সে রাইকিশোরী খুন হয়েছেন? অনেকে তাই বলছেন। ধর্ষিতা হয়েছেন? অনেকের ধারণা হ্যাঁ, ধর্ষণ করা হয়েছে কিশোরীকে। আত্মহত্যা করেছেন? অনেকে সেটাও বলছেন, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন। এর উত্তর জানাটা খুব শক্ত তা তো নয়। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে দিন দশেকের মধ্যে সবটা জলের মতো পরিষ্কার হবে। কিন্তু ততদিন দেরি করলে চলবে? লোহা গরম, হাতুড়ি চালাও। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এটা একটা সুযোগ, একটা লাশ, একটা আবেগ, একটা মৃত্যু, কাজেই অত সময় দেওয়া যাবে না। আজই ফয়সালা হয়ে যাক, মানুষ দেখুক। আজই বিরোধীরা বলবে এটা খুন, শাসকদল বলবে এটা আত্মহত্যা। কারও কাছেই ১০০ শতাংশ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। ওদিকে পুলিশ, গুলি চালালে মানুষ মরলে সাশপেনশন, ট্রান্সফার, মানবাধিকার মামলা, না চালালে? মানুষ পিটিয়ে মারবে। এখন তো খেলা দুই দুই, কিশোরী মৃত, এক যুবক মৃত, একজন এএসআই কোমায় অন্য সিভিক পুলিশের অবস্থা সংকটজনক, এই যায় কী সেই যায়। এবং এরই মধ্যে রাজভবন ঘেরাও থেকে থানা ঘেরাও চলছে। কিশোরীর মা, যাঁর স্বামী সেই কবেই চলে গেছেন নেপালে, যিনি তাঁর মেয়ের মৃত্যুতে কাঁদারও সময় পাচ্ছেন না, তাঁকে ঘিরে মিডিয়া আর রাজনৈতিক বানিয়াদের আনাগোনা। কাঁদতে দেখলাম সেই যুবকের মা, আত্মীয় পরিজনদের, সামনে চিরফাড় করার পর এক ঠান্ডা মৃতদেহ। সিভিক পুলিশের ঘরে মা বোন নেই? আছে তো। সেখানেও জমাট কান্না। এএসআই-এর শরীরে লাগানো মেশিন বলছে, আছে আছে প্রাণ আছে, গতকাল সেই উত্তেজিত মানুষদের কাছে দু’ হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন, এখনও তাঁর প্রাণ আছে কিন্তু কতক্ষণ থাকবে, তা নিয়ে চিন্তিত চিকিৎসকরা। আজ এটাই বিষয় আজকে, লাশ রক্ত আর তাকে ঘিরে রাজনীতি।
পুলিশ আসতে দেরি হয়েছে, তাই মানুষ উত্তেজিত ছিলেন। আচ্ছা পুলিশ গিয়ে যদি বলতেন, আমাদের দেরি হয়েছে আমরা দুঃখিত, আমাদের এই লাশ নিয়ে গিয়ে ময়নাতদন্ততে দিতে হবে। পরিবারের যিনি যাবেন তিনি চলুন। না, ছবিটা তো এরকম ছিল না, কাদের প্ররোচনায়? কারা বুঝিয়েছিল সেই পরিবার, সেই গ্রামের মানুষদের যে পুলিশ আসলে লাশ দেব না, কেন দেবেন না? লাশের কারবারিরা এলে তারপরে লাশ ছাড়া হবে? হ্যাঁ, এক্কেবারে তাই। আর এটা কি এই নতুন? না। এটাই তো সারা দেশের লাশ কারবারিদের রীতি। তাদের তরফে পরিষ্কার ফোন যায়, নির্দেশ যায়, লাশ আটকে রাখুন, যতক্ষণ না হাজির হচ্ছি। সামনে লাশ থাকলে বক্তৃতা জমে ভালো, কোন নেতা তা অস্বীকার করবেন? লাশ পাওয়া যাবে, মিছিল হবে, বক্তৃতা হবে, শ্মশান যাত্রা হবে, তারপর