মালেও তাঁর টেনিসে হাতে খড়ি নিজাম শহরেই। পরবর্তীতে এই সানিয়াই হয়ে ওঠেন ভারতের সর্বকালে সেরা মহিলা টেনিস তারকা। ক্লে কোর্ট বা গ্রাস কোর্টে সানিয়ার ব্যাকহ্যান্ড বা ফোরহ্যান্ড ম্যাজিকের মূর্ছনায় দুলেছে আসমুদ্রহিমাচল। স্টিরিয়োটাইপ থেকে হয়ে উঠেছেন এক ব্যতিক্রমী। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক টেনিস কেরিয়ারের যবনিকা টানেন সানিয়া মির্জা। দুবাইয়ে দু’দশকের কেরিয়ারের শেষ ব্যাটলে পরাজিত সানিয়া। কিন্তু এই হার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না ভারতীয় টেনিস সুন্দরীকে। ডন ব্র্যাডম্যানও তাঁর শেষ ইনিংসে শূন্য করেছিলেন। শেষ ইনিংসের ব্যর্থতা কখনওই তাঁর ক্রিকেটীয় আভিজাত্যকে খর্ব করে না। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য ভারতের সর্বকালের সেরা মহিলা টেনিস তারকা সানিয়া মির্জার ক্ষেত্রেও। আজ একবার যাওয়া যেতেই পারে ফ্ল্যাশব্যাকে। নস্ট্যালজিয়ায় ডুব দিতেই পারেন সানিয়া-অনুরাগীরা।
• অস্ট্রেলিয়ান ওপেন মিক্সড ডাবলস-
২০০৯ সালে মহেশ ভূপতিকে সঙ্গী করে ঐতিহাসিক অস্ট্রেলিয়ান মিক্সড ডাবলস খেতাব জেতেন সানিয়া মির্জা। ২০০৮ এ মেলবোর্ন পার্কে হোঁচট খাওয়ার পর কঠোর হোমওয়ার্ক করে সানিয়া-মহেশ জুটি। নিখুঁত গেমপ্ল্যানে দুজনেই হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। ফলস্বরূপ পরের বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগে অবধি একটিও সেট হারেনি সানিয়া-মহেশ জুটি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে কানাডিয়ান জুটি আলেকজান্দ্রা ওজনিয়াক এবং ড্যানিয়েল নেস্টরের বিরুদ্ধে প্রথম সেট(৩-৬) হারেন। এরপর দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন। কানাডিয়ান জুটিকে পরাস্ত করেন এবং প্রবেশ করেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেমিফাইনালে। শেষ চারের লড়াইতে হারায় চেক জুটি বেনেসোভা এবং লুকাসকে। যথারীতি ফাইনালেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন এই ভারতীয় জুটি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন মিক্সড ডাবলস খেতাব জিতে সানিয়া মির্জা জানিয়েছিলেন, ‘গ্র্যান্ড স্লাম জেতার স্বপ্ন ছিল বহুদিনের। আজ সেই স্বপ্ন সত্যি হল। এটা আরও স্মরণীয় হয়ে থাকবে কারণ যাকে সঙ্গী করে এই গ্র্যান্ড স্লাম জিতলাম তিনি আমার বহুদিনের পরিচিত এবং ভীষণ পছন্দের একজন।’
• ২০১২ ফরাসি ওপেন মিক্সড ডাবলস-
শুধু ২০০৯ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন মিক্সড ডাবলস খেতাব জিতেই থেমে থাকেননি সানিয়া-মহেশ জুটি। রোলাগারোয় ক্লে কোর্টে ভারতীয় মিক্সড ডাবলস জুটির মুন্সিয়ানার সাক্ষী টেনিস বিশ্ব। ২০১২ সালের ফরাসি ওপেনে সপ্তম বাছাই হিসেবে প্রবেশ করে সবাইকে অবাক করে দেয় এই ভারতীয় জুটি। ফাইনালে পোলিশ-মেক্সিকান জুটিকে পরাস্ত করে স্ট্রেট সেটে। ফলাফল ৭-৬, ৬-১। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পর এটি ছিল তাঁদের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্লাম মিক্সড ডাবলস খেতাব।