শহীদ বেদি হবে এবং বছর বছর সেই স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনে শহীদ স্মরণ হবে এটাই তো দস্তুর। কাজেই প্রথম কাজটা মানে ওই কিশোরীর লাশের পাশে জড়ো হওয়া মানুষদেরকে আগাম খেপিয়ে দেওয়াটা তো এই রীতিরই অঙ্গমাত্র, সেই রীতি অক্ষরে অক্ষরে মানা হয়েছে। এরপর সেই উত্তেজিত মানুষজন তাঁদের উত্তেজনা প্রকাশ করেছেন, অন্য সময় ব্যাঘ্র সেজে থাকা পুলিশ এই সময়ে লাশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ল। মোবাইলের যুগ। সে ভিডিয়ো ভাইরাল এবং টিভির পর্দায় চিল চিৎকার, দেখুন দেখুন, মানুষ দেখছে এক অর্ধ উলঙ্গ কিশোরীর শরীর নিয়ে ছুটছে পুলিশ, পেছনে মারমুখী জনতা। অ্যাঙ্করের তীব্র চিৎকার অমানবিক অমানবিক, টিআরপি চড়ছে, অমানবিকভাবেই চড়ছে। সাতসকালে আবার ব্রেকিং নিউজ, আবার মৃত্যু, আবার লাশ। এবার যুবকের লাশ ঘিরে কান্না, বেরিয়ে এসেছে ফুটেজ। এএসআই কোমায়, আবার অ্যাঙ্কর— পুলিশ মৃত্যুশয্যায়, আমাদের চ্যানেলেই প্রথম খবর একজন সিভিক সম্ভবত মারা গেছেন। কেন সম্ভবত কেন? কারণ সময় নেই, এক্সক্লুসিভ করতে হবে, যদি কেউ এর মধ্যে জেনে ফেলে, তাই সম্ভবত এবং সম্ভবততেই টিআরপি চড়ছে। তাহলে লাশ মিডিয়াকে দিল টিআরপি। যত লাশ তত বড় মিছিল, তত উপচে পড়া আবেগ এবং উত্তেজনা, যত লাশ তত বেশি টিআরপি।
আরও পড়ুন: Aajke | পুলিশ কখনও টেবিলের তলায়, কখনও হাতজোড় করে অসহায়
বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর একবছর, বলেছিলেন নাজিম হিকমত। সে বিংশ শতাব্দী কবেই পার হয়ে গেছে, এখন শোকের আয়ু কোথায়? জমাট কান্না জমিয়ে রেখেই পরিবারের মানুষজন লাশের বদলে দামের হিসেবে বসে পড়েন। সব্বাই যে যার মতো গুছিয়ে নিল কেবল সেই লাশ জানতেই পারল না সে হঠাৎ এত দামি কী করে হয়ে উঠল। লাশ নিয়ে তো রাজনীতিই হয়, তাই না? মানুষ কী বলছে?
সামথিং ইজ রটিং ইন দ্য স্টেট অফ ডেনমার্ক। কোথাও তো কিছু পচছে, পচা গন্ধ পাচ্ছেন না? কিছু পুড়ছে, পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন না? আমাদের মায়া মমতা বিবেক সব কখন খোয়া গেছে। তা না হলে এক দুঃখজনক মৃত্যু এমন ধারাবাহিক মৃত্যু মিছিল হয়ে ওঠে কেমন করে? হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দী পার হয়ে গেছে কবেই, হ্যাঁ, এখন শোকের আয়ু তো নেই। কিন্তু যে মা সেই কিশোরীকে, সেই যুবককে, সেই সিভিক পুলিশকে দশ মাস পেটে ধরেছিলেন, তাঁকে কাঁদতে দিন, সেই চোখের জল পড়ুক মাটিতে, সে মাটি অন্তত শান্তি পাক। আমাদের সম্মিলিত পাপের বোঝা এ ধরিত্রী কতদিন বয়ে বেড়াবে? কতদিন মানুষের লাশ কেবল পণ্যই থেকে যাবে? এ প্রশ্ন আমার, আপনাদেরও কি এটাই প্রশ্ন নয়?