• ২০১৪ ইউএস ওপেন মিক্সড ডাবলস-
ইউএস ওপেনে ব্রাজিলের টেনিস তারকা ব্রুনো সোরসের সঙ্গে জুটি বাঁধেন সানিয়া মির্জা। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে টাইব্রেকারে পরাজিত করেন ইউএসএ-র আবিগেইল স্পিয়ার্স এবং মেক্সিকোর সান্তিয়াগো গোঞ্জালেজকে।
• সান্টিয়ানা (সানিয়া মির্জা-মার্টিনা হিঙ্গিস জুটি)-
২০১৫ সালে মার্টিনা হিঙ্গিসের সঙ্গে জুটি বাঁধেন সানিয়া মির্জা। আর এই জুটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে টেনিস দুনিয়া তাঁদেরকে সম্বোধন করতে থাকেন ‘সান্টিয়ানা’ বলে। এই জুটি পর পর তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম খেতাব জেতে। ২০১৫ সালের উইম্বলডনে কোনও সেট না হেরে ফাইনালে প্রবেশ করে সান্টিয়ানা। পরে তিন সেটের রুদ্ধশ্বাস ফাইনালেও বাজিমাৎ করে সানিয়া-মার্টিনা জুটি। সান্টিয়ানা-র এই ফর্ম দেখা যায় পরবর্তী দুটি গ্র্যান্ড স্লামেও। ২০১৫ ইউএস ওপেন এবং ২০১৬ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মহিলা ডাবলস জেতে সানিয়া-মার্টিনা জুটি।
• ক্রমতালিকায় সানিয়া-
২০১৫ সালে WTA ডাবলস ক্রমতালিকায় প্রথম স্থানে উঠে আসেন সানিয়া মির্জা। এর আগে ভারতীয় টেনিস মহলে লিয়েন্ডার পেজ এবং মহেশ ভূপতি ছাড়া এই কীর্তি কারও ছিল না। WTA-ক্রমতালিকায় টানা ৮০ সপ্তাহ নিজের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিলেন সানিয়া মির্জা।
• অলিম্পিক্সে সানিয়া-
চারবার অলিম্পিক্সে অংশ নেন সানিয়া মির্জা। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্স দিয়ে অভিষেক হয় তাঁর। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে মহেশ ভূপতির সঙ্গে জুটি বাঁধেন সানিয়া। মিক্সড ডাবলসে সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছান। অলিম্পিক্সে এটাই তাঁর সেরা পারফরম্যান্স।
• এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসে সানিয়া-
সানিয়া মির্জা এশিয়ান গেমসে ২টি সোনা সহ ৮টি পদক জেতেন। ২০০৬ সালের দোহা এশিয়ান গেমসের মিক্সড ডাবলসে সোনা এবং ২০১৪ এশিয়ান গেমসের মিক্সড ডাবলসেও সোনা জেতেন হায়দরাবাদী টেনিস সুন্দরী। এছাড়া কমনওয়েলথ গেমসে দুটি পদক জেতেন যার মধ্যে একটি রুপো এবং অপরটি ব্রোঞ্জ।
বর্ণময় টেনিস কেরিয়ারের শেষে কী করবেন সানিয়া? ইতিমধ্যেই আসন্ন আইপিএলের জন্য রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালোরের মহিলা দলের মেন্টর হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছেন। টেনিস থেকে ক্রিকেটে পদার্পণ গ্ল্যাম গার্লের। জীবন থেমে থাকে না। হয়ত অন্য মোড়কে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরবেন। একবার মনে করুন ৭০ দশকের ‘কালা পাত্থর’ সিনেমায় স্টাইলিশ ভিন্টেজ ক্যাপ পরে মোটরবাইক চালাতে চালাতে শশী কাপূর যে গানটা গাইছেন- ‘এক রাস্তা হ্যায় জিন্দেগি, যো থাম গয়ে তো কুছ নেহি…’